পাহাড়িদের মধ্যে ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত জিইয়ে রাখতে কতিপয় বাম নেতার ভূমিকা

0

রিকো চাকমা, প্রাক্তন সভাপতি, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ

বাংলাদেশের কতিপয় বাম নেতার ভূমিকা পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িদের মধ্যে ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত জিইয়ে রাখতে সহায়ক হচ্ছেএরা আদর্শচ্যুত সরকারের দালাল সন্তু লারমাকে সমর্থন দানের মাধ্যমে পাহাড়ে তার খুনের রাজনীতি জিইয়ে রাখতে সহায়তা দিচ্ছে বললে অত্যুক্তি হবে না। গত ২০ মে রাঙামাটিতে অনুষ্ঠিত দুই নাম্বারীদের (সন্তু গ্রুপের নেতৃত্বাধীন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ। জেএসএস এর ছাত্র সংগঠনটির নাম পাহাড়ি ছাত্র সমিতি; সেটা তারা মাঠে নামাতে পারেনি।) প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচীতে অংশ নেন গণফোরামের প্রেসিডিয়াম সদস্য পংকজ ভট্টাচার্য, সিপিবির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হায়দার আকবর খান রনো, ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক এস এম শুভ ও বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রীর সাধারণ সম্পাদক তানভীর রুস্তম৷ এই কর্মসূচীর পরদিনই সন্তু গ্রুপের সশস্ত্র সদস্যরা রাঙামাটির বরকল উপজেলার সুবলং ইউনিয়নে এক গণহত্যা সংঘটিত করে৷ তাদের ব্রাশ ফায়ারে ইউপিডিএফ-এর কেন্দ্রীয় সদস্য অনিমেষ চাকমাসহ অপর তিন সদস্য ঘটনাস্থলেই নিহত হন।

সন্তু গ্রুপ কর্তৃক এই ধরনের ঠাণ্ডা মাথায় খুন নতুন কোন ঘটনা নয়। তারা ১৯৯৮ সাল থেকে গত ১২ বছরের অধিক সময় ধরে ইউপিডিএফ-এর একের পর এক নেতা কর্মী ও সমর্থককে খুন ও অপরহণ করছে। এ বিষয়টি উপরোক্ত স্বনামধন্য বাম নেতাদের অজানা থাকার কথা নয়। কিন্তু তারপরও নিপীড়িত শ্রেণী ও জাতির পক্ষে দাবিদার ওই বাম নেতারা কেন সন্তু লারমা ও তার ছাত্র সংগঠনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারলে নিজেদের ধন্য মনে করেন তা এই অধমের বোধগম্য নয়। আমাদের জানতে ইচ্ছে হয়, ওই বাম নেতারা এবং তাদের স্ব স্ব দল ও সংগঠনগুলো কী নিজের বিবেকের কাছে কখনো প্রশ্ন করেছেন সন্তু লারমাদের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে তারা কিসের প্রতি তাদের সমর্থন ব্যক্ত করছেন?

আমরা জানি, মার্কসবাদী বামরাই হলেন ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে সবচেয়ে সোচ্চার। তারাই সবচেয়ে বেশী গণতান্ত্রিক। তাদেরকেই স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের পুরোভাগে দেখা যায়। কিন্তু এই বামরা এরশাদের মতো স্বৈরাচারীর বিরুদ্ধে আন্দোলন করার পরও কেন ও কি উদ্দেশ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে ফ্যাসিস্ট সন্তু লারমাকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন? দয়া করে তারা কি এর ব্যাখ্যা দেবেন? আমরা জানি ও বুঝি যে, সন্তু লারমাকে আঞ্চলিক পরিষদের গদিতে বহাল রেখে ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত জিইয়ে রাখা হলো শাসক দল আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও সেনাবাহিনীর কৌশল৷ কিন্তু পাহাড়িদের বন্ধু দাবিদার বাম নেতারা সন্তু লারমাকে সমর্থন দিয়ে প্রকারান্তরে শাসক দলের মতো পাহাড়িদের মধ্যে সংঘাত জিইয়ে রাখার নীতি বাস্তবায়নে সহায়তা দিয়ে তার স্বার্থ উদ্ধার করছেন? তারা আসলে কার এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছেন?

ওই বাম নেতাদের কি সন্তু লারমার ফ্যাসিজম সম্পর্কে কোন সন্দেহ হয়? যদি সন্দেহ হয় তাহলে তাদের জ্ঞাতার্থে ২০০০ সালের ১৩ নভেম্বর যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত সন্তু লারমার সাক্ষাতকার থেকে কিছু উদ্ধৃতি দিতে চাই। ওই দীর্ঘ সাক্ষাতকারে তাকে প্রশ্ন করা হয় তিনি রাজনৈতিকভাবে ইউপিডিএফ-কে মোকাবিলা করবেন কিনা? এর উত্তরে সন্তু লারমা যা বলেন তা রীতিমত ভয়ানক। তিনি বলে: “পলিটিক্যালি নয়। এদের (ইউপিডিএফ নেতা কর্মীদের) গলা টিপে হত্যা করতে হবে। যাতে কিছু না করতে পারে। হাত ভেঙে দিতে হবে, যাতে লিখতে না পারে। ঠ্যাং ভেঙে দিতে হবে, যাতে হাঁটতে না পারে। চোখ অন্ধ করে দিতে হবে, যাতে দেখতে না পারে। যারা চুক্তির পক্ষে জনগণের অধিকারের পক্ষে তারাই এ কাজ করবে।”

সন্তু লারমার ওই সাক্ষাতকারের পর কি আর কিছু বলার বাকি থাকে? আর কি কিছু অস্পষ্ট থাকে? তবে এর সাথে এ কথা যোগ করা দরকার যে, ইউপিডিএফ সম্পর্কে সন্তু লারমার ওই ফ্যাসিস্ট নীতি কেবল সাক্ষাতকারে সীমাবদ্ধ ছিল না। ওই সাক্ষাতকারের পর তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের পার্টি কংগ্রেসে ও বিভিন্ন কর্মী সম্মেলনে ইউপিডিএফ-কে নির্মূলের কর্মসূচী গ্রহণ করেছিলেন। আর এখন আমরা সবাই দেখতে পাচ্ছি [অবশ্য মনে হয় উপরোক্ত অন্ধ বাম নেতারা ছাড়া] সন্তু লারমা তার এই কর্মসূচী প্রতিদিন বাস্তবায়ন করে চলেছেন৷ সন্তু লারমার এক সময়কার প্রগতিশীল ভূমিকার কথা আমরা নির্দিধায় স্বীকার করি। কিন্তু তার এই ভূমিকার কারণে কি চুক্তি-উত্তর তার গণবিরোধী ও বিপক্ষ দলের নেতা কর্মীদের ওপর ফ্যাসিস্টসূলভ দমনপীড়ন নীতিকে ক্ষমা বা ওভারলুক করা ঠিক হবে? এটা মনে রাখা দরকার, ফ্যাসিস্ট মুসোলিনীও প্রথম জীবনে সমাজতন্ত্রীদের খাতায় নাম লিখিয়েছিলেন।

বাম নেতারা সাধারণত চীন বিপ্লবসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিপ্লব সম্পর্কে অভিজ্ঞ হয়ে থাকেন। কাজেই তাদের অজানা থাকার কথা নয় যে, আজ পার্বত্য চট্টগ্রামে যা ঘটছে তা অনেকটা বিপ্লব-পূর্ব চীনের মতো। সন্তু লারমার মতো ফ্যাসিস্ট চিয়াং কাইশেকও সাম্রাজ্যবাদী জাপানের আগ্রাসন মোকাবিলা না করে কমিউনিস্ট পার্টিকে নির্মূলের কর্মসূচী গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু চীনা জনগণ কমিউনিস্ট পার্টির তোলা যুক্ত ফ্রন্ট নীতিকে অর্থাত্‍ কমিউনিস্ট পার্টি ও জাতীয়তাবাদী কুয়োমিনটাঙ দলের মধ্যে ঐক্য স্থাপন করে জাপানী আগ্রাসন ঠেকানোর নীতিকে সমর্থন করেছিলেন। সাধারণ জনগণের মধ্যে ঐক্যের আকাঙ্খা ও এই ঐক্যের জন্য সংগ্রাম এত বিস্তৃত হয়েছিল যে তার প্রভাব চিয়াং কাইশেকের সেনাবাহিনীর মধ্যেও পড়ে। তার সৈন্যবাহিনীর তিন জন জেনারেল তার বিরুদ্ধে কু্য সংঘটিত করে তাকে শেষ পর্যন্ত কমিউনিস্টদের সাথে সমঝোতা চুক্তি সম্পাদনে বাধ্য করেছিলেন।

সমাজতন্ত্রী বিপ্লবী কেন, কোন লিবারেল গণতন্ত্রীও ফ্যাসিস্ট সন্তু লারমা ও তার দলকে সমর্থন দিতে পারে না। যারা সন্তু লারমার উপরোক্ত সাক্ষাতকারের পরও তার কর্মসূচীতে যোগ দিয়ে তার অপকর্মে সমর্থন ও ইন্ধন দেন তারা কখনো নিপীড়িত পাহাড়ি জনগণের বন্ধু হতে পারেন না। একজন প্রকৃত বিপ্লবী মার্কসবাদীর উচিত পাহাড়িদের স্বার্থের পক্ষে হানিকর এই ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত বন্ধ করতে যথাসাধ্য ভূমিকা রাখা, সন্তু লারমাকে সংঘাত বন্ধ করতে চাপ দেয়া ও তাকে সর্বাত্মকভাবে বয়কট করা। কিন্তু পংকজ ভট্টাচার্য ও কতিপয় বাম নেতা যা করছেন তা হচ্ছে উল্টো, ন্যাক্কারজনক ও বমি উদ্রেক করার মতো।

আমরা পংকজ ভট্টাচার্যসহ উপরোক্ত বাম নেতাদের পাহাড়ি জনগণের স্বার্থ বিরোধী ভূমিকার তীব্র নিন্দা ও ধিক্কার জানাই। আমরা তাদেরকে পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে এবং বিশেষত সন্তু লারমার ফ্যাসিস্ট আচরণ সম্পর্কে তাদের দল বা সংগঠনের নীতি পুনর্বিবেচনার অনুরোধ জানাচ্ছি।

—– শেষ —–

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More