মুক্তমত
পার্বত্য চুক্তিতে পাহাড়ি নারী প্রসঙ্গ
লেখা: অন্তরা চাকমা
———————
পার্বত্য চট্টগ্রামে একের পর এক পাহাড়ি নারী-শিশু ধর্ষণ ও গণধর্ষণের ঘটনা ঘটে চলেছে এবং তার বিরুদ্ধে প্রবল গণ প্রতিবাদও হচ্ছে। এই প্রেক্ষপটে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে পাহাড়ি নারীদের সম্পর্কে কী বলা হয়েছে সেটা দেখা প্রাসঙ্গিক বলে মনে করছি।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে আঞ্চলিক পরিষদ গঠনের কথা বলা আছে। ২২ সদস্য বিশিষ্ট এই পরিষদে নারীর সদস্য সংখ্যা ৩ জন, যার মধ্যে ২ জন পাহাড়ি। অর্থাৎ আঞ্চলিক পরিষদে পাহাড়ি নারীর প্রতিনিধিত্ব হলো মাত্র ১৩.৩৩ শতাংশ।

অথচ জেএসএস-এর সশস্ত্র সংগ্রাম চলার সময় পাহাড়ি নারীরাই সবচেয়ে বেশি মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়েছিলেন। চুক্তি স্বাক্ষরের মাত্র প্রায় দেড় বছর আগে ১৯৯৬ সালের ১২ জুন অপহৃত হন হিল উইমেন্স ফেডারেশনের নেত্রী কল্পনা চাকমা। অথচ এসব ধর্ষণ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতিকার বিষয়ে চুক্তিতে একটি শব্দও লেখা হয়নি। অপরদিকে অস্ত্র/আত্মসমর্পনের পর সন্তু লারমা সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে কল্পনা চাকমার অপহরণ ঘটনাকে “বিতর্কিত” বলে মন্তব্য করেছিলেন।
পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনী ও সেটলাররাই ধর্ষণসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য দায়ি। অথচ সেটলারদের বিষয়েও পার্বত্য চুক্তি একেবারে নীরব। সন্তু লারমা তথাথিত “স্বাভাবিক জীবনে” ফিরে আসার পর জানিয়েছিলেন সেটলারদেরকে সমতলে ফিরিয়ে নেয়া বিষয়ে সরকারের সাথে তার “মৌখিক চুক্তি” হয়েছে। তবে সরকারের পক্ষে প্রধান আলোচক আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ সেটলারদের প্রত্যাহারের বিষয়ে অলিখিত চুক্তি থাকার দাবি প্রত্যাখ্যান করেন।
এখানে প্রশ্ন হলো, এত বড় একটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কীভাবে মৌখিক বা অলিখিত চুক্তি হতে পারে? একমাত্র রাজনীতি সম্পর্কে অজ্ঞ ও গণ্ডমূর্খদের পক্ষেই এরকম দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজ করা সম্ভব। সেটলার ইস্যুটি আপাতত অমীমাংসিত এবং পরে এ বিষয়ে আরও দেনদরবার হবে – অন্ততঃ এ রকম একটি কথা চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারতো। কিন্তু আমাদের বোকারাম সন্তু বাবুরা করে ফেললেন মৌখিক চুক্তি, যার কোন সাক্ষ্য প্রমাণ নেই।
পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়োজিত সেনাবাহিনী প্রত্যাহারের বিষয়েও রয়েছে শুভঙ্করের মস্ত বড় ফাঁকি। চুক্তির ‘ঘ’ অংশের (পুনর্বাসন, সাধারণ ক্ষমা প্রদর্শন ও অন্যান্য বিষয়াবলী) ১২ নং দফায় চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার ৪৫ দিনের মধ্যে জনসংহতি সমিতির সশস্ত্র সদস্যদের তালিকা ও অস্ত্র-গোলাবারুদের বিবরণী সরকারের কাছে জমা দেয়ার বাধ্যবাধকতার উল্লেখ করা হয়েছে। এরপর ১৩ নং দফায় চুক্তি স্বাক্ষরের ৪৫ দিনের মধ্যে অস্ত্র জমাদানের দিন, তারিখ ও স্থান নির্ধারণের কথা বলা হয়েছে।
অথচ তার বিপরীতে “জনসংহতি সমিতির সদস্যদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সাথে সাথে সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিডিআর, বর্তমানে বিজিবি) ও স্থায়ী সেনানিবাস (তিন জেলায় তিনটি এবং আলীকদম, রুমা ও দীঘিনালা) ব্যতীত সামরিক বাহিনী, আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর সকল অস্থায়ী ক্যাম্প পার্বত্য চট্টগ্রাম হইতে পর্যায়ক্রমে স্থায়ী নিবাসে ফেরত নেওয়ার” কথা বলা হলেও তার কোন সময় সীমা নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি। (ঘ অংশের ১৭(ক)) এতেই চুক্তির অসারতা ও শুভঙ্করের ফাঁকি স্পষ্ট হয়ে গেছে।

তাই এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়, ধর্ষণসহ বিভিন্ন মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচার এবং সেটলার ও সেনা প্রত্যাহারের বিষয়ে সুষ্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট কোন বক্তব্য চুক্তিতে না থাকায় পাহাড়ি নারীদের ওপর সেটলার ও সেনাবাহিনীর যৌন হামলার ঘটনা থামেছে না। স্বায়ত্তশাসন, ভূমি অধিকার, নারী অধিকার ও মানবাধিকার, সেনা-সেটলার প্রত্যাহার – এগুলো হলো পাহাড়িদের মৌলিক ইস্যু। অথচ এগুলোর কোনটিই চুক্তিতে যথার্থভাবে মীমাংসা করা হয়নি।
পাহাড়ি নারীদের ইস্যুটিসহ জনগণের মৌলিক দাবিগুলোর কোনটি পূরণ না হলেও, চুক্তিতে জেএসএস সদস্যদের স্বার্থকে ভালভাবেই প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। অস্ত্র জমা দিয়ে “স্বাভাবিক জীবনে” ফিরে আসার পর জেএসএস সদস্যরা সরকারের কাছ থেকে কী কী সুযোগ-সুবিধা পাবেন সে সম্পর্কে বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে চুক্তির ‘ঘ’ অংশের ১৬ নং দফার ৭টি উপদফায়। এই সুযোগ-সুবিধাগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘সাধারণ ক্ষমা’, নগদ ৫০ হাজার টাকা, মামলা-হুলিয়া প্রত্যাহার, জেএসএস সদস্য হওয়ার কারণে গ্রেফতার না করা, সুদসহ ঋণ মওকুফ, বাগান-বাগিচা করার জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ঋণ পাওয়া, এবং জেএসএস সদস্যদের সন্তানদের শিক্ষা লাভের সুযোগ ও বিদেশী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রাপ্ত সনদ বৈধ বলে ঘোষণা।
এক কথায়, ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চুক্তিতে জেএসএস সদস্যরা কিছু বৈষয়িক ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পেলেও, পাহাড়ি নারীরা কিংবা সাধারণ জনগণ কিছুই পায়নি। এ কারণে পাহাড়ি নারী ধর্ষণ ও যৌন সহিংসতা থামছে না। কিন্তু তারপরও জেএসএস ও সরকার জুম্ম জনগণকে চুক্তির প্রতি মোহাচ্ছন্ন করে রাখতে চাইছে। কারণ এতে তাদের লাভ। জনগণকে চিরকাল অধিকার বঞ্চিত করে রাখা যাবে।
কিন্তু না, জনগণ সত্য জেনেছে। তারা আর চুক্তি নিয়ে পড়ে থাকবে না। ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আন্দোলনের জন্য তারা চুক্তি নামক অন্ধকূপ থেকে বেরিয়ে এসেছে। সুতরাং সাধু সাবধান!
(৮ অক্টোবর ২০২৫)
[মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখাগুলো লেখক/লেখকদের নিজস্ব মতামতই প্রতিফলিত]
সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।