পাহাড়ে শিক্ষার্থীদের গ্রাফিতিতে ফুটে উঠেছে অন্যায়, শোষণ-বঞ্চনা ও নিপীড়নের চিত্র

শিক্ষার্থীদের আঁকা একটি গ্রাফিতি, যাতে লেখা ‘পাহাড় বন্দী সেনার হাতে’
বিশেষ প্রতিবেদক, সিএইচটি নিউজ
বুধবার, ১৪ আগস্ট ২০২৪
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে গণঅভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের পতন ঘটে গত ৫ আগস্ট ২০২৪ তারিখে। পরবর্তীতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা দেশের নানা অসঙ্গতি, বৈষম্য ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে হাতে তুলে নেয় রং তুলি। তারা দেয়ালে দেয়ালে গ্রাফিতি, ক্যালিগ্রাফি আঁকার কর্মসূচি গ্রহণ করেন। এই কর্মসূচিতে যুক্ত হয় পাহাড়ের শিক্ষার্থীরাও। তারা গ্রাফিতিতে ফুটিয়ে তোলেন পাহাড়ে অন্যায়, শোষণ-বঞ্চনা, আগ্রাসন ও নিপীড়ন-নির্যাতনের চিত্র। কল্পনা চাকমার সন্ধান দাবি করেন।

আর নয় শোষণ নিপীড়ন, এবার পাহাড়েও স্বাধীনতা চাই
গত ১০ আগস্ট খাগড়াছড়ি থেকে পাহাড়ে গ্রাফিতি আঁকা শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। ওইদিন শিক্ষার্থীদের আঁকা কল্পনা চাকমা’র একটি গ্রাফিতি কে বা কারা মুছে দিলে তা নিয়ে দেখা দেয় প্রতিবাদ। শিক্ষার্থীরা তা কোনভাবেই মেনে নিতে পারেনি। এর প্রতিবাদে পরদিন (১১ আগস্ট) পাহাড় ও সমতলে একযোগে আঁকা হয় কল্পনা চাকমা’র গ্রাফিতি।

খাগড়াছড়ি শহরে শিক্ষার্থীরা আঁকের কল্পনা চাকমা’র এই গ্রাফিতিটি। ১০ আগস্ট ২০২৪

কল্পনা চাকমাকে নিয়ে আঁকা গ্রাফিতিটি মুছে দেওয়া হয়। ১০ আগস্ট ২০২৪




এরপর ১২ আগস্ট শিক্ষার্থীরা খাগড়াছড়ি সরকারি কলেজ ও চেঙ্গী স্কোয়ার এলাকায় কল্পনা চাকমার গ্রাফিতিসহ বিভিন্ন গ্রাফিতি আঁকতে গেলে সেনাবাহিনীর খাগড়াছড়ি সদর জোন কমাণ্ডার লে. কর্নেল আবুল হাসনাত-এর নেতৃত্বে সেনাবাহিনী, বিজিবি ও আনসার সদস্যরা শিক্ষার্থীদের বাধা দেয়, হামলা ও লাঠিচার্জ করে। এ সময় সেনারা প্রণয় চাকমা নামে এক শিক্ষার্থীকে তুলে নিয়ে নির্যাতন করে। যদিও এর আগের দিন জোন কমাণ্ডার নিজেই ’কল্পনা চাকমার ছবিসহ যা ইচ্ছে তা আঁকা যাবে, কোন অসুবিধা নেই’ বলে শিক্ষার্থীদের সম্মুখে এসে বলেছিলেন।
গ্রাফিতি অঙ্কনে বাধা ও শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে ওই দিনই শিক্ষার্থীরা জড়ো হয়ে হামলার স্থানে পুনরায় গ্রাফিতি আকেঁন এবং খাগড়াছড়ি শহরে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। তারা মিছিল নিয়ে পুরো শহর প্রদক্ষিণ করে শাপলা চত্ত্বরের মুক্তমঞ্চে সমাবেশ করেন এবং আটক ও নিপীড়নের শিকার হয়ে মুক্ত হওয়া শিক্ষার্থী প্রণয় চাকমাকে ফুল দিয়ে সংবর্ধনা দেন। তারা পাহাড় থেকে সেনা শাসন প্রত্যাহারসহ নিপীড়ন-নির্যাতন বন্ধের দাবি জানান। প্রতিবাদ হয়েছে রাঙামাটি এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও।

গ্রাফিতি আঁকতে বাধা ও সেনা হামলার প্রতিবাদে খাগড়াছড়িতে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল করেন।

খাগড়াছড়িতে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবেশ করেছেন শিক্ষার্থীরা।
১৩ আগস্ট পাহাড় ও সমতলের বিভিন্ন জায়গায় শিক্ষার্থীরা একযোগে গ্রাফিতি আঁকার কর্মসূচি পালন করেন। এদিন রাঙামাটির বাঘাইছড়িতে সেটলার বাঙালিরা গ্রাফিতি আঁকতে শিক্ষার্থীদের বাধা প্রদান করে। একইভাবে খাগড়াছড়ির মহালছড়িতে বাধা দেয় সেনাবাহিনী। রাঙামাটি শহরে কল্পনা চাকমা’র গ্রাফিতি কালো রং দিয়ে বিকৃত করা হয়।






যশোরের সরকারি এম এম কলেজে এই গ্রাফিতি আঁকা হয়।

ঠাকুরগাঁওতে আঁকা গ্রাফিতি
খাগড়াছড়িতে দ্বিতীয় দিনের মতো বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। তারা খাগড়াছড়ি কলেজ হয়ে মিছিল নিয়ে শাপলা চত্বর ঘুরে এসে চেঙ্গী স্কোয়ারে সমাবেশ করে। মিছিলে তারা পাহাড় থেকে সেনা শাসন তুলে নেয়ার দাবিতে শ্লোগান দেন।

খাগড়াছড়িতে দ্বিতীয় দিনের মতো বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা
কল্পনা চাকমার সন্ধান দাবিতে প্রতিবাদ হয়েছে বান্দরবানে। তারা জোরালোভাবে শ্লোগান তোলেন ‘কল্পনা চাকমা কই আছে, ফেরদৌস তুই খবর দে’ বলে।
শিক্ষার্থীরা তাদের গ্রাফিতি ও দেওয়াল লিখনে পাহাড়ে অন্যায়-অবিচার, বৈষম্য, ভূমি আগ্রাসন ও নিপীড়ন-নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরেছে। রং, তুলির মাধ্যমে তারা পাহাড় থেকে সেনা শাসন প্রত্যাহার ও কল্পনা চাকমার সন্ধানসহ নিপীড়ন-নির্যাতন বন্ধের দাবি জানিয়েছে। কবে পাহাড় মুক্ত হবে সে প্রশ্ন তুলেছে। একই সাথে তারা পাহাড়িদের জাতীয় ঐক্যের আহ্বানও তুলে ধরেছে।
সমতলের অনেকেও পাহাড়ের শিক্ষার্থীদের সাথে সংহতি জানিয়েছেন, এঁকেছেন কল্পনা চাকমার গ্রাফিতিসহ নানা চিত্র।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের পাশে এই গ্রাফিতি অঙ্কন করেছেন Nur-a Jannat ও তার বন্ধুরা।

সমতলে আঁকা একটি গ্রাফিতি
তবে, লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো- সমতলের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষার্থীরা নিজেদের মতো করে গ্রাফিতি অঙ্কন করতে পারলেও পাহাড়ে বাধা প্রাপ্ত হয়েছেন। খোদ সেনাবাহিনী কল্পনা চাকমার গ্রাফিতি অঙ্কনে বাধা দিয়েছে, শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা-লাঠিচার্জ করেছে, ধরে নিয়ে নির্যাতন করেছে, রঙের কৌটা লাথি মেরে ফেলে দিয়েছে। এতেই প্রমাণ হয়, কল্পনা চাকমা’র শক্তি। দীর্ঘ ২৮ বছর ধরে তাকে অপহরণ করে গুম করে রাখা হলেও এখনো তারা কল্পনা চাকমাকে কতটা ভয় পায় সেটা তাঁর গ্রাফিতি আঁকতে বাধা প্রদান ও গ্রাফিতি মুছে দেয়ার মাধ্যমেই প্রমাণিত হয়েছে।
গ্রাফিতি অঙ্কন কর্মসূচি পাহাড়ের শিক্ষার্থীদের অনেকটা কাছাকাছি নিয়ে এসেছে। তারা একই ভাষায় কথা বলেছে গ্রাফিতির মাধ্যমে।

শিক্ষার্থীরা ঐক্যের আহ্বান জানিয়ে এঁকেছেন গ্রাফিতি। ছবি: খাগড়াছড়ি
ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের পতনের আন্দোলনে যে শিক্ষার্থীরা নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদের বলা হচ্ছে জেনারেশন-জি বা জেন-জি। পাহাড়ের এই প্রজন্মও (জেন-জি) একযোগে বিভিন্ন স্থানে গ্রাফিতি অঙ্কন ও প্রতিবাদের মাধ্যমে দেখিয়েছে তারা পাহাড়ে একটা পরিবর্তন চায়, সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা চায়, স্বাভাবিক জীবন-যাপন করতে চায়, নিপীড়নমুক্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম চায়। তারা আর সেনা শাসন-কর্তৃত্ব চায় না। তারা ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত চায় না, ঐক্য চায়। কাজেই, দেশের সরকার-শাসকগোষ্ঠি এবং পাহাড়ের রাজনৈতিক দলগুলোকেও এই প্রজন্মের ভাষা ও আশা-আকাঙ্ক্ষা বুঝে সঠিক পদক্ষেপ নিতে হবে।
সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।