বন্দুকভাঙার মারিচুকে সেনাদের অবস্থান: জনগণের ভোগান্তি

0

মারিচুকে কিরণ জ্যোতি চাকমার বাড়ি। বর্তমানে তার বাড়িটি দখল করে সেখানে সেনা সদস্যরা অবস্থান করছে।


রাঙামাটি প্রতিনিধি, সিএইচটি নিউজ
রবিবার, ২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

রাঙামাটি সদর উপজেলার বন্দুকভাঙা ইউনিয়নে মারিচুক পাহাড়ে গ্রামবাসীর জমি ও বাড়ি বেদখল করে সেনাবাহিনীর অবস্থানের কারণে এলাকার সাধারণ জনগণের চরম ভোগান্তি দেখা দিয়েছে।

গত ১ জানুয়ারি থেকে ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত বন্দুকভাঙা-মারিচুক-যমচুক রেঞ্জের বিভিন্ন গ্রামে সেনাবাহিনী অপারেশন চালায়। ২ জানুয়ারি সেনাদের একটি দল মারিচুক পাহাড়ে যায় এবং সে পর থেকে তারা সেখানে অবস্থান করছে।

সেনা সদস্যরা মারিচুকে অবস্থানের জন্য সেখানে দুই ব্যক্তির বাড়ি জোরপূর্বক দখল করে নেয়। এরা হলেন শান্তি কুমার চাকমার দুই ছেলে কিরণ জ্যোতি চাকমা ওরফে রাইচ্যা (৪৫) ও দেব জ্যোতি চাকমা (৪০)।

কয়েকদিন আগে দেবজ্যোতি চাকমার বাড়ি ফিরিয়ে দেয়া হলেও, সেনারা কিরণ জ্যোতি চাকমার বাড়িটি এখনও নিজেদের দখলে রেখেছে। ফলে তার পরিবারটি এখন অন্যের বাড়িতে উদ্বাস্তুর মতো বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছে।

বর্তমানে ৪০-৪৫ জন সেনা সদস্য মারিচুকে অবস্থান করছে। কিরণ জ্যোতি চাকমার বাড়ি ছাড়াও, তারা থাকার জন্য তার বাড়ির পাশের জমিতে তাঁবু খাটিয়েছে।

সেনারা প্রতিদিন এলাকায় টহলের নামে জনগণকে হয়রানি করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। অনুমতি ছাড়া এলাকার কাউকে বাইরে যেতে দেয়া হচ্ছে না, আবার বাইরে থেকে তাদের আত্মীয় স্বজনদেরকেও এলাকায় আসতে দেয়া হচ্ছে না। এক কথায় মারিচুকের গ্রামবাসীদেরকে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে এখন অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। নিজ এলাকায় তারা বন্দীর মতো জীবন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন।

খেত, বাড়ির জিনিপত্র নষ্ট

কিরণ জ্যোতি চাকমা তার বাড়ির পাশে করলা, মূলা, লাল শাক, মরিচ, টমেটোসহ বিভিন্ন সবজির চাষ করেন। সেনারা তার এই সবজি খেত নষ্ট করে দিয়েছে। শুধু তাই নয়, তারা বাচ্চাদের স্কুলের ড্রেসসহ কাপড়-চোপড় ও ছোট সাইজের হাড়ি পাতিল নষ্ট করে দিয়েছে।

তবে কম্বল, লেপ ও বড় সাইজের হাড়ি-পাতিলগুলো সেনারা ব্যবহার করছে। বাড়ির লোকদের কাপড়-চোপড় পা মোছার কাজে ব্যবহার করছে।

এছাড়া সেনারা কিরণ জ্যোতি চাকমার ৪টি মুরগি খেয়ে দেয়, দাম দেয় মাত্র দুই হাজার টাকা, যা বাজার দরের অর্ধেক।

কিরণ জ্যোতি চাকমার বাড়ির কাছাকাছি আরও নয়টি বাড়ি রয়েছে। সেনারা এক বাড়ির লোককে অন্য বাড়িতে যেতে দেয় না। সারাক্ষণ জিজ্ঞাসাবাদের নামে হয়রানি করে। বাইরে কোথাও যেতে হলে তাদের অনুমতি নিতে হয়।

বাধ্যতামূলক শ্রম

সেনাবাহিনী তাদের মালামাল মারিচুক পাহাড়ে নেয়ার জন্য এলাকার লোকজনকে বাধ্য করছে। ফলে গ্রামবাসীদেরকে নিজেদের জরুরী কৃষি ও অন্যান্য কাজ ফেলে রাখতে হচ্ছে। মালামাল পরিবহনের জন্য বর্তমানে সামান্য পারিশ্রমিক দেয়া হলেও, প্রথমদিকে তাদেরকে বেগার খাটানো হয়েছে, কোন পারিশ্রমিক দেয়া হয়নি।

সেনারা তাদের মালামাল নিয়ে যাওয়ার জন্য দুটি পথ ব্যবহার করে। একটি হলো খারিক্ষং আর্মি ক্যাম্প থেকে কুড়ামাড়া, তংতুল্যা, মাচ্ছ্যাপাড়া, বাকছড়ি ও অগৈছড়া হয়ে। অন্যটি রাঙামাটি থেকে বোট যোগে মাচ্ছ্যাপাড়া হয়ে।

খারিক্ষং ক্যাম্প থেকে মারিচুকের দূরত্ব ১৫/১৬ কিলোমিটার। আর মাচ্ছ্যাপাড়া থেকে মারিচুকের দূরত্ব ৮ কিলোমিটার। মাচ্ছ্যাপাড়া থেকে মারিচুকে যেতে হলে বাকছড়ি, অগৈছড়া ও ডেবাছড়া হয়ে যেতে হয়।

গ্রামবাসীদেরকে সপ্তাহে ৩/৪ বার সেনাদের মালামাল বহন করতে হয়। প্রতিবার ১৬-১৮ জনকে নিযুক্ত হতে হয়।

এখন এলাকায় ধান চাষের ও হলুদ তোলার মৌসুম। কাপ্তাই বাঁধের পানি কমে যাওয়ার সাথে সাথে ধানের চারা রোপন করতে হয়। অন্যদিকে খেত থেকে হলুদ তুলে সেগুলো বিক্রির জন্য প্রস্তুত করতে অনেক পরিশ্রমের দরকার হয়। অথচ সেনাদের কাজে নিযুক্ত থাকতে হচ্ছে বলে গ্রামবাসীরা তাদের আসল কাজ করতে সক্ষম হচ্ছে না। ফলে তারা আর্থিকভাবে চরম ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।

আজ পর্যন্ত মাচ্যাপাড়ার বিশ্বস্বর চাকমা, পল্টু চাকমা, সাগর চাকমা, কেবল মনি চাকমা, ওগোইছড়ির রিপ্পো চাকমা, শান্তিপ্রিয় চাকমা ও বাকছড়ি গ্রামের নিতু চাকমাসহ অনেককে মারিচুকে সেনাবাহিনীর মালামাল পরিবহনের কাজ করতে হয়েছে।

নিরাপত্তাজনিত কারণে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন জানিয়েছেন, মারিচুকে আর্মিরা অবস্থান নেয়ার পর থেকে তারা দুরাবস্থার মধ্যে রয়েছেন।

তিনি বলেন, ‘অনিচ্ছা সত্বেও নিজের কাজ ফেলে আর্মিদের মালপত্র বহন করে দিতে হয়। খেতে হলুদ এখনো মাটির নিচে পড়ে রয়েছে, সেগুলো তুলতে পারছি না।’

মারিচুকে সেনাদের অবস্থানের কারণে এলাকায় জেএসএসের সশস্ত্র সদস্যদের আনাগোনা, হুমকি ও চাঁদাবাজি বৃদ্ধি পেয়েছে বলে তিনি মনে করেন।

তিনি মারিচুক থেকে সেনাদের সরিয়ে নিয়ে এলাকার জনগণকে বন্দীদশা ও ভোগান্তি থেকে মুক্তি দেয়ার জন্য সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানান।


সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।


This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More