মতামত
পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি কার স্বার্থে?

উইন মারমা, রাজেশ ত্রিপুরা, মিতালি চাকমা
১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ সরকারের কাছে জনসংহতি সমিতির সদস্যদের অস্ত্র জমাদানের পর পার্বত্য চট্টগ্রামে সশস্ত্র সংগ্রামের ইতি ঘটে। এর ফলে সেখানে বিপুল সংখ্যক সেনা মোতায়েন রাখার যৌক্তিকতা ও প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যায়।
কিন্তু সেটা ফুরিয়ে গেলেও, এত দীর্ঘ বছর ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়োজিত থাকার ফলে তাদের মধ্যে আর্থিকসহ যে বিভিন্ন কায়েমী স্বার্থ গড়ে উঠেছিল, তারা সেটা হারাতে রাজী ছিল না। তাই তারা সেখানে থাকার যৌক্তিকতা প্রতিপাদন বা অজুহাত খোঁজার জন্য ষড়যন্ত্র করতে থাকে।
সবাই জানে, কোন অঞ্চলে নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েনের প্রয়োজন হয় তখনই, যখন সেই অঞ্চল অশান্ত ও অস্থিতিশীল হয়, অথবা সেখানে কোন যুদ্ধ পরিস্থিতি বিরাজ করে কিংবা বৈদেশিক আক্রমণের আশঙ্কা থাকে। তাই পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়োজিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সেখানে থাকার অজুহাত সৃষ্টি করতে পরিকল্পিতভাবে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির প্রয়াস চালিয়ে আসছে।
পার্বত্য চুক্তির পর এ ব্যাপারে তাদের প্রথম প্রয়াস ছিল জনসংহতি সমিতিকে দিয়ে খুন, অপহরণ ও সন্ত্রাস জারী রেখে পাহাড়ের পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করে তোলা। সেনা-শাসকগোষ্ঠী এতে বেশ সফল হয়। তবে পরের দিকে ব্যাপক প্রতিরোধের কারণে জেএসএস দ্বিধাবিভক্ত ও দুর্বল হলে পরিস্থিতি শান্ত হয়। এ সময় সেনা-শাসকরা নতুন উপায় খুঁজতে থাকে। তারা নতুন করে পাহাড়কে অশান্ত ও সংঘাতময় করে তুলতে বিভিন্ন ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী গঠন করে দেয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে এক সময় দায়িত্ব পালন করা সাবেক সেনা কর্মকর্তারা বিভিন্ন আলোচনায় এখন সেটা স্বীকার করেছেন।
সর্বশেষ সেনারা ২০১৭ সালের ১৫ নভেম্বর খাগড়াছড়িতে তপন জ্যোতি চাকমাসহ কয়েকজন বখাটে ও দাগি আসামীদের দিয়ে একটি ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী গঠন করে দেয়। সে সময় খাগড়াছড়িতে কর্মরত মোত্তালেব নামে জনৈক সেনা অফিসার এই বাহিনী গঠনে প্রধান ভূমিকা পালন করেছিল। এ কারণে এই ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী অনেকের কাছে মোত্তালেব বাহিনী নামে পরিচিতি পেয়েছে। অনেকে তাদেরকে নব্য মুখোশ বাহিনীও ডাকে।
সেনা-ঔরসে জাত এই মোত্তালেব বাহিনীর সদস্যরা শুরু থেকেই খুন-অপহণের মহোৎসবে মেতে ওঠে। তাদের হিট লিস্ট থেকে নারীরাও বাদ যায়নি। হিল উইমেন্স ফেডারেশনের দুই নেত্রী মন্টি চাকমা ও দয়াসোনা চাকমাকে অপহরণ করা হলে তা দেশব্যাপী আলোচিত ঘটনা হয়ে যায়। মূলত ইউপিডিএফ ও তার সহযোগি সংগঠনের নেতা কর্মী ও সমর্থকদের টার্গেট করে ঠ্যাঙাড়েদের লেলিয়ে দেয়া হয়।
ইউপিডিএফের ওপর হামলা চালাতে সেনারা জেএসএস সন্তু গ্রুপসহ ঠ্যাঙাড়ে সন্ত্রাসীদেরকে প্রত্যক্ষভাবে সাহায্য করে থাকে। এইসব হামলাকে “দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ”, “আধিপত্য বিস্তারের লড়াই” ইত্যাদি বলে মিথ্যাভাবে উপস্থাপন করতে সেনারা তাদের বশংবদ মিডিয়া কর্মীদের ব্যবহার করে। আর এভাবে তারা পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতিকে অশান্ত ও অস্থিতিশীল হিসেবে দেশবাসী তথা বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরে এবং পাহাড়ে নিজেদের থাকার যৌক্তিকতা সৃষ্টি করে। মোট কথা, সেনা-শাসকগোষ্ঠী তাদের নিজেদের কায়েমী স্বার্থে অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামকে অশান্ত ও অস্থিতিশীল করে তুলছে।
ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় গঠিত একটি রাজনৈতিক দল এবং গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই এই পার্টি তার কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। গঠনের আগেও এই দলের নেতাদের দীর্ঘ গণতান্ত্রিক লড়াই সংগ্রামের অভিজ্ঞতা ও ইতিহাস ছিল। পার্বত্য চুক্তির পর ইউপিডিএফ জনগণের মধ্যে দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করে। এর কারণ চুক্তির অসারতা প্রমাণিত হওয়া এবং সেই অসার চুক্তি বাস্তবায়নেও সরকার-জেএসএসের গড়িমসি লক্ষ্য করা।
কিন্তু জনসংহতি সমিতির আত্মসমর্পনের পর যাতে নতুন করে আন্দোলন গড়ে না উঠতে পারে সেজন্য সেনারা নতুন পার্টি ইউপিডিএফের ওপর দমনপীড়ন শুরু করে। তারা সন্তু বাহিনী ও অন্যান্য ঠ্যাঙাড়ে বাহিনীকে লেলিয়ে দেয়। দলটির একের পর এক নেতাকর্মী খুন হওয়ার পরও, খুনীদের গ্রেফতার ও ন্যায়বিচার দূরের কথা, বরং খুনীদের রক্ষা ও পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া হয়।
অপরদিকে সন্ত্রাসের নির্মম শিকার ইউপিডিএফকে “সন্ত্রাসী” হিসেবে প্রচার করা হয়। ইউপিডিএফের যাতে গণতান্ত্রিক ইমেজ গড়ে না উঠতে পারে সেটা নিশ্চিত করতে সেনা-শাসক গোষ্ঠী খুবই সচেতন। এই প্রসঙ্গে এখানে একটি ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে। গত বছর ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশে গণতন্ত্রায়নের প্রক্রিয়া শুরু হলে, ইউপিডিএফ তার সাথে যুক্ত হয়। সংবিধান সংস্কার কমিশন, জন প্রশাসন সংস্কার কমিশন, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন ও পুলিশ সংস্কার কমিশনের সুপারিশের ওপর জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে ইউপিডিএফ তার মতামত প্রদান করে। এই ভিত্তিতে গত ১০ মে ঢাকায় জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশনের সাথে পার্টির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে ইউপিডিএফের প্রতিনিধিরা পার্বত্য চট্টগ্রামে স্বায়ত্তশাসনের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে। এরপর জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশনের সাথে দ্বিতীয় বৈঠক হওয়ার কথা ছিল ২০ মে।
কিন্তু দৃশ্যতঃ জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশনের সাথে ইউপিডিএফের এই সংলাপ সেনা-শাসকগোষ্ঠীর পছন্দ হয়নি। তারা “স্টুডেন্টস ফর সভারেন্টি” ও অন্যান্য চরম উগ্র সাম্প্রদায়িক ও ধর্মীয় ফ্যাসিস্ট সংগঠনগুলোকে মাঠে নামিয়ে দেয়। ঢাকা ও রাঙ্গামাটিতে এই সংগঠনগুলোর উদ্যোগে বিক্ষোভ দেখানো হয়। ইউপিডিএফের সাথে বৈঠক না করার জন্য চাপ সৃষ্টি করা হয়। আর জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশন এইসব ভূঁইফোড় সংগঠনের কাছে নতজানু হয়ে ২০মের বৈঠক বাতিল করে দেয়।
মোট কথা, সেনা-শাসকগোষ্ঠী কখনই চায় না ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিকভাবে তার কার্যক্রম পরিচালনা করুক, দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত থাকুক এবং তার গণতান্ত্রিক ভাবমূর্তি গড়ে উঠুক। তারা ইউপিডিএফকে সব সময় একটি “সশস্ত্র ও সন্ত্রাসী” দল হিসেবে উপস্থাপন করতে চায়। এর কারণ হলো, যা আগেই বলা হয়েছে: পার্বত্য চট্টগ্রামে সন্ত্রাসী সংগঠন ও সন্ত্রাসের অস্তিত্ব রয়েছে এমন ধারণা দেশবাসীর কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা সম্ভব হলে সেখানে তাদের মোতায়ন থাকা ও কায়েমী স্বার্থ হাসিল করা সহজতর হয়।
পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়োজিত সেনা-শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতার বলে দিনকে রাত ও সত্যকে মিথ্যা বলে প্রচার করছে। কিন্তু বাস্তব চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। তারা গণতান্ত্রিক দল ইউপিডিএফকে নির্মূলের জন্য ঠ্যাঙাড়ে সন্ত্রাসী সংগঠন সৃষ্টি করেছে, তাদের লালন পালন করছে এবং তাদেরকে দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম জুড়ে সন্ত্রাস করে বেড়াচ্ছে।
সেনা-শাসকগোষ্ঠীর ষড়যন্ত্র হয়ত সফল হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে তাদের কায়েমী স্বার্থকে তারা আপাতত অক্ষুন্ন রাখতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু এর জন্য একদিন তাদেরকে চরম মূল্য দিতে হবে। (২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫)
সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।