পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর দমন-পীড়নের প্রতিবাদে সাজেকে বিক্ষোভ

বাঘাইছড়ি প্রতিনিধি, সিএইচটি নিউজ
সোমবার, ১ সেপ্টেম্বর ২০২৫
পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনা অভিযানের নামে দমন-পীড়নের প্রতিবাদে এবং সেনাশাসন ‘অপারেশন উত্তরণ’ প্রত্যাহারের দাবিতে বাঘাইছড়ি সাজেকে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে ছাত্র জনতার সংগ্রাম পরিষদ ও সাজেক গণ অধিকার রক্ষা কমিটি।
আজ সোমবার (১ সেপ্টেম্বর২০২৫) সকাল ১০টার সময় বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেককের দ্ব-পদা লাদুমুনি বাজার থেকে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করা হয়। মিছিলটি প্রায় পর্যটন সড়ক হয়ে উজোব্জার এসে সমাবেশে মিলিত হয়। এতে বঙ্গলতলী, গঙ্গারাম, বাঘাইহাট এলাকা থেকে পাঁচ শতাধিক ছাত্র জনতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেন।

মিছিল ও সমাবেশে অংশগ্রহণকারীরা “পাহাড় থেকে সেনাশাসন তুলে নাও-নিতে হবে, সেনা অভিযানের নামে স্কুলঘর দখল করা চলবে না, সেনা অভিযানে নামে পাহাড়িদের বাড়িঘর লুটপাট বন্ধ কর” ইত্যাদি লেখা প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন করে এবং সেনা নিপীড়নের বিরুদ্ধে নানা শ্লোগান দেন।
সমাবেশ শুরুতে সেনাবাহিনী গাড়ি এসে উপস্থিত হলে সমবেত ছাত্র-জনতা শ্লোগান দিয়ে এর প্রতিবাদ জানান এবং সড়ক বন্ধ করে সমাবেশ করেন। ছাত্র-জনতার প্রতিবাদের মুখে পরে সেনাবাহিনীর গাড়ি ফিরে যায়।

সমাবেশ শুরুতে সেনাবাহিনীর সদস্যরা উপস্থিত হলে জনতা প্রতিবাদ জানাচ্ছেন।
সমাবেশ থেকে কথিত ‘অস্ত্র উদ্ধার ও সন্ত্রাসী দমন’র নামে পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর ব্যাপক অভিযান, স্কুল ভবন দখল করে দিনের পর দিন সেনাবাহিনীর অবস্থানের ফলে ছাত্র-ছাত্রীদের পাঠদানসহ বিদ্যালয়ের নিয়মিত কার্যক্রমে ব্যাঘাত সৃষ্টি, নির্বিচারে বাড়িঘরে তল্লাশি, নারীদের সঙ্গে অসদাচরণ, লুটপাট, ধরপাকড়, হয়রানিসহ অবর্ণনীয় জনদুর্ভোগ সৃষ্টির তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানো হয়।
ছাত্র-জনতার সংগ্রাম পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি বাবু ধন চাকমার সভাপতিত্বে ও কান্তি চাকমার সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত সমাবেশে বক্তব্য রাখেন সাজেক গণ অধিকার রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক মেহেন্দ্র ত্রিপুরা, সাজেক ভূমি রক্ষা কমিটির সদস্য সচিব রতন চাকমা, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের বাঘাইছড়ি উপজেলা সভাপতি জ্যোতি চাকমা, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের রাঙামাটি জেলা প্রতিনিধি বিশাখা চাকমা, গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের বাঘাইছড়ি উপজেলা শাখার সহ সাধারণ সম্পাদক সমর চাকমা ও সাজেক জুমচাষী কল্যাণ সমিতি ও কারবারী সমিতির সম্পাদক ধারাজ কার্বারি।
রতন চাকমা বলেন, শাসকগোষ্ঠি পার্বত্য চট্টগামে সেনা অভিযানের নামে সাধারণ জনগণকে নিপীড়ন, নির্যাতন ও হয়রানি করছে। ঘরবাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে নগদ টাকাসহ জিনিসপত্র লুট করছে। স্কুল ভবনকে অস্থায়ী ক্যাম্প বানিয়ে শিক্ষার ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। নারীদের সাথে অসদাচারণ করছে। ফলে জনগণ নিরাপদে চলাফেরা ও বসবাস করতে পারছে না। তাই তিনি এই অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান।
বিশাখা চাকমা বলেন, পাহাড়িরা দীর্ঘ দশকের পর দশক ধরে সেনাবাহিনী দ্বারা নিপীড়িত-নির্যাতিন, লাঞ্ছিত-বঞ্চিত হয়ে আসছে। সম্প্রতি সেনা অভিযানে কথিত ‘সন্ত্রাসী’ খোঁজার নামে সেনাবাহিনীর সদস্যরা রাত বিরাতে সাধারণ গ্রামবাসীদের ঘরবাড়িতে তল্লাশি করছে, নারীদেরকে যৌন হয়রানি করছে, জিনিসপত্র নিয়ে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, সাজেকবাসী কত কষ্ট করে একটি কলেজ নির্মাণ করছে এখানকার ছেলে-মেয়েদের উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য। সেখানেও সেনাবাহিনী বাধা দিচ্ছে। শুধু তাই নয়, ঘরবাড়ি তুলতেও সেনাবাহিনী বাধা দেয়। তাই এই এলাকায় নিরাপদে বসবাস করার জন্য আমাদের আন্দোলনের কোন বিকল্প নেই। অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে রুখে দাঁড়াতে হবে।

মেহেদ্র ত্রিপুরা বক্তব্য বলেন, আমরা পাহাড়িরা নানা ধরনের হয়রানি শিকার হচ্ছি। তিনি অবিলম্বে হয়রানিমূলক সেনা অভিযান বন্ধ করার দাবি জানিয়ে সেনাবাহিনীর উদ্দেশ্যে বলেন, আপনারা আর কত পাহাড়িদের ওপর নিপীড়ন চালাবেন। আজকের এই সমাবেশ থেকে আপনাদের প্রতি আহ্বান, অবিলম্বে জনগণের ওপর নিপীড়ন-হয়রানি বন্ধ করুন।
ছাত্রনেতা জ্যোতি চাকমা বলেন, সেনারা ইউপিডিএফের বিরুদ্ধে অভিযানের নাম করে সাধারণ পাহাড়িদেরকে নিপীড়ন-নির্যাতন ও হয়রানি করছে। রাতের অন্ধকারে ঘরবাড়িতে হানা দিয়ে তল্লাশি করে টাকাসহ জিনিসপত্র লুটে নিয়ে যাচ্ছে। আজকে নিজ বাড়িতেও নারীসহ জনগণের নিরাপত্তা নেই। সেনারা স্কুল ভবন দখল করে ক্যাম্প বানিয়ে থাকে। ফলে শিক্ষার্থীরা ঠিকমত বিদ্যালয়ে গিয়ে ক্লাস করতে পারছে না। একটি রাষ্ট্রীয় বাহিনীর এমন অন্যায় কর্মকাণ্ড কখনো গ্রহণযোগ্য নয়।
তিনি আরও বলেন, সেনারা আসল অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে তাদের সাথে রাখে, অথচ তারা সন্ত্রাসী খোঁজে জনগণের ঘরবাড়িতে। তারা যদি সত্যিকার অর্থে অস্ত্রধারী খুঁজতো তাহলে তাদের আশ্রয়ে থাকা ঠ্যাঙাড়েদের বিরুদ্ধে আগে ব্যবস্থা নিতো। কিন্তু তারা তা না করে কেন সাধারণ জনগণকে হয়রানি করছে?
যুব নেতা সমর চাকমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনা অপারেশনের নামে কার্যত নিপীড়ন, হয়রানি ও লুটপাট চালানো হচ্ছে। এমন অন্যায়-অবিচার আর বরদাস্ত করা হবে না। আমাদেরকে বন্দুক দিয়ে ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। যদি বন্দুক দিয়ে আন্দোলন দমন করা যেতো কোন আন্দোলনই গড়ে উঠতো না। পার্বত্য চট্টগ্রাামের জনগণ বন্দুকের মুখে আন্দোলন করতে শিখেছে।
তিনি সবাইকে অন্যায় দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে আন্দোলনে সামিল হওয়ার আহ্বান জানান এবং অবিলম্বে সেনাশাসন প্রত্যাহার করে দমন-পীড়ন বন্ধ করতে সরকারের কাছে দাবি জানান।
ধারাজ কার্বারি তার বক্তব্যে বলেন, সেনাবাহিনী আমাদের পাহাড়ে নিপীড়ন নির্যাতন, অপহরণ, গণহত্যা চালিয়েছে, যার কারণে আমাদের পাহাড়িরা শরনার্থী হতে বাধ্য হয়েছে। অতীতের মতো বর্তমানেও একইভাবে নিপীড়ন-নির্যাতন চালানো হচ্ছে। তিনি অনতিবিলম্বে নিপীড়ন-নির্যাতন বন্ধের দাবি করেন।
সভাপতির বক্তব্যে বাবুধন চাকমা বলেন, সেনা অপারেশনের নামে কখনো ইউপিডিএফ তকমা লাগিয়ে দিয়ে কখনো ‘সস্ত্রাসী’ তকমা লাগিয়ে দিয়ে রাত-বিরাতে সাধারণ জনগণের ঘরবাড়িতে তল্লাশি চালানো হচ্ছে। ধরপাকড় করে নিপীড়ন-নির্যাতন করা হচ্ছে। একজন মানুষের নিরাপদে বসবাস ও চলাফেলা করার অধিকার তার সংবিধানসম্মত অধিকার। কিন্তু সেনাবাহিনী সে অধিকারকে পদধুলিত করছে।
তিনি বলেন, আমাদের আর পিছনে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই। আমাদেরকে লড়াই করেই টিকে থাকতে হবে। প্রয়োজনে লড়াই করেই মরবো। এই জাতি যতদিন টিকে থাকবে ততদিন লড়াই করে যেতে হবে।
তিনি বলেন, আমরা সমান অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকতে চাই। কারণ আমরা এদেশের নাগরিক। আমাদের যদি জাতিগতভাবে ধ্বংস করে দিতে চান তাহলে আমরাও আমাদের আন্দোলন চালিয়ে নিয়ে যাবো।
সমাবেশ থেকে ৭ দফা দাবি জানানো হয়। দাবিগুলো হলো:
ক) অবিলম্বে অপারেশনের নামে তল্লাশি, লুটপাট, হয়রানি, ও বেআইনী গ্রেফতার বন্ধ করতে হবে।
খ) যেসব টাকা ও দলিলপত্র লুট করে নেয়া হয়েছে সেগুলো ফেরত দিতে হবে।
গ) প্রকৃত সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার করতে হবে ও তাদেরকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান বন্ধ করতে হবে।
ঘ) পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করতে হবে।
ঙ) সাজেক কলেজ নির্মাণ ও সাজেকে সকল প্রকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, নিজ বাড়িঘর নির্মাণে বাধা প্রদান বন্ধ করতে হবে। সাজেক কলেজ নির্মাণ ও এগজ্যাছড়ি বে-সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মাণ কাজে দায়িত্বশীল প্রতিনিধি ও অজ্ঞাতনামা করে ফরেস্ট কর্তৃক দায়েরকৃত মামলা প্রত্যাহার করতে হবে।
চ) সাজেক ৯নং হরেন্দ্র পাড়ায় সেনাবাহিনীর সাজানো ইউপিডিএফের আস্তানা থেকে ষড়যন্ত্রমূলক অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার নাটকের তদন্ত এবং অজ্ঞাত নামা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে।
ছ) সমতলের মতো পার্বত্য চট্টগ্রামেও গণতন্ত্র দিতে হবে।
সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।