মন্তব্য প্রতিবেদন
পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনা অপারেশনের নামে কী হচ্ছে?
মন্তব্য প্রতিবেদন
খাগড়াছড়ির গুইমারায় সেনা-সেটলার হামলার পর ইউপিডিএফের সাংগঠনিক প্রভাবাধীন এলাকায় সেনা অপারেশন ও টহল জোরদার করা হয়েছে। মুখে সন্ত্রাস দমন হলেও এর প্রকৃত উদ্দেশ্য হলো গুইমারা হামলায় জড়িত সেনা কর্মকর্তা-সদস্য ও সেটলারদের অপরাধ ঢামাচাপা দেয়া এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে বর্তমান সময়ে একমাত্র আন্দোলনকারী দল ইউপিডিএফের প্রভাব খর্ব করা।
সেনাবাহিনী ও বিজিবির শত শত সদস্য নিয়োজিত করে চলমান এই অপারেশনের টার্গেট ইউপিডিএফ হলেও এর আসল ভুক্তভোগী হচ্ছেন সাধারণ নিরীহ জনগণ। অপারেশনের সময় গ্রামবাসীদের নির্যাতন, বাড়িঘরে তল্লাশির নামে চরম হয়রানি-লুটপাট, সন্ত্রাসী আখ্যায়িত করে গ্রেপ্তার, তাদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, স্কুল ও জমি দখল করে অবস্থান এবং তাদের সম্পত্তির ক্ষতিসাধণ করা হচ্ছে। এমনকি রাঙামাটির সাজেকে এক নারীকে যৌন হেনস্তা করা হয়েছে।

এখানে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা অপ্রাসঙ্গিক। সিএইচটি নিউজে প্রতিদিন এসব ঘটনার রিপোর্ট প্রকাশ করা হচ্ছে। তবে এখানে কেবল গত ১৭ নভেম্বর রাঙ্গামাটি জেলার লংগদু উপজেলার মধ্য হারিকাবা গ্রামে পাঁচ নিরীহ গ্রামবাসীকে নির্যাতনের ঘটনা সম্পর্কে সামান্য আলোকপাত করতে চাই। এই পাঁচ ব্যক্তির নাম সাগরবাসা চাকমা (২৪), সুমন চাকমা (২৪), কালাচান চাকমা (২৫), বীর চাকমা (পাগানি বাপ, ৪৮) ও জ্ঞানেন্দু চাকমা ((২৬) । এরা সবাই গরীব দিন মজুর। কেবল মাত্র ইউপিডিএফ কর্মী বা সমর্থক সন্দেহে বামে লংগদু সাবজোনের সেনারা তাদের ওপর অমানুষিক শারীরিক নির্যাতন চালায়। এ সময় গ্রামের নারীরা এগিয়ে এসে প্রতিবাদ না করলে তাদেরকে আরও বেশি মারধর করা হতো এবং “ইউপিডিএফ সন্ত্রাসী” আখ্যায়িত করে “চালান” দেয়া হতো। তারপরও তাদেরকে এত বেশি নির্যাতন করা হয় যে, তারা লংগদু হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নিতে বাধ্য হয়।
নির্যাতিতদের সাথে কথা বলে জানা যায়, সেনাদের কাছে তথ্য ছিল ইউপিডিএফের কয়েকজন সদস্য তাদের বাড়িতে এসেছে ও তারা তাদেরকে ভোজে আপ্যায়ন করেছে। সেনারা এ বিষয়ে তাদেরকে জিজ্ঞেস করলে তারা তা দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করে, কারণ সত্যিই কোন ইউপিডিএফ সদস্য তাদের গ্রামে যায়নি। এরপর সেনারা রেকর্ডকৃত একটি অডিও কল তাদেরকে বাজিয়ে শোনায়, যেখানে জেএসএস সন্তু গ্রুপের এক সদস্য ইউপিডিএফ সম্পর্কিত উক্ত মিথ্যা তথ্য সেনাদের সরবরাহ করেছিল।
কাজেই স্পষ্ট বোঝা যায়, জেএসএস সন্তু গ্রুপের দেয়া মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে উক্ত পাঁচ নিরীহ দিনমজুরকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। এ ধরনের ঘটনা সম্প্রতি সাজেকেও ঘটেছে। সন্তু গ্রুপের সদস্যরা সন্দেহ অথবা শত্রুতা বশতঃ অথবা অন্য কোনভাবে পাওয়া মিথ্যা তথ্য সেনাবাহিনীর সদস্যদের কাছে সরবরাহ করছে। আর যাচাই-বাছাই না করে সেই তথ্যের ভিত্তিতে সেনারা নিরীহ লোকজনের ওপর অত্যাচার চালাচ্ছে।
আমাদের প্রশ্ন, যাদের নির্যাতন করা হলো তাদের অপরাধ কী? তারা কি এদেশের নাগরিক নয়? যদি তারা এদেশের নাগরিক হয়, তাহলে এদেশের সংবিধানে নাগরিকদের জন্য যেসব অধিকার স্বীকৃত সেই সব অধিকার তাদেরও প্রাপ্য। বিনা কারণে কিংবা কেবল কোন একটি সংগঠনের সদস্য বা সমর্থক সন্দেহে কোন নাগরিককে নির্যাতন করার অধিকার সেনাবাহিনীকে কোন আইনে দেয়া হয়েছে? বিনা অনুমতিতে হরহামেশা পাহাড়িদের বাড়িঘরে তল্লাশি চালানো হচ্ছে। অথচ সংবিধানে লেখা আছে: “রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলা, জনসাধারণের নৈতিকতা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের (ক) প্রবেশ, তল্লাশী ও আটক হইতে স্বীয় গৃহে নিরাপত্তালাভের অধিকার থাকিবে।” (অনুচ্ছেদ ৪৩)
যদি নির্যাতিতরা সত্যিই ইউপিডিএফ কর্মী বা সমর্থক হয়ে থাকেন, অথবা যদি সত্যি সত্যি ইউপিডিএফ সদস্যরা তাদের বাড়িতে গিয়ে থাকেন এবং তারা তাদের আপ্যায়ন করে থাকেন, তাহলেও নাগরিক হিসেবে এতে তারা কোন অপরাধ করেননি। কারণ বাংলাদেশ সংবিধান তাদেরকে সংগঠন করার অধিকারকে, কোন দল বা সংগঠনকে সমর্থন করার ও তাদের সভাসমাবেশে অংশগ্রহণ করার অধিকারকে স্পষ্টভাবে স্বীকার করে।
আর যদি তারা সত্যিই সন্ত্রাসী হন, অথবা আমলযোগ্য কোন অপরাধে জড়িত থাকেন, তাহলেও তাদেরকে মারধর করার অধিকার সেনাসদস্যরা রাখেন না। একমাত্র একটি বৈধ আদালতই তারা কোন অপরাধ করেছেন কীনা সেটা বিচার করার এবং দণ্ডাদেশ দেয়ার এক্তিয়ার রাখেন। নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের কাজ হলো কেবল তাদেরকে আইনের হাতে তুলে দেয়া। কিন্তু তারা সেটা না করে দেশের আইন আদালতকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নিজেরাই Police, Judge, Jury ও Executioner হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে শাসন (আসলে অপশাসন) চালিয়ে যাচ্ছেন।
এখানে বলা প্রয়োজন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা যখন ইউপিডিএফের প্রভাবাধীন সাংগঠনিক এলাকায় “সন্ত্রাসী” খুঁজতে অতি ব্যস্ত, তখন রাঙ্গামাটি জেলার কাউখালির ঘাগড়া-চট্টগ্রাম সীমান্তে চাম্পাতলী সেনা ক্যাম্প থেকে মাত্র ৪-৫ মিনিটের দূরত্বে ৪০ জনের একটি সশস্ত্র সন্ত্রাসী দল ৩১শে অক্টোবর থেকে অবস্থান করছে এবং চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। অথচ সেনাবাহিনী ও স্থানীয় প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না। তারা জেনেও না জানার, শুনেও না শুনার ভাণ করছে।
উক্ত সন্ত্রাসী গ্রুপটির বিরুদ্ধে ক্ষোভ সৃষ্টি হওয়ায় গত ১৬ নভেম্বর দুই সহস্রাধিক কাউখালিবাসী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবিতে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বরবার লেখা একটি স্মারকলিপি ইউএনওর কাছে হস্তান্তর করেন। কিন্তু তারপরও সন্ত্রাসী দলটি এখনও বহাল তবিয়তে রয়েছে।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তথাকথিত সন্ত্রাস বিরোধী অভিযান যে ভূয়া তা উক্ত সন্ত্রাসী দলটির প্রতি তাদের উদাসীন থাকার মাধ্যমে ফুটে উঠেছে। সেনাদের অভিযান আসলে “সন্ত্রাসীদের” বিরুদ্ধে নয়, তা জনগণের বিরুদ্ধে – ইউপিডিএফ ও জনগণের ওপর দমনপীড়ন চালানোর মাধ্যমে পাহাড়ে একটি ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে গণআন্দোলন দমনের জন্য তারা এই অভিযান চালাচ্ছে।
সেনাবাহিনীর এই গণবিরোধী অভিযানের বিরুদ্ধে পাহাড়িদের মধ্যে ক্ষোভ ও অসন্তোষ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাদের ওপর যে অন্যায় অত্যাচার চালানো হচ্ছে তা তারা আর সহ্য করতে রাজী নয়। বিনা দোষে গ্রেপ্তার, নির্যাতন, হয়রানি কেউ মেনে নিতে পারছে না, পারার কথাও নয়। তাই ইতিমধ্যে বিভিন্ন জায়গায় সেনাদের চলমান অভিযানের বিরুদ্ধে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ সমাবেশ-বিক্ষোভ হয়েছে। কোন কোন এলাকায় অপারেশনের স্থানেই জনগণ সেনাদের প্রতিরোধ করছে, কাউকে অন্যায়ভাবে আটক করে নিয়ে যেতে চাইলে তাতে বাধা দিচ্ছে।
অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ অবশ্যই ন্যায়সঙ্গত। অন্যায়ের প্রতিবাদ করা সামাজিক ও নাগরিক দায়িত্বও বটে। আমরা আশাকরি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী অন্যায়ভাবে কোন নাগরিকের মৌলিক অধিকার হরণ করা থেকে বিরত থাকবে এবং অবিলম্বে তথাকথিত সন্ত্রাস বিরোধী অভিযানের নামে জনগণের ওপর জুলুম, নির্যাতন, লুটপাট বন্ধ করবে।
(২০ নভেম্বর ২০২৫)
সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।
