গুইমারায় তিন বীর শহীদের নামে সড়কের স্মৃতিফলক উন্মোচন
পাহাড়ে সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি না হলে জনগণ হাসিনার নির্বাচনের মতো ড. ইউনূসের নির্বাচনও বয়কট করবে: রীনা দেওয়ান

গুইমারা প্রতিনিধি, সিএইচটি নিউজ
মঙ্গলবার, ৯ ডিসেম্বর ২০২৫
‘পাহাড়ে সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি না হলে জনগণ ফ্যাসিস্ট হাসিনার ডামি নির্বাচনের মতো ড. ইউনূসের ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনও বয়কট করতে পারে’ বলে হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন রীনা দেওয়ান।
আজ মঙ্গলবার (৯ ডিসেম্বর ২০২৫) খাগড়াছড়ির গুইমারায় শহীদ স্মৃতি সংরক্ষণ সংসদের আয়োজনে তিন বীর শহীদ আখ্র মারমা, আথুইপ্রু মারমা ও থৈইচিং মারমার নামে সড়কের স্মৃতিফলক উন্মোচন ও বৃক্ষ রোপন অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্য প্রদানকালে তিনি এই কথা বলেন।
রীনা দেওয়ান হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাবেক কেন্দ্রীয় নেত্রী ও শহীদ মিঠুন চাকমার সহধর্মিনী।
সকাল ১০টায় গুইমারা রামেসু বাজার সড়কটি তিন শহীদের নামে স্মৃতিফলক উন্মোচন করেন শহীদ পরিবারের পক্ষে শহীদ থৈইচিং মারমার মা দানুপ্রু মারমা, শহীদ আখ্র মারমার মা ক্রাসং মারমা ও শহীদ আথুইপ্রু মারমার সহধর্মিনী নুনুমা মারমা। স্মৃতিফলক উন্মোচনের পর তারা সড়কের পাশে ২০টি হরিতকি ও কৃষ্ণচুড়া গাছের চারা রোপন করেন।


অনুষ্ঠানে সংহতি জানিয়ে উপস্থিত থেকে অন্যান্যের আরো বক্তব্য রাখেন হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দীয় সাধারণ সম্পাদক রিতা চাকমা, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের খাগড়াছড়ি জেলা কমিটির সহসভাপতি অনিমেষ চাকমা ও গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের কেন্দ্রীয় সদস্য সুইচিং মারমা। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সদস্য অংহ্লাচিং মারমা।
গুইমারাসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে অনুষ্ঠানে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার দেড় সহস্রাধিক লোক অংশগ্রহণ করেন।
অনুষ্ঠানের ব্যানার শ্লোগান ছিল, “জীবন মৃত্যু, পায়ের ভৃত্য, চিত্ত ভাবনাহীন”, “শহীদের রক্তস্নানে শুচিত পাহাড় অধিকার প্রতিষ্ঠায় জ্বলে উঠবে নব উদ্যমে।”

অনুষ্ঠানে রীনা দেওয়ান বলেন, “শুধু গুইমারায় নয়, পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গায় আমাদের পাহাড়িদের ওপর নিপীড়ন নির্যাতন চলছে। খাগড়াছড়ির সিঙ্গিনালায় ৮ম শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়েকে ধর্ষণের বিচারের দাবিতে যে ভাই বোনেরা মাঠে নেমেছিল তাদের ওপর সেনাবাহিনী গুলি করে তিন নিরীহ জনগণকে হত্যা করেছে। এখনো অনেকে গুলি খেয়ে, মার খেয়ে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। আমাদের পাহাড়িদের ওপর যে নিপীড়ন-নির্যাতন করা হচ্ছে, আমাদের নারীদের ওপর যে অন্যায় করা হচ্ছে আমি তার তীব্র নিন্দা জানাই।”
তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এখানকার নিপীড়ন-নির্যাতনের সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনী আছে বলেই এখানে সেটলার বাঙালিরা আমাদের অন্যায় অবিচার করে যাচ্ছে।
আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিষয়ে রীনা বলেন, “ড. ইউনূস যদি সুষ্ঠু নির্বাচন চান এবং নির্বাচনে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশের সকল দল ও জনগণের অংশগ্রহণ যদি তিনি চান তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রামে কেন এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি করা হচ্ছে।”
তিনি হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেন, “হাসিনার আমলে আমরা তিন পার্বত্য জেলায় নির্বাচন দেখেছি। পাহাড়ের মানুষ কীভাবে ভোট কেন্দ্র শূন্য করে দিয়েছে তা আমরা দেখেছি। ড. ইউনূস যদি সেভাবে ভোট বয়কট না চান তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রামে যে সেনাশাসন তা তুলে নিতে হবে।”
কোন সরকারই পার্বত্য চট্টগ্রামে দমন-পীড়ন বন্ধ করেনি উল্লেখ করে রীনা দেওয়ান বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি, বিএনপি, আওয়ামী লীগ, তত্ত্বাবধায়ক কিংবা অন্তর্বর্তী সরকার থেকে শুরু করে যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক না কেন পার্বত্য চট্টগ্রামে জনগণের ওপর নিপীড়ন-নির্যাতন, দমন-পীড়ন কখনো বন্ধ হয়নি এবং ভবিষ্যতেও হবে বলে মনে করি না। তাই কারোর ভরসার না থেকে আন্দোলনের মাধ্যমে নিজেদেরকে রক্ষা করতে হবে।”

হিল উইমেন্স ফেডারেশনের নেত্রী রিতা চাকমা বলেন, এই রামেসু বাজারে সেনাবাহিনীর গুলিতে তিন ভাই শহীদ হয়েছেন। খাগড়াছড়ির সিঙ্গিনালায় মারমা কিশোরীকে গণধর্ষণের প্রতিবাদে জুম্ম ছাত্র জনতার আন্দোলন দমনের জন্য পরিকল্পিতভাবে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছিল। কিন্তু খাগড়াছড়িতে ১৪৪ ধারা জারির মধ্যে সেটলার বাঙালিরা পাহাড়িদের ওপর হামলা চালিয়ে বেশ কয়েকজনকে গুরুতর জখম করে।
গত ২৮ সেপ্টেম্বর বোনের ধর্ষণের বিচার চাইতে গিয়ে সড়ক অবরোধ পালনকালে গুইমারায় সেনা-সেটলার হামলা চালিয়ে তিন ভাইকে হত্যা করেছে। এই হত্যায় জড়িতদের এখনো গ্রেফতার করা হয়নি।
তিনি বলেন, পাহাড়ের নারীরা প্রতিনিয়ত ধর্ষণ, নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গেলে সেনাবাহিনী গুলি চালায়, সেটলাররা হামলা করে।

রামেসু বাজারে হামলা-হত্যার ঘটনাকে পরিকল্পিত উল্লেখ করে রিতা চাকমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িদের ধ্বংস করার জন্য এ ধরনের হামলা চালানো হচ্ছে। চব্বিশের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর আমরা ভেবেছিলাম পাহাড়ের পরিস্থিতি কিছুটা হলেও পরিবর্তন হবে, নারীরা নিরাপদে থাকতে পারবে, কিন্তু তা হয়নি।
২০২৪ সালের ১৯-২০ সেপ্টেম্বর দীঘিনালা, খাগড়াছড়ি সদর ও রাঙামাটিতে পাহাড়িদের ওপর সাম্প্রদায়িক হামলা চালিয়ে ৪ জনকে হত্যা করা হয়েছিল। সেনাবাহিনী পাহাড়ে নিরাপত্তার নামে অন্যায়, অবিচার, হত্যা, ধর্ষণ, ঘরবাড়ি তল্লাশি চালাচ্ছে। তারা অপরাধীদের গ্রেফতার না করে নিরীহ ছাত্র-যুবককের গুলি করে হত্যা করছে। এই নিপীড়নের বিচার একদিন হবেই।
রিতা চাকমা বলেন, পাহাড়ের মানুষ মুঘল, ব্রিটিশ আমল থেকে লড়াই করে এখনো টিকে রয়েছে। অন্যায় অত্যাচার চালিয়ে তাদেরকে দমন করা যাবে না। এই পাহাড় আমাদের, এই পাহাড় বাঙালি সেটলারদের নয়।
‘যে সেনাবাহিনী নারী ধর্ষণের ঘটনাকে স্বাভাবিক’ বলে সে সেনাবাহিনী পাহাড়ে নিয়োজিত থাকার কোন প্রয়োজন নেই মন্তব্য করে তিনি বলেন, সেনাবাহিনী ও সেটলার বাঙালিরা এখানে না আসলে পাহাড়ে শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি বিরাজ করতো।
তিনি বলেন, “আজকে যে এই সড়কের স্মৃতিফলক উন্মোচন করা হয়েছে এটা কোন উন্নয়নের জন্য নয়, এটি হচ্ছে যুগে যুগে বীর শহীদদের স্মরণ রাখার জন্য।”
তিনি রামেসু বাজারে হামলায় জড়িত সেনা সেটলারদের চিহ্নিত করে গ্রেফতারের দাবি জানান।
যুবনেতা সুইচিং মারমা নিজস্ব মাতৃভাষায় বক্তব্য প্রদান করেন। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধে মারমাসহ পাহাড়িরা অংশগ্রহণ করেছিল। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাদের স্বাধীনতা দেয়নি শেখ মুজিব সরকার। বাঙালি জাতীয়তাবাদ চাপিয়ে দিলে এম এন লারমা কর্তৃক আন্দোলন গড়ে উঠে। বর্তমানে ইউপিডিএফের নেতৃত্বে আন্দোলন চলমান রযেছে।
তিনি ১৯৮০ সালে কাউখালীর কলমপতি গণহত্যাসহ পাহাড়ে সংঘটিত গণহত্যার বিচার হয়নি উল্লেখ করে বলেন, ‘নির্বাচন আসলে মারমাসহ পাহাড়িরা কখনো ধানের শীষ, কখনো নৌকা নিয়ে লাফালাফি করে। কিন্তু নৌকা, ধানের শীষ কি আমাদের অধিকার দিয়েছে? আগামী নির্বাচনে এ বিষয়ে বিবেক দিয়ে বিবেচনা করবেন।’
তিন বলেন, ‘আমরা তথাকথিত উন্নয়ন নয়, আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামে নিজেদের মাটিতে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করতে চাই।’

ছাত্রনেতা অনিমেষ চাকমা বলেন, গুইমারা রামেসু বাজারে হামলা-হত্যাকাণ্ডে সেনা-সেটলাররা প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিল। পূর্ব পরিকল্পিতভাবে সেনাবাহিনী এই হামলা চালিয়েছিল। হামলার সময় সেটলার বাঙালিদের লেলিয়ে দিয়ে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বসতবাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও সেনাবাহিনী পাহাড়ি ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি চালায়। এতে তিন পাহাড়ি যুবক গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান।
তিনি আরো বলেন, চব্বিশের জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সারাদেশ থেকে ফ্যাসিবাদী হাসিনার দোসারদের পতন হলেও পাহাড়ের হাসিনার দোসররা এখনো রয়ে গেছে। ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার পাহাড়ে সেনাবাহিনীর দুঃশাসন বন্ধ করতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। খাগড়াছড়িতে মারমা কিশোরীকে ধর্ষণ ও গুইমারার রামেসু বাজারে সাম্প্রদায়িক হামলা-হত্যাকাণ্ডের বিচার করতে পারেনি এই সরকার।
অনিমেষ চাকমা বলেন, এই রাষ্ট্র কিংবা ইউনূস সরকার পাহাড়ের মানুষকে কখনো ভালোবাসেনি। বরং সংঘাতময় পরিস্থিতি জিইয়ে রেখে তারা পাহাড়েকে বিছিন্ন করে রেখেছে। ইউনূস সরকার দায়িত্ব গ্রহণের কয়েকদিনের মধ্যেই পাহাড়ে বড় সাম্প্রদায়িক হামলা ও হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। দীঘিনালা, খাগড়াছড়ি সদর ও রাঙামাটিতে চার জনকে হত্যা করা হলেও ইউনূস সরকার এ ঘটনার বিচারে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।
সেনাশাসনই পাহড়ে অশান্তির মূল উল্লেখ করে তিনি বলেন, জুলাই গনঅভ্যুত্থানে নিপীড়নমুক্ত ও বৈষমস্যহীন বাংলাদেশের কথা বলা হলেও পাহাড়ে সেনাশাসন জারি রেখে নিপীড়ন-নির্যাতনের মাত্রা বাড়ানো হয়েছে। তিনি অবিলম্বে রামেসু বাজারে হামলা, হত্যাকাণ্ড ও অগ্নিসংযোগে জড়িত সেনা-সেটলারদের চিহ্নিত করে গ্রেফতার ও বিচারের জোর দাবি জানান।
অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারীগণ বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন করেন। প্রখর রৌদ্রের মধ্যে লোকজন মনযোগ সহকারে বক্তাদের বক্তব্য শোনেন ও শ্লোগান দেন।
বক্তব্যদান শেষে প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এ সময় অনুষ্ঠানস্থলে কানায় কানায় পুর্ণ হয়ে ওঠে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে রামেসু বাজারে সেনাবাহিনীর গুলিবর্ষণের দৃশ্যসহ নানা প্রতিবাদী চিত্র ফুটিয়ে তোলেন শিল্পীরা।


সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।
