পূর্ণস্বায়ত্তশাসন দাবি মেনে সরকারকে পাহাড়ের সমস্যার স্থায়ী সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে

“জুলাই অভ্যুত্থানের ফসল আত্মসাৎ, বিষাক্ত ফণা তুলেছে ইউনুসের নব্য ফ্যাসিবাদ; পাহাড়-সমতলে গণতান্ত্রিক শক্তি এক হও” শ্লোগানে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ১ বছরপূর্তি উপলক্ষে ‘অবিলম্বে পূর্ণস্বায়ত্তশাসন দাবি মেনে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার স্থায়ী সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণের দাবিতে’ চট্টগ্রামে বিক্ষোভ সমাবেশে করেছে ইউপিডিএফভুক্ত তিন সংগঠন।
আজ শুক্রবার (৮ আগস্ট ২০২৫) বিকাল ৪টায় বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম ও হিল উইমেন্স ফেডারেশন-এর চট্টগ্রাম মহানগর ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখাসূহের যৌথ উদ্যোগে চট্টগ্রাম নগরের ডিসি হিল গেইট থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়। মিছিলটি প্রেস ক্লাব থেকে ঘুরে চেরাগী মোড়ে এসে সমাবেশে মিলিত হয়।
মিছিলে অংশগ্রহণকারীরা ‘হাসিনা ফ্যাসিবাদের দোসর, সন্তু লারমা আঞ্চলিক পরিষদে কেন?’, ‘পাহাড়ে তিন আপদ: সেনা শাসন, ইউনুসের নব্য ফ্যাসিবাদ ও সন্তুর ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত’ লেখা ফেস্টুন প্রদর্শন করেন।

মিছিল পরবর্তী সমাবেশে অংহ্লাচিং মারমার সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি ভূবন চাকমা, হিল উইমেন্স ফেডারেশন কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক রিতা চাকমা, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন চট্টগ্রাম মহানগর শাখার সভাপতি সাইফুর রূদ্র, গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিল চট্টগ্রাম জেলার সভাপতি ধ্রুব বড়ুয়া, বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ চট্টগ্রাম মহানগর সভাপতি সোহেল চাকমা। সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম চট্টগ্রাম মহানগর শাখার ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শুভ চাক।
ভূবন চাকমা বলেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক থেকে শুরু করে সকল পেশার মানুষ মানুষ অংশগ্রহণ করেছিল। বাঙালি জাতি ব্যতীত পাহাড়ি জাতিসত্তার অধিকারকামী রাজনৈতিক সংগঠন ইউপিডিএফ এবং তার সহযোগী সংগঠনগুলো জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী সরকার পতনের পর ৮ আগস্ট ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের ১ বছরের পরও দেশের সমতলে কিছু দৃশ্যমান পরিবর্তন হলেও পাহাড়ে কোন পরিবর্তন আসেনি। সেখানে এখনো বহাল তবিয়তে সেনাশাসন জারি রয়েছে। গণতান্ত্রিক পথকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। গত ৫ই আগস্ট খাগড়াছড়িতে ইউপিডিএফের শান্তিপূর্ণ মিছিলে সেনা মদদপুষ্ট সন্ত্রাসীরা হামলা ও গুলি করেছে। অথচ সেখানে পুলিশ বাহিনী ছিলো, ৫০০ গজের মধ্যে সেনাবাহিনীর খাগড়াছড়ি ক্যান্টনমেন্ট ছিল। পুলিশ ও সেনাবাহিনী হামলার সময় নীরব ভূমিকা পালন করে। পাহাড়ে তারা ‘সন্ত্রাসী’ খোঁজে যৌথ অভিযান পরিচালনা করে, কিন্তু তাদের সামনে সন্ত্রাস চললেও তারা তা দেখে না।

রিতা চাকমা বলেন, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকার দীর্ঘ ১৫ বছরের অধিক সমতল এবং পাহাড়ে তান্ডব চালিয়েছে। ফ্যাসিবাদ বিরোধী লড়াইয়ে আমরা সক্রিয় ছিলাম। জুলাই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন হলে আমরা ভেবেছিলাম দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হবে। পাহাড়ে জাতিসত্তার সাংবিধানিক স্বীকৃতি এবং সেনাশাসনের অবসান ঘটবে। কিন্তু জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পরপরই পাহাড়ে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটে। খাগড়াছড়িতে সেনাবাহিনীর গুলিতে জুনান চাকমা, রুবেল ত্রিপুরা ও নির্যাতনে ধন রঞ্জন চাকমা নিহত হন। রাঙামাটিতে সেটলাররা নৃশংস হামলা চালয়ে অনিক চাকমাকে হত্যা করে।
তিনি আরো বলেন, সেনাবাহিনী যৌথবাহিনী অভিযান নাম দিয়ে প্রতিনিয়ত সাধারণ পাহাড়িদের হয়রানি করছে। জুম্ম মা-বোনের ধর্ষণ-নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। ২০১৮ সালে সেনাবাহিনী অভিযানের নামে বিলাইছড়িতে দুই মারমা বোনকে ধর্ষণ ও নিপীড়ন করেছিল। গত জুন মাসে খাগড়াছড়িতে ৬ জন সেটলার কর্তৃক সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে এক ত্রিপুরা কিশোরী। উন্নয়নের নাম দিয়ে পাহাড়িদের ভূমি বেদখল করা হচ্ছে। এমন উন্নয়ন পাহাড়িরা চায় না। পাহাড়িরা সুস্থ ও নিরাপদ জীবন চায়। তার জন্য স্বায়ত্তশাসনের বিকল্প নেই। তাই পূর্ণস্বায়ত্তশাসন দাবি মেনে সরকারকে পাহাড়ের সমস্যাকে স্থায়ী সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে।
সাইফুর রুদ্র বলেন, ৭২’র সংবিধানে যে একক বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তা আজও বহাল আছে। বহুবার সংস্কারের কথা বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে সেখানে বহুত্ববাদ বা ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর অধিকার ও স্বীকৃতির জায়গা তৈরি হয়নি। পাহাড়ে এখনো কার্যত সেনাশাসন বহাল রয়েছে, যার মাধ্যমে রাষ্ট্র পাহাড়িদের কণ্ঠকে স্তব্ধ রাখতে চায়। ঢাকায় সেটলারদের ‘স্টুডেন্ট ফর সভারেন্টি’ নামে এক ভূঁইফোড় সংগঠন পাহাড়িদের আন্দোলনে হামলা করেছিল। কিন্তু আমরা দেখি পুলিশ প্রশাসন সেখানে নীরব থেকেছে।

তিনি বলেন, পাহাড়িরা তাদের অধিকার আদায়ে রাজপথে মিছিল সমাবেশ করছে। এ ধরনের সমাবেশ শুধু একদিনের প্রতীকী প্রতিবাদ নয়, বরং এটি রাষ্ট্রকে এক প্রশ্নবিদ্ধ অবস্থানে দাঁড় করায়। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পার হয়ে গেলেও কেন এখনো জাতিসত্তার স্বীকৃতি নেই? কেন সংবিধান সংস্কারের নামে কেবল কথার ফুলঝুরি দেখা যায়? এই আন্দোলন কেবল পাহাড়ি জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম নয়, এটি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। পাহাড় ও সমতলের গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর ঐক্য আজ সময়ের দাবি।
ধ্রুব বড়ুয়া বলেন, কল্পনা চাকমা যে শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন আজ তা বাস্তব হয়েছে। পাহাড়ে পরীক্ষামূলকভাবে যে দমন-পীড়ন চালানো হয়েছিল তা সমতলেও এসেছে। ১৯৯৬ সালে কল্পনা চাকমা সেনাবাহিনীর দ্বারা অপহৃত হন। আজও তার কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। এ ঘটনা শুধু একটি ব্যক্তির নিখোঁজ হওয়ার কাহিনি নয়, বরং তা রাষ্ট্রীয় দমননীতির প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাহাড়ে আজও কার্যত সেনাশাসন চলছে। সেখানে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর উপর দমন-পীড়ন, ধর্ষণ, গুম চলছেই। বম জনগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করার রাষ্ট্রীয় প্রয়াস মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন বলে তিনি মন্তব্য করেন।

তিনি এই শাসন ব্যবস্থাকে “পুঁজিবাদী মালিকদের প্রতিনিধি” হিসেবে আখ্যা দিয়ে আরো বলেন, সরকার জনগণের পক্ষে নয়, বরং শোষক শ্রেণির স্বার্থ রক্ষায় নিয়োজিত। রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে পাহাড়িদের উপর যে নির্যাতন চালানো হচ্ছে তা একটি নব্য ফ্যাসিবাদী শাসনের চেহারা স্পষ্ট করে।
এ অপশাসন নিরসনের একমাত্র পথ হল পাহাড় ও সমতলের নিপীড়িত জনগণের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন। এ আন্দোলন শুধু পাহাড়িদের অধিকারের জন্য নয়, এটি বাংলাদেশের প্রতিটি প্রান্তে বসবাসরত নিপীড়িত জনগণের মুক্তির লড়াই।
সোহেল চাকমা বলেন, রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে এখনো কোনো মৌলিক পরিবর্তন হয়নি। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তির মুহূর্তে যখন জনগণ প্রত্যাশা করেছিল শাসনব্যবস্থায় রূপান্তরের তখন ইউনুস সরকারের ঘোষিত ‘জুলাই ঘোষণা’ পত্রে পাহাড়িদের অধিকারের প্রশ্নকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে একটি সংকুচিত রাজনৈতিক প্রস্তাবনা উপস্থাপন করা হয়েছে। পাহাড়িদের কথা এই ঘোষণাপত্রে স্থান পায়নি। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে যে সংলাপ প্রক্রিয়া চালানো হয়েছে মাঝখান থেকে তাতে ইউপিডিএফের মতো গুরুত্বপূর্ণ পক্ষকে বাদ দিয়ে পাহাড়ি জনগণের কণ্ঠকে নীরব করে রাখার চেষ্টা হয়েছে। যা প্রমাণ করে এই রাষ্ট্রব্যবস্থা পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে সমান নাগরিক হিসেবে মূল্যায়ন করতে আগ্রহী নয়।

তিনি আরো বলেন, আজো সেনাবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামে কার্যত একচ্ছত্র ক্ষমতায় শাসন চালাচ্ছে। যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক না কেন, পাহাড়ে সেনাশাসন বহাল থাকে। এই চিত্র বাংলাদেশের রাষ্ট্রের একটি চিরস্থায়ী সামরিকীকরণের চিত্র তুলে ধরে। যৌথ অভিযান বা নিরাপত্তা অভিযানের নামে পাহাড়ি জনগণের উপর হয়রানি, নিপীড়ন চালানো হচ্ছে।
তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা শুধু আঞ্চলিক সমস্যা নয়, বরং এ সমস্যাকে জাতীয় রাজনৈতিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা দরকার। আর এ সমস্যার একমাত্র রাজনৈতিক সমাধান হতে পারে পার্বত্য চট্টগ্রামে পূর্ণস্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে।
সভাপতির বক্তব্যে শুভ চাক বলেন, পাহাড়ের অধিকারের কথা বললেই আমাদের উপর নেমে আসে গ্রেফতার, হামলা ও দমন-পীড়নের বুলডোজার। এটি কেবল একটি বিশেষ অঞ্চল নয়, রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের পরীক্ষাগার হয়ে উঠেছে পার্বত্য চট্টগ্রাম। ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পরও পার্বত্য চট্টগ্রামে কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন আসেনি। তা প্রমাণ করে বর্তমান রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ধারাবাহিক ফ্যাসিবাদী প্রকৃতি। গত ৫ই আগস্ট ইউপিডিএফের একটি শান্তিপূর্ণ মিছিলে সেনাসমর্থিত সন্ত্রাসীরা গুলি চালায়। অথচ ঘটনাস্থল থেকে মাত্র ৫০০ গজের দূরত্বে ছিলো সেনা ক্যান্টনমেন্ট। ঘটনাস্থলের আশেপাশে পুলিশের উপস্থিতিও ছিল। তবু প্রশাসনের কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ বা হস্তক্ষেপ দেখা যায়নি। এই নিস্ক্রিয়তা ইঙ্গিত করে সন্ত্রাসীরা কার্যত রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় কাজ করছে।
তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে চলমান সেনাশাসন শুধুই একটি সামরিক উপস্থিতি নয়, বরং এটি পাহাড়িদের জীবনযাত্রা, সংস্কৃতি ও রাজনীতিকে স্তব্ধ করে দেওয়ার এক নিষ্ঠুর ও পদ্ধতিগত রাষ্ট্রীয় কৌশল। এই সেনা শাসনের অবসান ঘটাতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাকে জাতীয় রাজনৈতিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে পূর্ণস্বায়ত্তশাসন দিতে হবে। সব জাতিসত্তার সাংবিধানিক স্বীকৃতি নিশ্চিত করতে হবে।
সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।