পিসিপি’র ৩৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে পানছড়িতে ছাত্র সমাবেশ ও র্যালি
পানছড়ি প্রতিনিধি, সিএইচটি নিউজ
শুক্রবার, ১৯ মে ২০২৩

বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি)-এর ৩৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে খাগড়াছড়ির পানছড়িতে ছাত্র সমাবেশ ও র্যালি অনুষ্ঠিত হয়েছে।
আজ শুক্রবার (১৯ মে ২০২৩) সকাল ১১টায় পিসিপি’র পানছড়ি থানা শাখা এই সমাবেশ ও র্যালির আয়োজন করে।
“পূর্ণস্বায়ত্তশাসনই পার্বত্য চট্টগ্রামের একমাত্র সমাধান” এই শ্লোগানে এবং ‘শাসকচক্রের খুঁটিতে বাঁধা চিহ্নিত গোষ্ঠীসমূহের আন্দোলনের প্রহসন রুখে দিতে ছাত্র সমাজ এক হও’ এই আহ্বানে অনুষ্ঠিত ছাত্র সমাবেশে পিসিপির পানছড়ি থানা শাখার সভাপতি সুনীল ময় চাকমার সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক মানিক ত্রিপুরার সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন পিসিপি’র চবি শাখার সাবেক সভাপতি ও ইউপিডিএফ সংগঠক মিথন চাকমা, পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘের পানছড়ি থানা শাখার সভাপতি মিনতি চাকমা, পিসিপি কেন্দ্রীয় কমিটি’র সহ-সাধারণ সম্পাদক নিকন চাকমা, গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের কেন্দ্রীয় সহ-সাধারণ সম্পাদক বরুন চাকমা, প্রমুখ। এতে স্বাগত বক্তব্য রাখেন পিসিপি পানছড়ি থানা শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক অর্কিত চাকমা।
সমাবেশে ইউপিডিএফ সংগঠক মিথন চাকমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে অধিকার আদায়ের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অন্যতম সংগঠন হচ্ছে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ। এই সংগঠনের নেতৃত্বেই ছাত্র সমাজকে সংগঠিত হয়ে অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন জোরদার করতে হবে।
তিনি আরো বলেন, বর্তমান সরকার ২০১৫ সালের ৭ জানুয়ারি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে অগণতান্ত্রিক ১১ দফা নির্দেশনা জারি করে এখানে সেনাশাসনকে বৈধতা দিয়েছে। এর ফলশ্রুতিতে সেনাবাহিনী পাহাড়ি জনগণের ন্যায্য দাবি পূর্ণস্বাত্তশাসন আন্দোলনকে ধ্বংস করার জন্য ইউপিডিএফ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীসহ সাধারণ জনগণের ওপর নিপীড়ন-নির্যাতন চালাচ্ছে। তারা বিনা বিচারে হত্যা, মিথ্যা মামলা দিয়ে গ্রেফতার, রাতের আঁধারে পাহাড়িদের বাড়ি-ঘরে তল্লাশি, সেনাচৌকি বসিয়ে তল্লাশি করে সাধারণ জনগণকে হয়রানি করে প্রতিনিয়ত মানবাধিকার লঙ্ঘন করে যাচ্ছে।

তিনি বান্দরবানের পরিস্থিতি তুলে ধরে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে বান্দরবানের রুমা, রোয়াংছড়ি এলাকায় সেনাবাহিনী কেএনএফকে দমনের নামে বিভিন্ন গ্রামে অপারেশন চালাচ্ছে এবং সাধারণ গ্রামবাসীদের মানবঢাল হিসাবে ব্যবহার করে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে। তিনি এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান।
সরকার ‘ভাগ কর শাসন কর’ নীতির মাধ্যমে পাহাড়ি জাতিসত্তাসমূহকে ধ্বংস করার পাঁয়তারা চালাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, শাসকগোষ্ঠীর ফাঁদে পড়ে সন্তু লারমা আবারও নতুন করে ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতে পা বাড়িয়েছেন। তিনি সন্তু লারমার উদ্দেশ্যে বলেন, আপনি পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য আন্দোলন না, জুম্মদের উপর চলা নিপীড়ন-নির্যাতনের বিরুদ্ধে না দাঁড়িয়ে ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতকে কেন জিইয়ে রাখতে চাচ্ছেন? তিনি অবিলম্বে ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতে পথ পরিহার করে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যে সামিল হয়ে পাহাড়িদের অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম জোরদার করতে সন্তু লারমার প্রতি আহ্বান জানান।
পিসিপি নেতা নিকন চাকমা বলেন, ১৯৮৯ সালে ৪ঠা মে লংগদু গণহত্যার মধ্যে দিয়ে ওই বছর ২০ মে ঢাকায় পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ জন্মলাভ করে। বহু আত্মত্যাগের বিনিময়ে এই ছাত্র সংগঠন আগামী ২০ মে প্রতিষ্ঠার ৩৪ বছর পূর্ণ করবে। পিসিপি গঠনলগ্ন থেকে শাসকগোষ্ঠির সকল যড়যন্ত্র মোকাবেলা করে পাহাড়িদের অধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছে। সরকার পিসিপি’র আন্দোলন দমন করার জন্য খুন, মিথ্যা মামলা দিয়ে গ্রেফতার সহ নানা যড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। ২০১৮ সালের ১৮ আগষ্ট খাগড়াছড়ি সদরের স্বনির্ভরে সেনা মদদে নব্য মুখোশ বাহিনীর সন্ত্রাসীদের লেলিয়ে দিয়ে ছাত্র নেতা তপন, এল্টন যুব নেতা পলাশ চাকমাসহ ৭ জনকে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু শত দমন-পীড়নে, খুন, নির্যাতন চালিয়েও পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের আন্দোলনকে স্তব্ধ করা যায়নি, ভবিষ্যতেও যাবে না।
তিনি স্বনির্ভর গণহত্যার সাথে জড়িত সন্ত্রাসীদের এবং ২০১৭ সালে নান্যাচরে ছাত্রে নেতা রমেল চাকমাকে হত্যাকারী সেনা কর্মকর্তা বাহলুল আলম, মেজর তানভীর গংদের দ্রুত আইনের আওতায় এনে বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান।
যুব নেতা বরুন চাকমা বলেন, বর্তমান সরকার পর্যটনের নামে, উন্নয়নের নামে, সীমান্ত সড়ক নির্মাণ করে পাহাড়িদের ভূমি বেদখল করে যাচ্ছে। আশির দশকে জিয়া, এরশাদ সরকারে আমলে সমতল থেকে লক্ষ, লক্ষ সেটলার বাঙালি পার্বত্য চট্টগ্রামে অবৈধভাবে অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে পাহাড়িদের হাজার হাজার একর ভূমি বেদখল করা হয়েছে, এখন এ ভূমি বেদখল বন্ধ হয়নি।
তিনি ভূমি বেদখল, অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে রুখে দাঁড়াতে ছাত্র-যুব সমাজের প্রতি আহ্বান জানান।
নারী নেত্রী মিনতি চাকমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারাদেশে নারীরা আজ কোথাও নিরাপদ নয়। বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রামে জাতিগত নিপীড়নের অংশ হিসেবে পাহাড়ি নারীদের ওপর যে নির্যাতন করা হয় তার ফলে আমরা কোন বিচার পাই না। এতে করে বার বার নারী ধর্ষণ, নির্যাতনের ঘটনা সংঘটিত হয়।
তিনি নারী-পুরুষ সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে শাসকগোষ্ঠির অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান।
সভাপতির বক্তব্যে সুনীল ময় চাকমা বলেন, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ পার্বত্য চট্টগ্রামে অধিকারকামী একটি লড়াকু সংগঠন। শাসকেরক রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এ সংগঠনের নেতা-কর্মীরা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে।
তিন বলেন, বর্তমান সরকার মূখে গণতন্ত্রের কথা বললেও পার্বত্য চট্টগ্রামে সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক পরিবেশ নেই। এখানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পর্যন্ত সেনা-গোয়েন্দা নজরদারি জারি রেখে এক ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে।
তিনি পিসিপি’র শিক্ষা সংক্রান্ত ৫ দফা অবিলম্বে বাস্তবায়নের দাবি জানিয়ে বলেন, সরকার ৫টি জাতিসত্তার মাতৃভাষায় প্রাক-প্রাইমারি লেভেলে মাতৃভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম চালু করলেও শিক্ষক সংকট ও উপযুক্ত প্রশিক্ষণের অভাবে তা মুখ থুবড়ে পড়ার উপক্রম হয়েছে। আর বাংলাদেশে শুধু ৫টি জাতিসত্তা বসবাস করে না, এখানে ৪৫টির অধিক ভিন্ন ভাষাভাষী জাতিসত্তা রয়েছে। তাই সকল জাতিসত্তার মাতৃভাষায় শিক্ষা লাভের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
তিনি শাসকগোষ্ঠির সকল ষড়যন্ত্র, দমন-পীড়ন মোকাবেলা করে জাতির অস্তিত্ব রক্ষা ও অধিকার আদায়ের আন্দোলন জোরদার করার জন্য পিসিপি’র পতাকাতলে সমবেত হওয়ার জন্য ছাত্র সমাজের প্রতি আহ্বান জানান।
সমাবেশ শেষে একটি র্যালি বের করা হয়। এতে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তিন শতাধিক শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করেন।
সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।
সিএইচটি নিউজের ইউটিউব চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব করুন