পার্বত্য চট্টগ্রামে হত্যাযজ্ঞের ন্যায়বিচার ও সেনা শাসন অবসানের দাবি মুক্ত গবেষক এলায়েন্স’র
সিএইচটি নিউজ ডেস্ক
রবিবার, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪
পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের ন্যায়বিচার ও সেনা শাসনের অবসানের দাবি জানিয়েছে মুক্ত গবেষক এলায়েন্স, বাংলাদেশ।
গত ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ এলায়েন্সের এক বিবৃতিতে বলা হয়, জুলাই আন্দোলন বাংলাদেশে এক গণতান্ত্রিক সমাজের প্রত্যাশা ও স্বপ্ন নিয়ে এসেছে, যা কর্তৃত্ববাদী আওয়ামী লীগ রেজিমে অনুপস্থিত ছিল। গণতন্ত্র মানেই দেশের প্রতিটি নাগরিকের জন্য তাদের মৌলিক ও নাগরিক অধিকারসমূহ নিশ্চিত করা। একটা গণতান্ত্রিক দেশে তার সমাজ ও রাজনৈতিক পটভূমিতে লিঙ্গ, জাতি, শ্রেণী ও ধর্ম পরিচয় নির্বিশেষে সকল নাগরিক অংশগ্রহণ করবে, এটাই কাম্য। অথচ, গভীর বেদনার সাথে আমরা লক্ষ্য করছি যে গণতন্ত্রের এই স্বপ্ন খুব দ্রুত আমাদের বাস্তবতা থেকে অপসৃত হচ্ছে।
গত ১৮ সেপ্টেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রামে মামুন নামক স্থানীয় এক বাঙালি যুবকের মৃত্যু স্থানীয় জনপদে অস্থিতিশীল অবস্থা জাগিয়ে তোলে। ফলশ্রুতিতে পার্বত্য চট্টগ্রমের জনগণের মাঝে শুরু হওয়া মতানৈক্যটি একটি সাম্প্রদায়িক নৃশংসতায় রূপ নিয়েছে বলে আমরা জানতে পেরেছি, যার মাঝে ছিলো খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটি জেলায় অগ্নিসংযোগ, রাষ্ট্রীয় মদদপুষ্ট আক্রমণ, ও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর উপর চালানো হত্যাকাণ্ড, যার মাঝে ছিলো দুইজন কলেজ শিক্ষার্থী। অথচ খাগড়াছড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার বরাতে যানা যায়, মৃত ব্যক্তির স্ত্রী তিনজনের নাম উল্লেখ করে (আরও অজ্ঞাতনামা ১০-১২ জন সহ) একটি হত্যা মামলে দায়ের করেছেন, যে তিনজনই স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী। দায়ী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনার বদলে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী উল্টো লিপ্ত হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর উপর দমন-পীড়ন ও হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যাওয়ার কাজে। এছাড়া আমরা দেখেছি, অনলাইনে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বড় আকারের মিথ্যা তথ্য ও অপপ্রচারের ক্যাম্পেইন চালানো হচ্ছে যা তাদের স্টিগমাটাইজেশনকে জোরদার করছে। এই বর্বরতা বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক কাঠামো সৃষ্টির সকল প্রত্যাশাকে গুঁড়িয়ে দেয় এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জমি ও জীবনের উপর চাপিয়ে দেয়া দমনমূলক সেনা মোতায়নকেই আরো জোরদার করে।

বিবৃতিতে আরো বলা হয়, ঐতিহাসিকভাবেই, বাংলাদেশের ‘আদিবাসীরা’ একটি ধারাবাহিক ও কাঠামোগত নিপীড়নের শিকার, যা তাদেরকে মৌলিক সব সাংবিধানিক ও মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত করে আসছে। ব্রিটিশ আমল থেকেই বিভিন্ন ক্ষমতাধর সরকার সমস্যাযুক্ত ভূমি আইনের অপব্যবহারের মাধ্যমে আদিবাসী জনতাকে গৃহহারা করে আসছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭২ সালে আদিবাসীদের পরিচয় এবং প্রতিনিধিত্বের দাবি অস্বীকার করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। এই পরিস্থিতির আরো অবনমন ঘটেছে যখন ১৯৭৯ সাল থেকে বাংলাদেশ সরকার পার্বত্য অঞ্চলের বাইরে থেকে বাঙালিদের গণহারে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাঠাতে শুরু করে এবং সেখানে, শুধু সীমান্তে নয়, বরং গোটা পাহাড় জুড়ে সেনাশাসন কায়েম করে। আন্তর্জাতিক আদিবাসী সংক্রান্ত ওয়ার্কিং গ্রুপ (আইডব্লিউজিআইএ) – এর মতে, ২০১৪ সালের হিসাব অনুযায়ীই ৩৫ থেকে ৪০ হাজার সেনা (বর্ডার গার্ডস বাংলাদেশ, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন এবং বাংলাদেশ আনসার বাদে) পার্বত্য চট্টগ্রামে মোতায়েন ছিল, যা সেনাবাহিনীর মোট সদস্যসংখ্যার একটি বড় অংশ। পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশনের মতে, প্রতি ছয় জন আদিবাসীর জন্য সেখানে এক জন করে সেনা মোতায়েন করা আছে। রাষ্ট্র আমাদেরকে “আইন শৃঙ্খলা ও শান্তি ফিরিয়ে আনতে এই সেনা মোতায়েন”, এই বয়ান দিয়ে আসলেও, এসব ক্রিয়াকলাপ আদিবাসী জনগণকে লম্বা সময়ের জন্য নিপীড়নের পাত্রে পরিণত করে, তাদেরকে ভুলভাবে চিহ্নিত করা হয় “বিচ্ছিন্নতাবাদী”, “সন্ত্রাসী” ও “বহিরাগত” হিসেবে। আওয়ামী লীগ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম ’শান্তি চুক্তি ১৯৯৭’ বাস্তবায়নও কখনো সম্পূর্ণ করে নাই, উল্টো ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মতন অপমানসূচক শব্দবন্ধ ব্যবহার করার মাধ্যমে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অপমানের পাল্লাই ভারী করেছে।
এতে বলা হয়, বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের দাবি এই যে পার্বত্য চট্টগ্রামের চলমান সংকটকে অস্বীকার করে পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীদের অধিকার নিশ্চিত করা বা তাদেরকে বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হবে না। এক্ষেত্রে নাগরিক স্পেস থেকে সেনাশাসনের অবসান অত্যন্ত জরুরী, কারণ সেনাশাসন পার্বত্য চট্টগ্রামকে কার্যত একটি “যুদ্ধক্ষেত্রে” পরিণত করে এবং আদিবাসী জনগণের নাগরিক জীবনে সেই যুদ্ধের রেশ টেনে নিয়ে আসে। আমরা তাই পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সেনা শাসনের অবসান এবং দমনমূলক রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা দ্বারা সেখানে চলমান রক্তপাতের ইতি টানার দাবি জানাচ্ছি। এছাড়া বাংলাদেশের আইনে কোনো ক্রিয়াকলাপ যদি অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়, তাহলে তা দেশের অন্যান্য স্থানের মতন আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ও বিচার বিভাগের মাধ্যমে সুরাহা করা হবে – এটাই আমাদের কাম্য, এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডগুলির ন্যায়বিচার আমরা দাবি করছি। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দেশের জনগণের একটি অংশকে ক্রমাগত বিপদের মুখে ঠেলে দেবে, এটা আমাদের প্রত্যাশা নয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের সাধারণ স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে ক্রমাগত “বহিরাগত” বা “সন্ত্রাসী” আখ্যা দিয়ে অপমান করতে থাকলে তা এক বর্বরোচিত জাতিগত হত্যাযজ্ঞ ও রাষ্ট্রীয় অপরাধের দিকেই আমাদের ঠেলে দেবে।
বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছেন, ফয়সাল জামান, শিল্প গবেষক; সৈয়দ হাসান ইমতিয়াজ, সামাজিক মহামারী গবেষক; সুমি আনজুমান, শিল্প গবেষক; খন্দকার তূর আজাদ, উন্নয়ন অর্থনীতি গবেষক; শ্রবণা শফিক দীপ্তি, নগর নৃতাত্ত্বিক; শোয়েব আবদুল্লাহ, ডিজিটাল অধিকার গবেষক; নিসর্গ নিলয়, বিউপনিবেশায়ন বিষয়ক গবেষক লিটন বড়ুয়া, রাজনৈতিক মনস্তত্ত্ববিদ; নাঈমুল আলম, সাহিত্য সমালোচক; পাইচিমং মারমা, আদিবাসী জনগোষ্ঠী বিষয়ক গবেষক; আরিফুজ্জামান খান, মহামারী ও জনস্বাস্থ্য গবেষক; পারভেজ আলম, সাংস্কৃতিক বিশ্লেষক; দেবাশিস চক্রবর্তী, ক্ষমতার রাজনীতি ও নাগরিক কল্পনাশক্তি বিষয়ক গবেষক; হক মুহাম্মদ ইশফাক, কম্পিউটার বিজ্ঞানী; মনজুরুল মাহমুদ ধ্রুব, রাজনৈতিক যোগাযোগ বিষয়ক গবেষক; মিম আরাফাত মানব, কম্পিউটার বিজ্ঞানী ও ডিজিটাল আইন গবেষক; নাফিসা রায়হানা, জীব-পদার্থবিদ; সারোয়ার তুষার, উত্তর-/বি-উপনিবেশায়ন ও রাষ্ট্রীয় ভায়োলেন্স বিষয়ক গবেষক; মাহি শফিউল্লাহ, মেশিন লার্নিং গবেষক; অদিতি নওশিন, শিক্ষা পদ্ধতি বিষয়ক গবেষক; অদিতি শরিফ, সামাজিক নৃতাত্ত্বিক; জয়ন্ত জ্যোতি মণ্ডল, মেশিন লার্নিং গবেষক; সাবিক খায়ের, লাইফ সায়েন্সেস গবেষক; আরেফিন মিজান, জনস্বাস্থ্য গবেষক; নাফিজ ইমতিয়াজ রাফিন, ডেটা সায়েন্টিস্ট; আপন দাস, সাংস্কৃতিক নৃতাত্ত্বিক; আনিকা তাহসিন মায়ামি, কম্পিউটেশনাল সমাজবিজ্ঞানী ফাহিম বিন সেলিম, তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী; রাইসুল ইসলাম, লাইফ সায়েন্সেস গবেষক; সোহরাব রাব্বি, বিউপনিবেশী শিল্প ও প্রতিবেশ গবেষক; সহুল আহমদ, গণহত্যা বিষয়ক গবেষক; ফয়সাল বিন তৌহিদ সিদ্দিকী, নিউক্লিয়ার ফিউশন গবেষক; সাদিকুল সাকিফ, সাইবারসিকিউরিটি গবেষক; পার্বণ চাকমা, আইন গবেষক ও কলামিস্ট; প্রিয়াসী চাকমা, আইন গবেষক; জয়ী চাকমা, স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী, লীডস ইউনিভার্সিটি বিজনেস স্কুল; তুফান চাকমা, ভিজুয়াল আর্টিস্ট এবং ইরাসমাস মুন্ডাস স্কলার; আর্যশ্রী চাকমা, স্নাতক শিক্ষার্থী, সুইট ব্রায়ার কলেজ, ভার্জিনিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র; সোহম খীসা, মেশিন লার্নিং গবেষক; নবাংশু চাকমা, আইন গবেষক; পার্বতী রায়, পিএইচডি গবেষক, ব্রিটিশ কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়; দিনালো চাকমা, পিএইচডি গবেষক, ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয় স্বাক্ষর অধিকারী, জনস্বাস্থ্য গবেষক।
বিবৃতিটি মুক্ত গবেষক এলায়েন্স, বাংলাদেশ-এর ফেসবুক পেইজ থেকে নেওয়া হয়েছে। আজ (২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪) তাদের ফেসবুক পেইজে বিবৃতিটি প্রকাশ করা হয়।
সংবাদ মাধ্যমে এই বিবৃতিটি প্রকাশের বিষয়ে তাদের ফেসবুক পেইজে বলা হয়েছে, দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আমরা যোগাযোগ করেছি এমন সকল সংবাদপত্র (১০+) ও অনলাইন পোর্টাল (২০+) এই বিবৃতিটি ছাপাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে,এবং কেনো ছাপানো যাবে না এই মর্মে কোনো উত্তর জানায়নি, যদিও ইতোপূর্বে জুলাই আন্দোলন চলাকালীন তারা আমাদের বিবৃতি ছাপাতে দ্বিধাবোধ করেনি। বাংলাদেশের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও প্রেসের স্বাধীনতা বিষয়ে তাই আমাদের ভয় পেতে হচ্ছে। মিডিয়া সেন্সরশিপের ক্ষেত্রে জুলাই এবং বর্তমানের মাঝে আদৌ কোনো দৃশ্যমান পার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে, এটা বলার আগেও তাই আমাদের দ্বিতীয়বার ভাবতে হচ্ছে।
সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।