মতামত

পাহাড়িদের জন্য কেন কোটা প্রয়োজন?

0

থুইক্য চিং মারমা ও সোহেল চাকমা


বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসনের ওয়েবসাইটে কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের তালিকা দেখে অবাক হতে হল। এই তালিকা সরকারী প্রশাসনে বা বলতে গেলে পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামে একটি বিশেষ জাতিগোষ্ঠীর একক আধিপত্যের চিত্রকেই প্রতিফলিত করে। পাহাড়িরা যে নিজ ভূমে পরবাসী এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রশাসনে যে তাদের কোন ভূমিকা নেই, এই তালিকাগুলোতে সেটা জ্বলজ্বল করে ফুটে উঠেছে।

ওয়েবসাইটে বান্দরবান জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের যে ২০ জন কর্মকর্তার তালিকা দেয়া হয়েছে, সেখানে কোন পাহাড়ির অস্তিত্ব নেই। তার মানে বান্দরবান জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের শতভাগ কর্মকর্তা হলেন অপাহাড়ি বা বাঙালি। রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের চিত্রও একই। এখানেও যে ২০ জন কর্মকর্তার নাম উল্লেখ করা হয়েছে, তারা সবাই বাঙালি। কেবল খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ২০ জন কর্মকর্তার মধ্যে একজন পাহাড়ি রয়েছেন।

১ম ও ২য় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে সংখ্যালঘু জাতিসত্তাদের জন্য ৫% কোটা পুনর্বহালের দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ সমাবেশ করেন জুম্ম শিক্ষার্থীরা। ছবি: ১২ জুলাই ২০২৪


এবার কর্মচারীদের প্রসঙ্গে আসা যাক। একই ওয়েবসাইটে বান্দরবান জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ২০ জন কর্মচারীর তালিকা দেয়া হয়েছে। তার মধ্যে বাঙালি ১৪ জন বা ৭০% এবং পাহাড়ি ৬ জন বা ৩০%। খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসকের অফিসের কর্মচারীদের তালিকার চিত্রও একই। অন্যদিকে রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ২০ জন কর্মচারীর মধ্যে ১২ জন বাঙালি (৬০%) এবং ৮ জন পাহাড়ি (৪০)। অর্থাৎ এখানেও অপাড়িদের ব্যাপক আধিপত্য।

নিচে দু’টি সরণিতে তিন জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের পাহাড়ি-বাঙালির সংখ্যা ও অনুপাত দেখানো হল।

কর্মকর্তা

জেলাবাঙালিশতকরা হারপাহাড়িশতকরা হার
বান্দরবান২০ জন১০০%০ জন০%
রাঙ্গামাটি২০ জন১০০%০ জন০%
খাগড়াছড়ি১৯ জন৯৫%১ জন৫%
জেলাবাঙালিশতকরা হারপাহাড়িশতকরা হার
বান্দরবান১৪৭০%৩০%
রাঙ্গামাটি১২৬০%৪০%
খাগড়াছড়ি১৪৭০%৩০%

সরকারী চাকুরীতে পাহাড়িদের প্রতিনিধিত্বের চিত্র যদি এই হয়, তাহলে তাদের জন্য কোটার প্রয়োজনীয়তা ও যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করার কোন দরকার পড়ে কি? আসলে এই চিত্র আরও অনেক কিছু বলে দেয়। বৃটিশ আমলেও পাহাড়িদের এমন দুরাবস্থা ছিল না। সে সময় প্রশাসনে পাহাড়িদের কিছু মাত্রায় হলেও অংশগ্রহণ ছিল। বৃটিশ প্রবর্তিত ফ্রন্টিয়ার পুলিশ বাহিনীতে সর্বোচ্চ পদ বাদে বাকি সকল পদ পাহাড়িদের মধ্য থেকে নিয়োগ করা হতো। বিচার ও অর্থ প্রশাসনেও রাজা, হেডম্যান ও কার্বারীদের অংশগ্রহণ ছিল।

অথচ স্বাধীন বাংলাদেশ আমলে নিজ মাতৃভূমি পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িদের নিজস্ব প্রশাসনে নিজেদের কোন ভূমিকা ও অংশগ্রহণ নেই। উপরে কেবল তিন জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের চিত্র দেখানো হয়েছে। উপজেলা প্রশাসনেও একই অবস্থা। তিন জেলার ২৬টি উপজেলায় একজন ইউএনও পাহাড়িদের মধ্য থেকে নিয়োগ করা হয়নি। বিচার ও পুলিশ বিভাগেও একই চিত্র। এক কথায়, প্রশাসনের সর্বস্তরে এককভাবে বাঙালিদের প্রাধান্য ও আধিপত্য। বাঙালিরা শাসক, পাহাড়িরা শাসিত।

অস্বীকার করার উপায়ে নেই যে, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠীগুলো শিক্ষা চাকুরিসহ এখনও অনেক দিক দিয়ে পশ্চাদপদ। এর অনেক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ভৌগলিক ও ঐতিহাসিক কারণ রয়েছে। সে সব এখানে ব্যাখ্যার কোন অবকাশ নেই। তবে এ কথা বলার উদ্দেশ্য হলো এই যে, পাহাড়িদের এই পশ্চাদপদতা ঘুচাতে হলে, তাদেরকে সারা দেশের সাথে উন্নয়নের একই কাতারে নিয়ে আসতে হলে শিক্ষা ও চাকুরীসহ অন্যান্য কিছু ক্ষেত্রে কোটা ব্যবস্থার কোন বিকল্প দেখা যায় না।

যে পাহাড়ি শিক্ষার্থীকে স্কুলে যাওয়া-আসা করতে প্রতিদিন ৪-৫ মাইল পথ হাঁটতে হয়, যে স্কুলে সে মানসম্মত শিক্ষা পায় না, যার কাছে বাংলা ভাষা বিদেশী ভাষার মতো দুর্বোধ্য, যার বাবা-মা আর্থিক দৈন্যদশায় জর্জরিত, সে কীভাবে ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের সাথে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি ও চাকুরীর পরীক্ষায় প্রতিযোগিতা করে টিকতে পারবে? এক্ষেত্রে দু’একজন ব্যতিক্রম থাকতে পারে – ব্যতিক্রম সব ক্ষেত্রে দেখা যায়। কিন্তু সবাই ড. আম্বেদকরের মতো হতে পারে না।

যদি কোটা ব্যবস্থা না থাকে, তাহলে শুধু পাহাড়িরা কেন, বাংলাদেশের আরও অনেক অঞ্চলের শিক্ষার্থীরাও তথাকথিত মেধার দৌঁড়ে পাল্লা দিতে সক্ষম হবে কীনা সন্দেহ রয়েছে। তখন দেশের হাতে গোনা কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এবং বিশেষত ঢাকার দু’একটি কলেজের শিক্ষার্থীদের মেধার একচ্ছত্র আধিপত্যে বাকিরা কোনঠাসা ও অসহায় হয়ে পড়তে বাধ্য।

২০১৮ সালে শিক্ষার্থীরা যখন প্রথম কোটা সংস্কার আন্দোলনে করেছিলেন, তখন তারাও পাহাড়িদের জন্য কোটা ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে থাকবেন। কারণ তারা পাহাড়িদের জন্য বরাদ্দ কোটার সংস্কার চাননি, বাদ দেয়ার দাবি তো তোলেনই নি। বর্তমানেও যে কোটা সংস্কার আন্দোলন চলছে, তার নিশানাও ধরে নেয়া যায় পাহাড়ি কোটার বিরুদ্ধে নয়।

কিন্তু তারপরও সরকার ২০১৮ সালে পুরো কোটা ব্যবস্থাই বাতিল করে দেয়। এর ফলে সবচেয়ে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তারা হলো প্রান্তিক অবস্থানে থাকা জাতিগোষ্ঠীর জনগণ। সরকারী চাকুরীতে প্রবেশের দ্বার তাদের জন্য একেবারে সংকুচিত হয়ে যায়।

আমাদের মতো দেশে সব জাতিসত্তার, সব সম্প্রদায়ের, সব অঞ্চলের বিকাশ সমান নয়। এখানে কোন কোন জাতিসত্তা বা সম্প্রদায় বা অঞ্চল অন্যান্য জাতিসত্তা, সম্প্রদায় ও অঞ্চল থেকে শিক্ষা, চাকুরী, ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতি ইত্যাদি বিভিন্ন উন্নয়ন সূচকে তুলনামূলকভাবে পিছনে পড়ে আছে। কাজেই রাষ্ট্রীয় পরিচালনার দায়িত্বে যারা নিয়োজিত তাদের কাজ হলো দেশের এই পশ্চাদপদ জাতিগোষ্ঠী, সম্প্রদায় ও অঞ্চলের উন্নয়নের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা, যার মধ্যে শিক্ষা ও চাকুরীর ক্ষেত্রে কোটা ব্যবস্থা হলো একটি।

আমরা মনে করি শিক্ষা ও সরকারী চাকুরীর ক্ষেত্রে পাহাড়ি শিক্ষার্থীদের জন্য সাধারণভাবে ৫% কোটা পুনর্বহাল জরুরী। এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রশাসনের সর্বস্তরে পাহাড়িদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ এখন সময়ের দাবি। এজন্য কেবল তিন পার্বত্য জেলায় সকল সরকারী, আধাসরকারী ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের চাকুরীতে নিয়োগের ক্ষেত্রে পাহাড়িদের জন্য ৮০% কোটা বরাদ্দ রাখতে হবে।

অধিকন্তু জাতিসত্তাগুলোর মধ্যে সমতা নিয়ে আসার জন্য কতিপয় বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার। কারণ পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িরা সাধারণভাবে পশ্চাদপদ হলেও, পাহাড়িদের মধ্যেও ম্রো, খুমি, খিয়াং, চাক ও বমরা শিক্ষা ও চাকুরীসহ অনেক দিক দিয়ে মারমা, ত্রিপুরা ও চাকমাদের চেয়ে আরও বেশি পশ্চাদপদ। অর্থাৎ সারা দেশের প্রেক্ষাপটে তারা দ্বিগুণ পশ্চাদপদ বা অনগ্রসর। তাই তাদের জন্য বিশেষ কোটার পাশাপাশি তাদের আর্থিক উন্নয়নের দিকেও সরকারের মনোযোগ দেয়া দরকার। যে ম্রো শিক্ষার্থী এখনও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আবেদন করার যোগ্যতাই অর্জন করতে পারেনি, তার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির কোটার চাইতে কলেজে পড়ার জন্য সরকারী স্টাইপেন্ড বা শিক্ষা বৃত্তি অধিক উপযোগি ও জরুরী, যাতে সে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য আবেদনের যোগ্যতা অর্জন করতে পারে।#

 * লেখাটি পহর চাঙমা’র ফেসবুক থেকে সংগৃহিত।



This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More