প্রথম আলোর খবর
ফাইতংয়ের পাহাড়টি কেটে প্রায় শেষ
বুদ্ধজ্যোতি চাকমা, বান্দরবান

বান্দরবানের লামা উপজেলার ফাইতং ইউনিয়নের তিনটি ওয়ার্ডে গড়ে উঠেছে ৩০টি ইটভাটা। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে, পাড়ার পাশে, খালের তীরে, সড়কের ধারে ইটভাটাগুলোর অবস্থান। সব কটি অবৈধ। আর এসব ইটভাটায় ইট তৈরির জন্য পাহাড় কেটে ধ্বংস করা হচ্ছে। পাহাড় কাটার যন্ত্র (এক্সকাভেটর) দিয়ে দিন-রাতে অবিরাম চলছে পাহাড় কাটা। যন্ত্রের গর্জনে ও ধুলাবালুতে বিষিয়ে উঠছে এলাকাবাসীর জীবন।
ফাইতংয়ের মে অংপাড়ার একটি পাহাড় কয়েক বছর ধরে কাটতে কাটতে এখন প্রায় শেষ হওয়ার পথে। এখন যেভাবে দিন-রাত অবিরাম পাহাড়টি কাটা হচ্ছে, তাতে এ বছর আর পাহাড়টির অস্তিত্ব থাকবে না বলে মনে করছেন এলাকাবাসী।
শুধু ফাইতং ইউনিয়নের তিনটি ওয়ার্ডে ৩০টি অবৈধ ইটভাটা থাকার তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান জালাল আহমদ।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, বর্ষা মৌসুম এলেই ইটভাটার জন্য পাহাড় কাটা শুরু হয়। গত বছর বর্ষা মৌসুমেও পাহাড় কাটা হয়েছে। এরপর বেশ কয়েক মাস বন্ধ থাকার পর আবার শুরু হয়েছে পাহাড় কাটা।
ফাইতং ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ড শিবাতলিপাড়া ও মে অংপাড়া, ৮ নম্বর ওয়ার্ডের লম্বাশিয়া, বড়খোলা এলাকায় ঘুরে সব কটি ইটভাটায় অবাধে পাহাড় কাটতে দেখা গেছে। সবচেয়ে বেশি কাটা হচ্ছে শিবাতলি ও মে অংপাড়া এলাকার চারটি ইটভাটায়। মে অংপাড়াসংলগ্ন উত্তর পাশের বিশাল পাহাড়ে দুটি এক্সকাভেটর লাগানো হয়েছে। সেখানে পিবিসি ইটভাটায় পাহাড় কাটার কাজে নিয়োজিত বেলাল উদ্দিন নামের এক ব্যক্তি বলেছেন, এক সপ্তাহ আগে পাড়াবাসীর সঙ্গে বোঝাপড়া করে তাঁরা পাহাড় কাটার কাজ শুরু করেছেন।
মে অংপাড়ার বাসিন্দা উসিংমং মারমা ও কাইনতিং মারমা বলেছেন, শুধু এ বছর নয়, কয়েক বছর ধরে কাটতে কাটতে পাড়ার পাহাড়টি এখন প্রায় শেষ হওয়ার পথে।
যেভাবে দিন-রাত অবিরাম কাটা হচ্ছে, তাতে এ বছর আর এ পাহাড়ের অস্তিত্ব থাকবে না। পাহাড়টি পাড়াবাসীকে কালবৈশাখী ও ঘূর্ণিঝড় থেকে রক্ষা করত। ইটভাটার মালিকেরা প্রভাবশালী। পাহাড় কাটতে বাধা দিলে তাঁরা মামলা-হামলার হুমকি দেন। পাহাড় কাটার দুদিন আগে উঁচু ঝরনা থেকে নিয়ে আসা পাড়াবাসীর পানি লাইন কেটে দেওয়া হয়েছে।

শিবাতলিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে অবস্থিত আরেকটি ইটভাটায় মাটি স্তূপ করা হচ্ছে। ৮ নম্বর ওয়ার্ডের লম্বাশিয়া, বড়খোলা এলাকা ১০টি ইটভাটা পাহাড় ও পাদদেশ কেটে করা হয়েছে।
পাড়াবাসী অংহ্লাচিং মারমা ও সাবেক ইউপি সদস্য এমংচিং বলেছেন, এখানে ইটভাটা আর পাহাড় কাটা সমার্থক। আর কয়েক দিন পর ইট তৈরির জন্য ইটভাটার চুল্লি জ্বলবে, শত শত শ্রমিক কাজ করবেন, পাহাড় কাটার এক্সকাভেটর ও ট্রাকের গর্জন শুরু হবে। তখন সমস্ত এলাকা আরও বেশি ধোঁয়া এবং ধুলাবালুতে আচ্ছন্ন হয়ে উঠবে।
ফাইতং মৌজার হেডম্যান (মৌজাপ্রধান) উম্রামং মারমা বলেছেন, তাঁর এক মৌজা নিয়ে ফাইতং ইউনিয়ন। এতে ৭ নম্বর ওয়ার্ডে ১২টি, ৮ নম্বরে ১০টি ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডে ৮টি ইটভাটায় কমবেশি সব কটিতে পাহাড় কাটা শুরু হয়েছে। এ তিনটি ওয়ার্ডের প্রায় এক–দশমাংশ জমি ইটভাটাগুলোর দখলে রয়েছে। একটি ইটভাটা ছাড়া ২৯টি ইটভাটায় পাহাড় কেটে ইট তৈরি করা হয়।
ফাইতং ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি মুক্তার আহমদ দাবি করেছেন, সব ইটভাটায় পাহাড় কাটা হয় না। কয়েকটিতে এলাকাবাসী সঙ্গে বোঝাপড়া করে ধানি জমির জন্য কিছু পাহাড় কাটা হচ্ছে। মে অংপাড়ার পাহাড়ও সেভাবে কাটা হচ্ছে। এতে পরিবেশের কোনো ক্ষতি হচ্ছে না বলে তিনি মনে করেন।
পরিবেশ অধিদপ্তর বান্দরবানের সহকারী পরিচালক সামিউল আলম কুরসী বলেছেন, ‘ফাইতংয়ের ৩০টিসহ বান্দরবানের একটি ইটভাটারও বৈধতা নেই। ফাইতংয়ের ইটভাটাগুলোয় পাহাড় কাটার সংবাদ পাওয়া গেছে। কিন্তু ঘটনাস্থল অনেক দূরে হওয়ায় এখনো যাওয়া হয়নি।’
লামা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. রেজা রশিদ বলেছেন, ফাইতং ইউনিয়নে একটি ইটভাটারও বৈধতা নেই। আর ইটভাটা মানে পাহাড় কাটা। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ পাওয়ার পর তাঁরা ব্যবস্থা নিতে পারবেন বলে জানিয়েছেন।
সূত্র: প্রথম আলো অনলাইন সংস্করণ, ৯ সেপ্টেম্বর ২০২০