পাহাড়ে সেনাবাহিনীর হেফাজতে মৃত্যু ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় জাতীয় গণতান্ত্রিক গণমঞ্চের বিবৃতি

0

ঢাকা ।। পাহাড়ে সেনাবাহিনীর হেফাজতে ইউপিডিএফ নেতার মৃত্যু ও মহালছড়িতে সেটলার বাঙালি কর্তৃক পাহাড়িদের ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় জাতীয় গণতান্ত্রিক গণমঞ্চ সংবাদ মাধ্যমে একটি বিবৃতি প্রদান করেছে। বিবৃতিটি তারা তাদের ফেসবুক পেজেও প্রকাশ করেছেন। আমরা তাদের বিবৃতিটির গুরুত্ব বিবেচনা করে হুবহু এখানে তুলে ধরছি:

পাহাড়ে সেনাবাহিনীর হেফাজতে মৃত্যু ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় 
জাতীয় গণতান্ত্রিক গণমঞ্চের বিবৃতি

গত ১৫ মার্চ ভোররাতে খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় সেনাবাহিনী মিলন চাকমা ওরফে নবায়ন চাকমাকে তার বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়। জিজ্ঞাসাবাদের নামে তার ওপর চলে শারীরিক নির্যাতন, সম্ভবত এই সময় তার মৃত্যু ঘটে। পরবর্তীতে তাকে হাসপাতালে নেয়া হলে কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন। তিনি ইউপিডিএফ-এর রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন।

একই দিনে অপর এক ঘটনায়, খাগড়াছড়ির মহালছড়ি উপজেলার মাইসছড়ি ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ডের ডিপ্পোছড়ি নামক স্থানে গতকাল মঙ্গলবার রাত ১০টার সময় জয়সেন পাড়ার নাজিম, বেলাল ও নজরুলের নেতৃত্বে একদল সন্ত্রাসী পাহাড়িদের অন্তত ৯টি ঘরে অগ্নিসংযোগ করে। এ সময় সেনা সদস্যরা আশে পাশে অবস্থান করছিলো বলে স্থানীয়দের অভিযোগ।

আমরা এই হিংস্র হত্যা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই এবং দায়ী ব্যক্তিদের অবিলম্বে গ্রেফতার ও শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।

পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি জনগণের উপর রাষ্ট্রীয় বাহিনী কর্তৃক অথবা তাদের মদদে প্রতিনিয়ত বিচার বহির্ভূত হত্যা, খুন, গুম, অগ্নিসংযোগ, অপহরণের ঘটনা বহুদিন থেকে চলমান। তথাকথিত ‘শান্তি চুক্তির’ মাধ্যমে শাসক শ্রেণী এসব সমস্যার লোক দেখানো একটা সমাধান হাজির করে। পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা নয় বরং শান্তি প্রতিষ্ঠার নামে পাহাড়ি সম্পদ লুটপাটের আয়োজন করা হয়। পাহাড়ে ‘অপারেশন উত্তরণ’ নামে জারি করা হয় অলিখিত উগ্রবাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী ফ্যাসিস্ট সেনাশাসন। পার্বত্য চট্টগ্রামে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গণ-বিরোধী ‘১১ দফা’ নির্দেশনার জারি করার মাধ্যমে এ সেনা শাসনকে বৈধতা দেওয়া হয়েছে। যার ফলে সেখানে সেনাবাহিনীর সদস্যরা তাঁদের অপারেশন উত্তরণের নামে পাহাড়ি জনগণের উপর নিপীড়ন-নির্যাতন, রাতের আধারে বিনা অনুমতিতে ঘরবাড়ি তল্লাশি, অপহরণ, মামলা দিয়ে আটক, খুন-গুম-হত্যা-ধর্ষণ ও ক্যাম্প স্থাপনের নামে পাহাড়িদের ভূমি বেদখল নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। কাজেই আমরা অপারেশন উত্তরণের নামে সেনাশাসনের বিরোধিতা করছি এবং তা প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছি।

প্রসঙ্গক্রমে আমরা বলতে চাই, ১৯৭১ সালে বাঙ্গালী ধনীক শ্রেণী ক্ষমতাসীন হয়ে দেশে প্রায় ৪৫টি জাতিসত্তা ও ভাষার অস্থিত্ব সত্ত্বেও সংবিধানে বাঙালী ছাড়া অন্যকোনো জাতিগোষ্ঠীর অস্থিরত্বকে স্বীকার করেনি। ক্ষুদ্র জাতিসত্তাসমূহের আত্মনিয়ন্ত্রানিধিকারসহ জাতিগত সকল বৈষম্য অবসানের গণতান্ত্রিক অধিকারের স্বীকৃতি না দিয়ে আঞ্চলিক স্বায়ত্ত্বশাসনের দাবিকে ক্রমাগত পদদলিত করেছে। তারা পার্বত্য চট্টগ্রামকে শোষণ-লুণ্ঠনের অবাধ ক্ষেত্রে পরিণত করেছে এবং দমন-পীড়ন চালিয়েছে। এভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে ক্ষুদ্রজাতিসত্তার অধিকার আন্দোলনকে সশ্স্ত্র সংগ্রামের পথে ঠেলে দিযেছে।এই সশস্ত্র সংগ্রাম দমন করতে জেনারেল জিয়া জায়নবাদী কায়দায় পাহাড়ে দরিদ্র ভূমিহীন বাঙালীদের পুনর্বাসন করে। যারা পরবর্তীতে ‘সেটেলার’ হিসেবে পরিচিতি পায়। এই পুনর্বাসন করতে গিয়ে পাহাড়িদের জমি দখল করা হয়। তাদের বসতভিটা থেকে উচ্ছেদ করা হয়। এভাবে ঐতিহ্যবাহী পাহাড়ী ট্রাইবাল ভূমি মালিকানার সুযোগ গ্রহণ করে কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রের সাহায্যে বাঙ্গালী আমলাতান্ত্রিক বুর্জোয়া শ্রেণী একদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের বৈষয়িক অস্তিত্বের ভিত্তি বিস্তীর্ণ ভূমি ও বনাঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে, তেমনি সেটেলারদের ভূমি বিতরণের মাধ্যমে ভূমি সমস্যাকে করে তুলেছে জটিলতর। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জাতিসত্তাগুলো তাদের অস্তিত্বের খাতিরে অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নিজেদের বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে লড়াই করছেন। বাংলাদেশের শাসক শ্রেণী পার্বত্য চট্টগ্রামের উপর তাদের জাতিগত নিপীড়ন ও শোষণ-লুণ্ঠন অব্যহত রাখার স্বার্থে সেখানে কা্র্যত এক সেনাশাসন জারি রেখেছে।

এভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্তমান সংকটের মূলে রয়েছে : ভূমি সমস্যা, ‘সেটেলার’ সমস্যা ও সেনা শাসন যা কেবল পাহাড়ি জাতিসত্তার জাতীয় আত্মনিয়ণাধিকারের স্বীকৃতির গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক মীমাংসার মাধ্যমেই সমাধান সম্ভব।

পাকিস্তান আমলে বাঙ্গালী জনগণ জাতীয় নিপীড়ন ও গণহত্যার শিকার হয়েছেন। তারা জাতীয় নিপীড়ণের বিরুদ্ধে রক্তাক্ত সংগ্রাম করেছেন। অথচ বাঙ্গালী ফ্যাসিস্ট শাসক শ্রেণী ব্যপক বাঙ্গালী শ্রমিক-কৃষক-জনগণের তীব্র শোষণ-লুণ্ঠন ও ফ্যাসিবাদী শাসন জারি করেছে। তাই তারা উগ্রবাঙ্গালী শাসকদের পাহাড়ি জাতিসত্তাগুলোর উপর জাতিগত নিপীড়ন সমর্থন করতে পারেন না। বাঙ্গালী জনগণও তাদের ঘাড়ে চেপে থাকা বাঙ্গালী শাসকদের উৎখাত করে জনগণের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চান। কিন্তু কোন জাতি অপর জাতিকে উৎপীড়ন নিজ জাতির মুক্তি ঘটাতে পারে না। বরং বাঙ্গালি জাতির জনগণের মুক্তি পাহাড়ি জাতিসত্তাগুলোর মুক্তির সাথে সম্পর্কিত হয়ে পড়েছে। আজকের ফ্যাসিস্ট শাসক শ্রেণীকে উৎখাত করে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় বাঙ্গালী ও পাহাড়িদের সংগ্রাম- এক অভিন্ন ধারায় পরিণত হয়েছে। পাহাড়ি জাতিসত্তা ও সমতলের জনগণের ঐক্য ছাড়া এ লড়াইয়ে বিজয় অসম্ভব। আমরা মনে করি, কেবল পাহাড় ও সমতলের শ্রমিক কৃষক মেহনতি মানুষের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের মাধ্যমেই ফ্যাসিবাদী দুঃশাসনের অবসান ঘটিয়ে একটি গণতান্ত্রিক সরকার, সংবিধান ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাঙ্গালী-পাহাড়ি জনগণের পক্ষে নয়াগণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং পাহাড়ি সমস্যার সমাধান সম্ভব।

পাহাড়ের সমস্যা সমাধানের জন্য পাহাড় ও সমতলের প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক সকল রাজনৈতিক দল, সংগঠন ও ব্যক্তি সোচ্চার এক হয়ে আওয়াজ তুলুন:

• মিলন চাকমাসহ পাহাড়ে সকল হত্যা, গুমের সাথে জড়িতদের বিচার ও শাস্তি দিতে হবে।

• রাজনৈতিক মীমাংসার লক্ষ্যে অবিলম্বে সামরিক পন্থা প্রত্যাহার এবং অপারেশন উত্তরণসহ সকল রাজনৈতিক দমন-পীড়ন বন্ধ করতে হবে।

• পাহাড়ে জাতিসত্তাগুলোর আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের স্বীকৃতিসহ সকল জাতিগত বৈষম্য-নিপীড়নের অবসান করতে হবে।

• সেটেলার বাঙালীদের সমতলে সম্মানজনক পূর্নবাসন করতে হবে।

• পাহাড়ী-বাঙালী মেহনতি মানুষের ঐক্যকে সমর্থন করুন।

• ফ্যাসিবাদী দুঃশাসন ধ্বংস হোক, নিপাত যাক!


সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।


সিএইচটি নিউজের ইউটিউব চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব করুন

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More