পিসিপি’র কেন্দ্রীয় বর্ধিত সভায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, রাঙামাটি কলেজ ইউনিফরম চালুকরণসহ কতিপয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ
নিজস্ব প্রতিবেদক
সিএইচটিনিউজ.কম
বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ(পিসিপি)-এর তৃতীয় কেন্দ্রীয় বর্ধিত সভায় দেশীয় ও পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে সাংগঠনিক ও জাতীয় ইস্যুতে কতিপয় প্রস্তাবনা, সিদ্ধান্ত ও কর্মসূচি গৃহীত হয়েছে। গতকাল ১১ ফেব্রুয়ারি সোমবার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে একদিন ব্যাপী অনুষ্ঠিত সভায় এসব প্রস্তাবনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
যুদ্ধাপরাধী বিচার প্রসঙ্গে সভায় বলা হয়, পিসিপি কেন্দ্রীয় কমিটি গভীর মনোযোগ ও আগ্রহের সাথে কাদের মোল্লার ফাঁসিসহ সকল যুদ্ধাপরাধীর বিচারের দাবিতে ব্লগার্স ও অনলাইন এক্টিভিস্টস-এর আহ্বানে শাহবাগ চত্বরে আয়োজিত ৮ ফেব্রুয়ারি মহাসমাবেশসহ এর পূর্ববতী এবং চলমান আন্দোলন পর্যবেক্ষণ করছে। নীতিগতভাবে পিসিপি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং সর্বোচ্চ শাস্তি প্রদান–এ দাবির প্রতি সমর্থন জানায়।
সভায় বলা হয়, এটা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধী খুনী কাদের মোল্লার রায় ঘোষিত হবার পর পরই তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে পিসিপি সহ সাত সংগঠন (গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম, পিসিপি, এইচডব্লিউএফ, সাজেক নারী সমাজ, সাজেক ভূমি রক্ষা কমিটি, ঘিলাছড়ি নারী নির্যাতন প্রতিরোধ কমিটি ও প্রতিরোধ সাংস্কৃতিক স্কোয়াড) যুক্তভাবে উক্ত রায় প্রত্যাখ্যান এবং বিচার প্রক্রিয়ার ব্যাপারে সংশয় প্রকাশ করে বিবৃতি প্রদান করেছিল, যা নিউজ ওয়েবসাইটে গুরুত্বের সাথেও প্রকাশিত হয়।
সভায় আরো বলা হয়, পিসিপি কেন্দ্রীয় কমিটি ১০ ফেব্রুয়ারি ক্ষমতাসীন দলের জনৈক রাজনৈতিক নেতাকে বক্তৃতা করতে দেয়া না দেয়া নিয়ে সৃষ্ট বাদানুবাদের এক পর্যায়ে লাকী আক্তার নামে শ্লোগান নেতৃত্বদানকারী অতি পরিচিত কর্মীর মাথায় লাঠির আঘাত করার ঘটনায় নিন্দা ও উদ্বেগ প্রকাশ করছে এবং চিহ্নিত দুষ্কৃতকারীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাচ্ছে।
শাহবাগ চত্বরের ধ্বনিত কতিপয় শ্লোগান সম্পর্কে এ সভায় বলা হয়, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে চলমান আন্দোলনে সমর্থন দিলেও সমাবেশে উচ্চারিত কতিপয় শ্লোগান ও বক্তব্যের সাথে পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের দাবিতে সংগ্রামরত পিসিপি ভিন্নমত পোষণ করে। ৭১ সালে প্রবল জাতীয়তাবাদী আবেগের প্রতিধ্বনি “আমি কে? তুমি কে? বাঙালি বাঙালি!”–এ ধরনের শ্লোগান বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে কতখানি সঙ্গতিপূর্ণ, সে ব্যাপারে আমাদের প্রিয় সংগঠন পিসিপি’র সংশয় রয়েছে। আমাদের এটা প্রতীয়মান হচ্ছে যে, এ দাবির সাথে একাত্ম হওয়া সত্ত্বেও বাঙালি ভিন্ন অন্য জাতিসত্তাসমূহ আন্দোলনে সামিল হতে দ্বিধাগ্রস্ত হচ্ছে। ৮ ফেব্রুয়ারি শাহবাগে আহুত মহাসমাবেশে সংহতি জ্ঞাপন করতে গিয়ে আমাদের সে সংশয় বদ্ধমূল হয়েছে। দুঃখজনক হলেও অদ্যাবধি শাহবাগ চত্বরে উক্ত শ্লোগান ধ্বনিত হচ্ছে, এ ব্যাপারে উদ্যোক্তদের আরও সজাগ এবং বিবেচক হবার জন্য পিসিপি বিনীত আহ্বান জানাচ্ছে।
শাহবাগ আন্দোলনে “একটা একটা জামাত-শিবির ধর, সকাল বিকাল জবাই কর, নাস্তা কর!”– এ শ্লোগান সম্পর্কে সভায় বলা হয়, এ ধরনের শ্লোগান মধ্যযুগীয় চিন্তাধারার অনুসারি জামাত-শিবিরের কর্মীদের উন্মাদনা সৃষ্টির মূলমন্ত্র হলেও প্রগতিশীল চিন্তাধারার রাজনৈতিক কর্মী-শিক্ষার্থীগণ নিজেদের চাঙ্গা করার জন্য তা লুফে নিতে পারে না এবং সেটা উচিতও নয়। মধ্যযুগীয় চিন্তা উস্কে দিলে প্রতিহিংসা চরিতার্থকরণই মুখ্য হবে, আন্দোলনের লক্ষ্য বিপথে ধাবিত হতে পারে, আর তাতে জামাত-শিবিরকে রাজনৈতিকভাবে উচ্ছেদ করা সম্ভব হবে না। বরং জামাতের রাজনীতিই লাভবান বলে পিসিপি মনে করে।
সভায় বলা হয়, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অর্থাৎ অতীত রাজনৈতিক ভুলের জের সংশোধন করতে গিয়ে যদি উগ্রজাতীয়তা ও মধ্যযুগীয় আবেগে গা ভাসিয়ে দেয়া হয়, তাহলে তা দেশ ও জনগণের জন্য কল্যাণকর হবে না–সে ব্যাপারে আরও সতর্কতা প্রয়োজন বলে পিসিপি মনে করে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে নব্য রাজাকার-আল বদরদের ভূমিকা প্রসঙ্গে সভায় বলা হয়, সাম্প্রতিক সময়ে যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধীদের বিচার নিয়ে সরব হলেও এ ব্যাপারে ক্ষমতাসীন সরকারের দ্বৈত ভূমিকায় পিসিপি তথা পার্বত্য চট্টগ্রামের ছাত্র সমাজ অত্যন্ত ক্ষুব্ধ। ‘৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দোসর রাজাকার-আল বদররা বাঙালি জনগণের ওপর যে অবর্ণনীয় হত্যাযজ্ঞ-ধর্ষণ ও নিপীড়ন চালিয়েছিল, ৪০ বছর পরও বাংলাদেশের মানুষ তা মেনে নিতে পারছে না, বিচারের দাবিতে ফুঁসে উঠে তরুণ প্রজন্ম শাহবাগ চত্বরে সমবেত হয়েছে, যার সাথে একাত্ম হয়েছে সর্বস্তরের মানুষ। বিশেষ মতলব থেকে সমাবেশের সাথে সংহতি জানাচ্ছে প্রগতিশীলতার মুখোশ পরিহিত একশ্রেণীর লোক।
অথচ পার্বত্য চট্টগ্রামে এখনও হত্যাকাণ্ড চলছে এবং তাতে প্রত্যক্ষ মদদ রয়েছে ক্ষমতাসীন দল তথা শাসকচক্রের, কিন্তু সে ব্যাপারে প্রগতিশীলতার মুখোশ পরিহিত মুখচেনা রাজনৈতিক-সাংবাদিক-মানবাধিকার কর্মী মুখ খোলেন না, বরং পাহাড়ি রাজাকার-আল বদর সদৃশ ঘৃণ্য ব্যক্তিদের সাথে নির্লজ্জ সখ্য বজায় রেখে চলেন–এ ধরনের নীতিহীন সুবিধাবাদী গোষ্ঠীর কারণে বাংলাদেশ অধঃপাতে যাচ্ছে বলে পিসিপি মনে করে।
পাহাড়ি জনগণের ন্যায় সঙ্গত আন্দোলন ব্যাহত করতে সরকারের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে থাকা সন্তু লারমার নেতৃত্বে পাহাড়ি জনগণের ওপর যে হত্যাকাণ্ড ও নিপীড়ন চলছে, তা বৈধতা দিতে পাহাড়ি দরদী সেজে প্রগতিশীলতার মুখোশ পরিহিত একশ্রেণীর লোক ন্যাক্কারজনক ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। পিসিপি এদের থেকে সাবধানতা অবলম্বন করে চলার জন্য ছাত্র সমাজ তথা আন্দোলনকারী জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানায়।
বর্ধিত সভায় রাঙামাটি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে ইউনিফরম বিতর্ক, ধর্মীয় বিধান চাপিয়ে দেয়া প্রসঙ্গে বলা হয়, পিসিপি গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছে যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রথম উচ্চ শিক্ষ প্রতিষ্ঠান রাঙামাটি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে ইউনিফরম চালুকরণ নিয়ে রীতিমত পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি শুরু হয়েছে, যা উদ্বেগজনকভাবে সাম্প্রদায়িক বিভৎস রূপ নিচ্ছে। পিসিপি’র নিকট তা আপত্তিজনক ও অগ্রহণযোগ্য।
এ সম্পর্কে সভায় আরো বলা হয়, পিসিপি মনে করে, কলেজ লেভেলের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের ইউনিফরম থাকা অসঙ্গত নয়। ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের আরও অনেক স্বনামধন্য কলেজে শিক্ষার্থীদের ইউনিফরম রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের স্কুল লেভেলেও ইউনিফরম নতুন কিছু নয়। আর্থিক সঙ্গতি সব শিক্ষার্থীর এক নয়, সে দিকটি গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় রেখেই ইউনিফরম প্রবর্তন করা উচিত এবং ইউনিফরম চালু করার উদ্দেশ্যও হচ্ছে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সাম্য আনা। কলেজ কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনে বিশেষ বন্দোবস্তের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের নিকট সুলভ ও ন্যায্য মূল্যে পোশাক নিশ্চিত করতে পারে এবং সেটা করার জন্য পিসিপি কলেজ ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট দাবি জানাচ্ছে।
সভায় বলা হয়, পার্বত্য চট্টগ্রামের পুরাতন বিদ্যাপিঠ হিসেবে ইউনিফরম চালু করে রাঙামাটি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ এ প্রতিষ্ঠানের স্বতন্ত্র পরিচিতি তুলে ধরতে সচেষ্ট থাকবে। বিভিন্ন সূত্রে বলা হচ্ছে, কলেজ কর্তৃপ শুধু এ্যাপ্রনকে ইউনিফরম হিসেবে চালু করার উদ্যোগ নিচ্ছে, যা গ্রহণযাগ্য হবে না। কারণ গায়ে শুধু এ্যাপ্রন চাপালেই তাকে ইউনিফরম হিসেবে গণ্য করা যায় না, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহের কর্মীরাও তা করে থাকে। শিক্ষার্থীদের আর্থিক সঙ্গতি এবং প্রতিষ্ঠানের বিশেষত্বের প্রতিফলন ঘটে এমন ধরনের ইউনিফরম প্রবর্তনের ব্যাপারে কলেজ কর্তৃপক্ষকে সুচিন্তিত ও সুবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্তে আসতে হবে। সেক্ষেত্রে শিক্ষানুরাগী প্রগতিশীল চিন্তা চেতনাসম্পন্ন ব্যক্তিগণ কলেজ কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় সমর্থন ও সহযোগিতা দিতে এগিয়ে আসবে বলে পিসিপি মনে করে।
লক্ষণীয় যে, কলেজ শিক্ষার্থীদের মধ্যে ইউনিফরম চালুর পক্ষ-বিপক্ষ বিভাজন সৃষ্টি করে একশ্রেণীর রাজনৈতিক সংগঠন ফায়দা লুটার জন্য তৎপর হয়ে উঠেছে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা ফেনিয়ে তুলতে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি দিচ্ছে, যা উদ্বেগজনক এবং নিন্দনীয়। পিসিপি এ ধরনের কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকতে সবাইকে আহ্বান জানায়।
সভা থেকে বলা হয়, ইউনিফরম প্রবর্তনের নামে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মীয় বিধান ও বাধ্যবাধকতা অন্য সম্প্রদায় ও ধর্মালম্বীদের ওপর চাপিয়ে দেয়া কখনই গ্রহণযোগ্য হবে না। পিসিপি দ্ব্যর্থহীনভাবে জানিয়ে দিতে চায় যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের যে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভিন্ন ধর্মাবলম্বী ছাত্রীদের জন্যও ইসলামিক ভাবধারার নেকাব-হিজাব ধরনের বাধ্যবাধকতা জারি রয়েছে সে ব্যাপারে পিসিপি’র আপত্তি রয়েছে। অনতিবিলম্বে তা বাতিল করার জন্য পিসিপি সংশ্লিষ্ট স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছে।#