পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার পেছনে জিয়াউর রহমানের ভূমিকা

0

নিয়ং মারমা

৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২


মেজর জেনারেল এম খলিলুর রহমান তার লেখা ‘কাছে থেকে দেখা ১৯৭৩-১৯৭৫’ বইয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার পেছনে জিয়াউর রহমানের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করেছেন। (বইটি প্রকাশ করেছে প্রথমা প্রকাশন, পঞ্চম মুদ্রণ: ভাদ্র ১৪২৮, সেপ্টেম্বর ২০২১)। তিনি শেখ মুজিবের শাসনের সময় বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) এর মহা পরিচালক ছিলেন। তার বইটির ষষ্ঠ অধ্যায়ে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা’ ও ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম: পরবর্তী ঘটনাক্রম’ শিরোনামে দুটি অংশ রয়েছে। নিচে সেখান থেকে কিছু উদ্ধৃতি তুলে ধরা হলো, এতে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সৃষ্টির ক্ষেত্রে সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাংলাদেশের কতিপয় সামরিক ও বেসামরিক আমলার এবং বিশেষত জিয়াউর রহমানের অতি উৎসাহী ভূমিকা বুঝতে সহজ হবে।

১) অনেকেই জানেন যে স্বাধীনতার পরপরই পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর অবিসংবাদিত নেতা মানবেন্দ্র লারমা বঙ্গবন্ধুর কাছে এসেছিলেন একটি প্রস্তাব নিয়ে। বিৃটিশ আমল থেকে প্রচলিত পাহাড়িদের বিশেষ অধিকার ও সুবিধাদি যেন বাংলাদেশেও অব্যাহত থাকে। মোট কথা, পার্বত্য অঞ্চল পাহাড়িদের বাসস্থান ও পাহাড়িরাই তাতে বাস করবে।

২) বঙ্গবন্ধু পাহাড়িদের প্রতি সংবেদনশীল ছিলেন, কিন্তু লারমার এই প্রস্তাবে পুরোপুরি সম্মত না হয়ে বলেছিলেন, ‘তোরাও তো বাঙালিই, এখন আমরা স্বাধীন হয়েছি। আমরা তো এক জাতিই। অতএব, তোরাও পুরোপুরি বাঙালি হয়ে হয়ে যা।

৩) এদিকে বঙ্গবন্ধুর মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী নয়, এখানকার এমন একটি গোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থেই বঙ্গবন্ধুকে উৎসাহিত করতে থাকেন যাতে তিনি সমতলের বাঙালিদের পাহাড়ে গিয়ে বসতি স্থাপনকে অনুমোদন করেন। ভবিষ্যতে যেন সেখানে পাহাড়িদের এমন সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকে যার সুযোগ নিয়ে তারা বাংলাদেশের ভৌগলিক সত্তার ওপর আঘাত হানার সাহস পায়। ব্যক্তিগতভাবে বঙ্গবন্ধু এই স্বার্থান্ধ গোষ্ঠীটির সঙ্গে এত দূর এগিয়ে যাওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন না। কিন্তু এই গোষ্ঠীটি সেনাবাহিনীকেও প্ররোচিত করে। সেনাবাহিনীর উচ্চাভিলাষী কিছু সিনিয়র অফিসার হয়তো পার্বত্য চট্টগ্রামকে ‘বাঙালায়ন’ করার বাহানায় সেনাবাহিনীর কলেবর বৃদ্ধি, নিজেদের পদোন্নতি ও গোষ্ঠীশক্তি বৃদ্ধি করতে চেয়েছিলেন। এমনিতে তো সেনাবাহিনীতে দুই গ্রুপে রেষারেষি ও তার ফলস্বরূপ ষড়যন্ত্র সর্বদাই চলছিল। তারা ভেবেছিল, এর পরে পাহাড়িরা যখন নিজেদের অধিকার রক্ষায় আন্দোলন শুরু করবে এবং ত্রিপুরা রাজ্যের মতোই অস্ত্র হাতে তুলে নেবে, তখন তো এই গোষ্ঠীটির সোনায় সোহাগা। তখন তাদের দমন করার জন্য সরকার উত্তরোত্তর সেনাবাহিনীর ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে বাধ্য হবে। যার অবশ্যম্ভাবী ফল সরকার পাকিস্তানের মতো অনেকটা বাধ্য হয়েই সামরিক বাহিনীর ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। এই পরিকল্পনাটি ছিল প্রধানত মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের। আর এর সমর্থনকারীদের মধ্যে ছিলেন ব্রিগেডিয়ার শওকতসহ কিছু অফিসার। সেনাবাহিনীর প্রধান ও অন্যান্য সিনিয়র অফিসাররাও পরিকল্পনাটি সম্বন্ধে জানতেন। কিন্তু তাঁদের বোঝানো হচ্ছিল যে সেনাবাহিনীর কলেবর বৃদ্ধির জন্যই এ প্রস্তাব।

জিয়াউর রহমান, সিভিল প্রশাসন ও বিভিন্ন মন্ত্রীদেরও এই পরিকল্পনাটি, অর্থাৎ পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনা মোতায়েনের প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে চেষ্টা করছিলেন। সেনাবাহিনীর সহকারী প্রধান হিসেবে জিয়ার তেমন কোনো কাজ ছিল না। তা ছাড়া তাঁর জুনিয়র ব্যক্তি সেনাপ্রধান হওয়ায় তিনি ছিলেন ক্ষুদ্ধ। তাই কোনো কাজও করতেন না। সেনা সদরের অফিসে বসে সমমনা অফিসারদের কাছে তাঁর ক্ষোভ প্রকাশ করতেন এবং আভাসে-ইঙ্গিতে প্রয়োজন হলে তাঁকে সাহায্য করার অনুরোধ জানাতেন। এ ছাড়া প্রায়শই তিনি অফিসের সময় সেক্রেটারিয়েটে ও সন্ধ্যার পর মন্ত্রীদের বাসায় গিয়ে তাঁদের সঙ্গে দেখা করতেন। তাঁর বলার কথা ছিল মন্ত্রীরা যেন দেখেন মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর কোনো অবিচার না হয় এবং সেনাবাহিনীতে জ্যেষ্ঠতা রক্ষা করে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা হয়।

৪) একদিন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কনফারেন্স। বিষয় বিডিআরের অফিসার নিয়োগ-পদ্ধতি। স্বরাষ্ট্রসচিব, সংস্থাপনসচিব, আমি ও সংশ্লিষ্ট অফিসারকে নিয়ে আলোচনা শুরু হলো। হঠাৎ জিয়াউর রহমান তাঁর সহকারী ও একটি প্রকাণ্ড মানচিত্র (গোটানো) নিয়ে সেখানে উপস্থিত। স্বরাষ্ট্রসচিব চেয়ারম্যান। তাঁকে জিজ্ঞেস করেই তিনি সহকারীকে বললেন মানচিত্রটি খুলতে। পার্বত্য চট্টগ্রামের মানচিত্র। সহকারী মানচিত্রটি দেখানোর জন্য ব্যবহৃত লম্বা চৌকা লাঠিটি পর্যন্ত নিয়ে এসেছিলেন। তাই দিয়ে মানচিত্র দেখিয়ে জিয়া অনেকটা বিনা ভূমিকায় পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতিরক্ষার ব্যাপারে নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা দিয়ে বললেন যে সেখানে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা প্রয়োজন। এই বলে তিনি যেমন এসেছিলেন, তেমনি সহসাই চলে গেলেন। তিনি কী বললেন, অন্যদের কথা জানি না, অন্তত আমি ভালো করে বুঝতে পারলাম না। সবাইকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে দেখে মনে হলো কেউই তাঁর হঠাৎ আবির্ভাবের উদ্দেশ্য বুঝতে পারেননি। অনুরূপভাবে আরও একদিন এক কনফারেন্সে জিয়ার আবির্ভাব ও পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতিরক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা বলে অন্তর্ধান ঘটে।

৫) বঙ্গবন্ধু আমার কাছে পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিস্থিতি ও সামরিক বাহিনীর সম্ভাব্য পরিবর্ধন বিষয়ে জানতে চাইলেন। সেখানকার পরিস্থিতি ও তার পশ্চাৎ ইতিহাস আমার জানা ছিল। তা ছাড়া পাকিস্তান আমলে কয়েকবার আমি পার্বত্য চট্টগ্রামের সীমান্ত যুদ্ধেও জড়িত হয়ে পড়েছিলাম। ফলে ওই দুর্গম এলাকার ভৌগলিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অবস্থা সম্বন্ধে আমি অবগত ছিলাম। অতএব, কথা না বাড়িয়েই আমি উত্তর দিলাম, ‘স্যার, আপনি বলছেন পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য একটি ডিভিশন গঠন করার প্রয়োজন আছে কি না। আমার উত্তর স্পষ্ট। পার্বত্য চট্টগ্রাম অত্যন্ত দুর্গম এলাকা। স্থানটি গেরিলাযুদ্ধের জন্য একটি আদর্শ এলাকা। পাহাড়িরা অস্ত্র হাতে নিলে নিঃসন্দেহে তা হবে গেরিলাযুদ্ধ। এই প্রকার যুদ্ধে আমাদের নিয়মিত বাহিনী যুদ্ধ করবে কার সঙ্গে, তারা তো শত্রুই খুঁজে পাবে না। এদিকে আমাদের হতাহতের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলবে। একটি নিয়মিত বাহিনী শেষ হতে খুব বেশী সময় লাগবে না। এলাকাটি যেমন দুর্গম তেমনি বিস্তীর্ণও। এ অবস্থায় সে অঞ্চলে একটি কেন চারটি ভিভিশনের কবর হওয়ার জন্যও যথেষ্ট স্থান আছে। অতএব আপনার গণতান্ত্রিক সরকারের জন্য পথ হবে আলোচনার, সমঝোতার ও সহ-অবস্থানের – অবশ্যই দ্বন্দ্বের নয়।’

৬) আমি তাঁকে আরও বললাম, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে রাস্তাঘাট নেই, উন্নয়ন কর্মকাণ্ড হচ্ছে না। এসব শুরু হোক, পাহাড়িদের সমতলবাসীদের প্রতি অবিশ্বাস ও ভয় কমে আসুক, তারা বাংলা পড়ুক এবং ক্রমে ক্রমে বাঙালি জাতিসত্তার সঙ্গে একীভূত হয়ে যাক। এটাই এ সমস্যার একমাত্র সমাধান। সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে এবং রাতারাতি বাঙালিদের সেখানে অভিবাসন ঘটিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে সমতলবাসী বাঙালির সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভের প্রয়াস হবে অত্যন্ত বিপজ্জনক। কারণ সমস্যাটি রাজনৈতিক।’ বঙ্গবন্ধুকে আমি পুনরায় বুঝিয়ে বললাম যে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাটির আসলে কোনো সামরিক সমাধান নেই।

নোট: উল্লেখ্য, জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধের সময় চট্টগ্রামে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করার পর পার্বত্য চট্টগ্রামে রাঙামাটির বন্দুকভাঙায় এক পাহাড়ির বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন। পরে সেখানে ভারতের মিজো বিদ্রোহী ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর যৌথ আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে খাগড়াছড়ি হয়ে ভারতে চলে যেতে বাধ্য হন। এ সময় তাকে পাহাড়িরা সর্বতোভাবে সহযোগিতা করেছিলেন। অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধে যদি পাহাড়িরা তাকে ও তার অল্প সংখ্যক সৈন্যকে খাদ্য, আশ্রয় ও অন্যান্য সাহায্য না দিতো তাহলে তিনি ও তার বাহিনী ধ্বংসপ্রাপ্ত হতো, এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। অথচ দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই অথবা স্বাধীনতা লাভের প্রাক্কালে পাহাড়িদের পাকিস্তানপন্থী বলে আখ্যা দিয়ে তাদের ওপর পানছড়ি ও কুকিছড়াসহ বিভিন্ন স্থানে গণহত্যা চালানো হয়। অপরদিকে অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে, জিয়া তাকে সাহায্য করা পাহাড়িদের কথা বেমালুম ভুলে যান। শুধু তাই নয়, তাদেরকে জাতিগতভাবে নিশ্চিহ্ন করার জন্য তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামে সামরিকায়ন ও ‘বাঙালায়ন’ -এর উদ্যোগ নেন, যা মেজর জেনারেল এম খলিলুর রহমানের বয়ানে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। (সমাপ্ত)


সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।


সিএইচটি নিউজের ইউটিউব চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব করুন

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More