পাহাড়ি ছাত্র সমাজের নতুন করে গর্জে ওঠার সময় এসেছে

0

– অমর চাকমা, চিত্রা ত্রিপুরা, উসাই মারমা

আজ ২০ মে বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের ২২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী১৯৮৯ সালের এদিন ঢাকায় পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের জন্ম। মূলতঃ ওই বছর ৪ঠা মে লংগুদু গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে সেদিনের পাহাড়ি ছাত্র সমাজ এ সংগঠনের জন্ম দিয়েছিলেন। পরদিন ২১ মে ঢাকার রাজপথে এই সংগঠনের ব্যানারে প্রথম ও ঐতিহাসিক মৌন মিছিল বের করা হয়েছিল। এরপর পাহাড়ি ছাত্র পরিষদকে বহু চড়াই উত্‍রাই পেরোতে হয়েছে, বহু রাজনৈতিক ঝড়-ঝঞ্ঝা ও ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করতে হয়েছে।

পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের গঠনের ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনীতিতে এক নতুন মাত্রা যোগ হয়। সে সময় জুম্ম জনগণের ওপর চলছিল নিপীড়নের স্টিম রোলার। জ্বালও পোড়াও, হত্যা, গুম, ধর্ষণ, নির্যাতন ইত্যাদি ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। প্রায় ৬০ হাজার পাহাড়ি তখন ভারতের শরণার্থী শিবিরে আশ্রিত। জনসংহতি সমিতির সশস্ত্র আন্দোলন মুখ থুবড়ে পড়ার মতো অবস্থায়। অনেকে আন্দেলন ছেড়ে হয় সরকারের কাছে অস্ত্র জমা দিয়ে আত্মসমর্পন করেছে, নতুবা পালিয়ে শরণার্থী শিবিরে লুকিয়ে থেকেছে। জেলা পরিষদের নির্বাচন বানচাল করতে ব্যর্থ হলে জেএসএস-এর কলাকৌশলও তখন জনগণের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ। সরকারের রঙ বেরঙের চর, দালাল ও প্রতিক্রিয়াশীলরা তখন বেপরোয়া। তাদের লাগামহীন দাপটে সাধারণ জনগণ ছিল অসহায়। গুচ্ছগ্রাম, আদর্শগ্রাম নামের বন্দীশালায় জনগণের নাভিশ্বাস উঠছিল। সেনাদের পাশ ছাড়া কোথাও যাওয়া যেত না। হতাশা ও অনিশ্চয়তার ঘোর অমানিশায় ছেয়ে গিয়েছিল আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি। জাতি ও জনগণের সেই চরম দুঃসময়ে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের গঠন তাদের মনে আশার আলো জ্বেলে দেয়৷ তারা নতুন করে স্বপ্ন দেখার সাহস ফিরে পায়।

১৯৯১ সালে প্রসিত খীসা পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সভাপতি নির্বাচিত হলে পার্বত্য চট্টগ্রামে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বিপুল গতি সঞ্চারিত হয়। তার নেতৃত্বে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ সারা পার্বত্য চট্টগ্রামে দ্রুত বিসতৃতি লাভ করে। সর্বত্র আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। মিছিল, মিটিং ও শোভাযাত্রায় পার্বত্য চট্টগ্রাম উত্তাল হয়ে ওঠে। ১৯৯২ সালের ১০ এপ্রিল লোগাং গণহত্যার প্রতিবাদে বৈসাবি উত্‍সব বর্জন ও ২৮ এপ্রিল লোগাং অভিমুখে পদযাত্রা, দীঘিনালায় ভরদ্দাজ মুনির শহীদান, রাঙামাটিতে প্রথম স্বায়ত্তশাসনের দাবি উত্থাপন, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে ১৪৪ ধারা লঙ্ঘন সে সময়ের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা, যা পুরো পার্বত্য চট্টগ্রাম কাঁপিয়ে দেয়। এছাড়া সরকারের দালাল ও সেনাবাহিনীর চরদের বিরুদ্ধেও চলে গণ এ্যাকশন৷ স্কুলের ছোট ছোট ছেলেরাও স্বেচ্ছায় এই এ্যাকশনে যোগ দেয়।

পার্বত্য চট্টগ্রামে এই নতুন ধরনের আন্দোলনে সেনাবাহিনী দিশেহারা হয়ে পড়ে। তাদের হাতে ছিল তখনকার শান্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার অস্ত্র ও কলাকৌশল। কিন্তু জনগণের ঐক্যবদ্ধ গণতান্ত্রিক আন্দোলন মোকাবিলার জন্য তারা ছিল নিরস্ত্র। ফলে তারা পর্যায়ক্রমে পিছু হটতে বাধ্য হয়।

তবে শাসকগোষ্ঠী ও সেনাবাহিনী পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা আন্দোলন অঙ্কুরে বিনষ্ট করতে আপ্রাণ চেষ্টা চালায়। তারা তথাকথিত সম অধিকার আন্দোলন, পার্বত্য বাঙালি ছাত্র পরিষদ গঠন করে এবং সেগুলো পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়। বিনা কারণে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের নেতা কর্মী ও সমর্থকদের গ্রেফতার ও হয়রানি করে। কিন্তু এতে আন্দোলন থেমে না গিয়ে বরং আরো বেশী ব্যাপকতা লাভ করে। এভাবে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের অগ্রযাত্রা স্তব্ধ করতে ব্যর্থ হলে সেনারা ১৯৯৫ সালের শেষের দিকে সন্তু লারমার যোগ সাজশে বখাটে ও উচ্ছন্নে যাওয়া পাহাড়ি যুবকদের দিয়ে মুখোশ বাহিনী গঠন করে। (বর্তমানে লক্ষ্মীছড়িতে বোরকা পার্টির মতো। মুখোশ বাহিনীর আসল নাম দেয়া হয়েছিল “পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ ও পাহাড়ি গণ পরিষদের সন্ত্রাস দমন কমিটি”)৷ কিন্তু ব্যাপক গণপ্রতিরোধের মুখে সেনা-মদদপুষ্ঠ মুখোশরা কয়েক মাসের মধ্যে ধ্বংস হয়ে যায়।

এরপর পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের আন্দোলন ধ্বংস করে দেয়ার জন্য সরাসরি মাঠে নামেন স্বয়ং সন্তু লারমা। তিনি তার আত্মসমর্পনের পথ পরিস্কার করতে পিসিপিকে দ্বিধাবিভক্ত করে দেন। তিনি যথার্থই মনে করেছিলেন জনগণের রক্তে ও ঘামে গড়ে ওঠা আন্দোলন বিকিয়ে দিয়ে সরকারের কাছে আত্মসমর্পন করতে চাইলে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সংগ্রামী সেনানীরা তাতে বড় ধরনের বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। সে জন্য তিনি লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে পিসিপির সুবিধাবাদী ও আপোষকামী অংশকে বাগিয়ে নিয়ে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের পুরো নেতৃত্ব কব্জা করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। কিন্তু পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ তার সেই ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দেয় ও সুবিধাবাদী, আপোষকামী ও ধান্দাবাজদেরকে সংগঠন থেকে ঝেটিয়ে বিদায় করে দেয়।

পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের জনপ্রিয়তা সে সময় এত তুঙ্গে উঠেছিল যে আত্মসমর্পনের পর জনসংহতি সমিতি তাদের ছাত্র সংগঠন “পাহাড়ি ছাত্র সমিতিকে” মাঠে নামানোর সাহস করেনি। তারা পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সুনামে ভাগ বসানোর জন্য সুবিধাবাদী, আপোষকামী ও ধান্দাবাজ ছাত্রদের দিয়ে আলাদা পিসিপি গঠন করে, যা জনগণের কাছে “দুই নাম্বারী পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ” বা সংক্ষেপে “দুই নাম্বারী” বলে পরিচিত। আসলেই এরা নামে ও কাজে দুই নাম্বারী। এরা আন্দোলন নয়, আন্দোলনে বিভ্রান্তি সৃষ্টির জন্যই সরকারের বিটিম হিসেবে কাজ করছে।

পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের গঠন পার্বত্য চট্টগ্রামের আন্দোলনের ইতিহাসে এক বিরাট ঘটনা। এটা আজ সবার কাছে স্পষ্ট, সেদিন প্রসিত খীসার নেতৃত্বে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের আন্দোলন সারা পার্বত্য চট্টগ্রামে ছড়িয়ে না পড়লে জনসংহতি সমিতি মুখ থুবড়ে পড়তো ও ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চুক্তিতে যতটুকু অর্জন করা গেছে তাও অর্জন করা সম্ভব হতো না। পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের আন্দোলন জেএসএস নেতৃত্বকে শক্তি যুগিয়েছিল ও সরকারের সাথে দেন দরবার করতে সুবিধা করে দিয়েছিল। অথচ সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন সেই জেএসএস-ই বিশ্বাসঘাতকতা করে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদকে দ্বিধাবিভক্ত করে দেয়।

আন্দোলন কখনোই সহজ সরল ও মসৃন নয়। আন্দোলন ঢাকার মানিক মিঞা এভেন্যুর মতো প্রশস্ত ও সোজা নয়। আন্দোলনে বহু চরাই উত্‍রাই ও আঁক বাঁক রয়েছে। গত ২২ বছরে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদকে সে সব পেরিয়ে আসতে হয়েছে। একের পর এক দমন পীড়ন ও ষড়যন্ত্র চালিয়েও পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের আন্দোলনকে স্তব্ধ করা যায়নি, ভবিষ্যতেও যাবে না। বরং জনসংহতি সমিতির আদর্শিক বিচ্যুতি, করুণ রাজনৈতিক মৃত্যু ও আত্মসমর্পনের পর পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ নতুন পার্টি ইউনাইটেড পিপল্স ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

পার্বত্য চুক্তির পরও পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সমাধান হয়নি। জনগণের ন্যায্য অধিকার অর্জিত হয়নি। নিপীড়ন নির্যাতন, ভূমি বেদখল অব্যাহত রয়েছে। জনগণের জীবনে আজও শান্তি ফিরে আসেনি। কাজেই আন্দোলন ছাড়া জনগণের সামনে আর কোন পথ খোলা নেই। আর যেখানেই আন্দোলন সেখানে ছাত্র সমাজের রয়েছে এক ঐতিহাসিক ভূমিকা। ইউপিডিএফ-এর নেতৃত্বাধীন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদই ছাত্র সমাজের এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে পারে। “দুই নাম্বারী” করে, জনগণের সাথে প্রতারণা করে আন্দোলন করা যায় না। তাই পার্বত্য চট্টগ্রামের আন্দোলনে নতুন যে অধ্যায় শুরু হয়েছে তাতে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জেএসএস-এর পক্ষে আর নেতৃত্ব দেয়া সম্ভব নয়। অতীতে এক সময় প্রগতিশীল ভূমিকা পালন করলেও বর্তমানে জেএসএস সরকারের দালাল ও দাসানুদাসে পরিণত হয়েছে। আঞ্চলিক পরিষদের গদি টিকিয়ে রাখাই এখন তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য। এমন কি চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য গলা ফুলিয়ে চেঁচামেচি করলেও এর জন্য আন্দোলনে তারা এক পাও এগোয় না। অথচ আন্দোলনের জন্য চরম হানিকর ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত জিইয়ে রাখতে ও ভাইয়ের বুকে গুলি চালাতে তারা একটুও দ্বিধা করে না। আজ সর্বত্র ও ইউপিডিএফসহ জনগণের সকল মহলে ভাইয়ে ভাইয়ে মারামারি-হানাহানি বন্ধ করা ও ঐক্যবদ্ধ হওয়ার দাবি জোড়ালোভাবে উচ্চারিত হচ্ছে। কিন্তু জনগণের সেই দাবি তারা বরাবরই উপেক্ষা করে চলেছে।

একামাত্র ইউপিডিএফ-ই নতুন সময়ের আন্দোলনে দতার সাথে নেতৃত্ব দেয়ার সামর্থ্য রাখে। সাজেক, খাগড়াছড়ি, লংগুদু ও রামগড় হামলার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং ভূমি বেদখলের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পার্টির নিরলস ভূমিকা তারই সাক্ষী দেয়। কাজেই পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিকারহারা নিপীড়িত জনগণের মুক্তির জন্য নতুন যুগের পার্টি ইউপিডিএফ-এর পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ হওয়া ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই।

ইউপিডিএফ-এর নেতৃত্বাধীন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ সব সময় আন্দোলনের ঝাণ্ডাকে উর্ধ্বে তুলে ধরেছে ও সংগ্রামী ঐতিহ্য বজায় রেখেছে। জাতিসত্তার মাতৃভাষায় শিক্ষার দাবিতে ধারাবাহিক আন্দোলন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের একক কৃতিত্ব। এছাড়া ভূমি বেদখলসহ সকল ধরনের নির্যাতনের বিরুদ্ধে সংগ্রামে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ সামনের কাতারে রয়েছে। ভবিষ্যতেও পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ আন্দোলন থেকে একচুলও বিচু্যত হবে না।

পার্বত্য চট্টগ্রামের ছাত্র সমাজের নতুন করে গর্জে ওঠার সময় এসেছে। সন্তু লারমা ছাত্র সমাজকে বিভান্ত করতে অপতত্‍পরতা চালাচ্ছে, ছাত্র সমাজকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার পথে বাধা সৃষ্টি করছে। কিন্তু সে সব বাধা ডিঙোতে হবে। যখন মাতৃভূমির অস্তিত্ব বিপন্ন, যখন বেঁচে থাকার একমাত্র সম্বল আমাদের ভূমি কেড়ে নিতে শকুন হায়েনার দল হামলে পড়ছে, যখন মা-বোনের ইজ্জত লুণ্ঠন করে নরপিশাচরা দানবীয় নৃত্য করছে, তখন ছাত্র সমাজ চুপ করে বসে থাকতে পারে না। তখন ভীরু কাপুরুষের মতো বসে থাকা মার অযোগ্য অপরাধ। ছাত্র সমাজের মধ্যে অচলায়তনের পাহাড় ভাঙতেই হবে।

——- শেষ ——-

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More