বর্বরোচিত লোগাঙ গণহত্যার ৩৩ বছর: এখনো হয়নি বিচার!

0

লোগাঙ পোড়াভিটায় শহীদের স্মরণে নির্মিত অস্থায়ী স্মৃতিসৌধ। ফাইল ছবি


বিশেষ প্রতিবেদন, সিএইচটি নিউজ
বৃহস্পতিবার, ১০ এপ্রিল ২০২৫

পার্বত্য চট্টগ্রামে এক বিভীষিকাময় দিন ১০ এপ্রিল। বর্বরোচিত লোগাঙ গণহত্যা দিবস। ১৯৯২ সালের এই দিনে রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও সেটলার বাঙালিরা খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়ির লোগাঙে পাহাড়িদের গুচ্ছগ্রামে বর্বর গণহত্যা চালায়। ‘শান্তিবাহিনী’ কর্তৃক কবির হোসেন নামের এক বাঙালি রাখাল বালককে হত্যার মিথ্যা অভিযোগে তারা এ গণহত্যা সংঘটিত করে। 

সেনা-বিডিআর ও সেটলারদের যৌথ হামলায় সেদিন কয়েকশ’ (ধারণা ১২শ’র অধিক) পাহাড়ি হতাহত হয়। অনেকে নিঁখোজ হয়ে যায়। সেদিন শিশু, বৃদ্ধ, নারী কেউই রেহাই পায়নি। অগ্নিসংযোগ করে ছাই করে দেওয়া হয় পাহাড়িদের ৭ শতাধিক ঘরবাড়ি। 

বর্বরোচিত এ গণহত্যার আজ (১০ এপ্রিল ২০২৫) ৩৩ বছর পূর্ণ হলেও বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও এদেশের শাসকগোষ্ঠি-সরকার এ ঘটনার বিচার ও দোষীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক কোন পদক্ষেপ নেয়নি।

সেদিন (১০ এপ্রিল ’৯২) রাষ্ট্রীয় বাহিনীর প্রত্যক্ষ সহযোগীতায় শত শত সেটলার বাঙালি দা, বর্শা, কুড়াল দিয়ে নিরীহ পাহাড়িদের উপর ঝাপিয়ে পড়ে। এতে বর্শাবিদ্ধ হয়ে, দা ও কুড়ালের কোপে প্রাণ হারায় অনেক পাহাড়ি। আর যারা পালানোর চেষ্টা করে তাদের গুলি করে হত্যা করে সেনা, বিডিআর ও ভিডিপি সদস্যরা। বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করা হয়। পুড়ে ছাই হয়ে যায় জুম্মদের প্রায় সাত শতাধিক ঘরবাড়ি। প্রায় তিন ঘন্টা ধরে এই তান্ডবলীলা চালানো হয়। হত্যাযজ্ঞের পর কাউকে লাশ হস্তান্তর করা হয়নি। রাতের আঁধারে অনেক লাশ গুম করে ফেলা হয়। ফলে প্রকৃতপক্ষে মোট কতজন নিহত হয়েছেন তা আজো অজানা রয়ে গেছে।  

গণহত্যায় জড়িতদের মধ্যে যাদের নাম পাওয়া যায়- ১। মঙ্গল মিয়া, ২। মনু মিয়া ও তার দুই ছেলে দুলাল্যা ও মোঃ আরিফ, ৩। কাজী হানিফ (ইউপি মেম্বার), ৪। বাসার (মেম্বার ভাই), ৫। কিরণ ভুঁইয়া ইউপি চেয়ারম্যান পীং আব্দুল আজিজ ভুঁইয়্যা (দলনেতা) , ৬। মেজর গনি – পুজগাং শুকনাছড়ি সাবজোন কমাণ্ডার, ৭। রাধীকা শাহ্ পীং নুরুল ইসলাম মোল্লা, ৮। মোঃ ইলিয়াস , ৯। মোঃ শামসু, ১০। মোঃ খনা (শামসুর ভাই), ১১। হারাধন সাহা, ১২। পুতুল সাহা (হারাধনের ছেলে), ১৩। জাকির আনসার, পীং আবুল হোসেন, ১৪। কেরামত আলী (ভিডিপি কমাণ্ডার), ১৫। ইউসুপ (আনসার), ১৬। সফিউল, ১৭। আব্দুল মোতালেব (বিডিআর), ১৮। দুলাল মিয়া (আনসার), ১৯। কাসেম (আনসার), ২০। জনাব আলী, ২১। ইদ্রিস মোল্লা পীং নুরুল ইসলা মোল্লা (অনু), ২২। শাহীন ভিডিপি,  ২৩। মোঃ সুমন (ভিডিপি), ২৪। মো. দুলু, ২৫। মোঃ বেলাল (আনসার), ২৬। ভাণ্ডারী,  ২৭। আলী আহম্মেদ, ২৮। শাহ্ জালাল, ২৯। জ্যোল্যা, ৩০। জামশেদ ভুঁইয়া পীং আব্দুল আজিজ ভুঁইয়া, ৩১। হাবিলদার জলিল (আনসার সদস্য), ৩২। আবু জাহেদ পীং মৃত আব্দুল গফুর, ৩৩। আবুল হাশেম কাজী পীং আলী আহমদ, ৩৪। সিদ্দিকুর রহমান (আনসার পি.সি), ৩৫। এসহাফ মিয়া পীং মৃত আবু আহমদ, ৩৬। নুরুন্নবী পীং সামসুল হক, ৩৭। নূর মোহাম্মদ পীং বারু মিয়া, ৩৮। আজাদ মিয়া পীং মংগল মিঞা, ৩৯। আমীর আলী পীং মোঃ হাসান আলী, ৪০। সুক্কর আলী ভুঁইয়্যা পীং সৈয়দ আলী ভুঁইয়্যা, ৪১। মধুমিয়া পীং আব্দুল রহিম, ৪২। খায়ের আলী পীং মোঃ নায়ের আলী, ৪৩। কোরবান আলী পীং সৈয়দ আলী, ৪৪। মিন্টুমিয়া পীং মজলিশ মিয়া, ৪৫। হাসান আলী পীং খয়ন মিয়া, ৪৬। আবুল জলিল পীং আনু মিয়া, ৪৭। কামাল হোসেন পীং আবু জাহের, ৪৮। হাবিবুল্লাহ পীং আব্দুল রহিম(মেম্বার), ৪৯। লোকমান (আনসার), ৫০। সুলতান কাজী (আনসার), ৫১। লোকমান, ৫২। জাকের মিয়া, ৫৩। জলফু, ৫৪। শাহ জাহান, ৫৫। আলী আহম্মেদ, ৫৬। মোঃ হাইরে, ৫৭। সুবেদার হাবিবুর রহমান, ৫৮। নায়েক সুবেদা সোহর হোসেন, ৫৯। এ, সি, পি নূর, ৬০। পি, সি অলি রহমান। (সূত্র: রাডার লোগাঙ গণহত্যা সংখ্যা)।

এ গণহত্যার ঘটনা তদন্তে তৎকালীন সরকার অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি সুলতান হোসেন খানকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। ঘটনার ছয়মাস পর কমিটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বাংলায় একটি প্রতিবেদন দাখিল করলেও সেটি জনসম্মুখে প্রকাশ করা হয়নি। পরে ইংরেজি ভার্সনে একটি প্রহসনমূলক রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়, যা ছিল মিথ্যাচারে ভরা।   

পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িদের ঐতিহ্যবাহী সামাজিক উৎসব বৈ-সা-বি (বৈসু-সাংগ্রাই-বিঝু…) উৎসবের মাত্র দুই দিন আগে সংঘটিত এ গণহত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে পাহাড়িরা। বর্জন করা হয় বৈ-সা-বি উৎসব।

এই বর্বর গণহত্যার ফলে সে বছর বৈ-সা-বি’র আনন্দ উৎসব শোক সাগরে পরিণত হয়। খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে ১২ ও ১৪ এপ্রিল ’৯২ শোকসভা হয়। উৎসবের মূল দিন (মূল বিঝু) ১৩ এপ্রিল ’৯২ খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে হাজার হাজার লোকের বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকা থেকে আগত রাজনৈতিক  সংগঠনের নেতৃবৃন্দ, মানবাধিকার কর্মী, আইনজীবী, লেখক-সাংবাদিকরাও আনন্দ উৎসবের পরিবর্তে আপামর জনগণের সাথে একাত্ম হয়ে প্রতিবাদ বিক্ষোভে সামিল হয়। খাগড়াছড়ির হাজার হাজার আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সেদিন বাঁধ ভাঙা পানির মতো রাজপথে নেমে সরকারের বর্বরতার প্রতিবাদ জানান। স্বতঃস্ফুর্তভাবে বৈ-সা-বি উৎসব বর্জন করা হয়। নিহতদের সম্মান জানাতে রান্না করা পাজন (মূল উৎসবের দিন হরেক রকমের সবজি দিয়ে তৈরি খাদ্য বিশেষ) চেঙ্গী নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। নিহতদের স্মরণে হাজার প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করা হয়।

লোগাঙ গণহত্যার প্রতিবাদ ও বৈসাবি বর্জন করে ‘সর্বস্তরের জনসাধারণ’র ব্যানারে মিছিল কলেজের কড়ইতলা থেকে চেঙ্গি স্কোয়ারের দিকে অগ্রসর হচ্ছে, ১৩ এপ্রিল ১৯৯২। #ফাইল ছবি


বৈ-সা-বি উপলক্ষে ঢাকা থেকে আগত রাজনৈতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ, মানবাধিকার কর্মী, আইনজীবী, লেখক-সাংবাদিকবৃন্দ ১২ এপ্রিল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করতে যাবার পথে পানছড়ি উপজেলা সদরে সেনাবাহিনী তাদের বাধা প্রদান করে। ফলে তারা ঘটনাস্থলে যেতে পারেননি।

এরপর ঢাকায় ফিরে গিয়ে তারা সংবাদ মাধ্যমে একটি বিবৃতি প্রদান করেন। এতে তারা বলেন, “খাগড়াছড়ি গিয়ে আমরা স্বভাবতঃই ঐ অঞ্চলে যাবার আগ্রহ প্রকাশ করি ঘটনার সত্যাসত্য জানবার দায়িত্ববোধ থেকে। কিন্তু পরের দিন ১২ই এপ্রিল লোগাং যাবার পথে পানছড়িতে আমরা বাধাগ্রস্থ হই এবং আমাদের নিরাপত্তার কথা বলে নিরাপত্তাবাহিনী আমাদের ঘটনাস্থলে যেতে বাধাদান করে। ফিরবার পথে এবং খাগড়াছড়িতে বহু সংখ্যক প্রত্যক্ষদর্শী এবং ঘটনার শিকার ব্যক্তির সঙ্গে আমাদের সাক্ষাৎ হয়। কর্তৃপক্ষীয় বিভিন্ন ব্যক্তির সাথেও এ নিয়ে আমাদের কথা হয়। এ সব কিছু থেকে আমরা এই স্পষ্ট সিদ্ধান্তে উপনীত হই যে, লোগাং গ্রামে একটি গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে। একজন বাঙালি কিশোর নিহত হওয়ার সূত্র ধরে সেখানে চাকমা ও ত্রিপুরা গুচ্ছগ্রামে গ্রাম প্রতিরক্ষা দল ভিডিপি ও আনসার বাহিনী কিছু বাঙালি দুষ্কৃতিকারীর সহযোগিতায় হামলা চালায়। চারশরও বেশি ঘর সেখানে আগুন দিয়ে পোড়ানো হয় এবং শিশু-নারী-বৃদ্ধসহ ২ শতাধিক মানুষকে হত্যা করা হয়। এ বর্বর গণহত্যার বর্ণনা শুনে আমরা স্তম্ভিত হই, এর নিন্দা জানানোর ভাষা আমাদের জানা নেই। এ বর্বর গণহত্যার কারণে পুরো অঞ্চলে পাহাড়ি জনগণের বার্ষিক উৎসবের সকল কর্মসূচি পরিত্যক্ত হয়। আনন্দমুখর জনপদ শোক ও অশ্রুর জনপদে পরিণত হয়। ঘরছাড়া, মা হারানো, বাবা হারানো, সন্তান হারানো নিরীহ দুর্বল দরিদ্র জনগণের সঙ্গে সঙ্গে আমরাও ক্ষুব্ধ। একইসঙ্গে আমরা ক্ষুব্ধ প্রকৃত ঘটনা চেপে রাখার জন্য কর্তৃপক্ষের ন্যাক্কারজনক চেষ্টায়”।

এতে তারা আরো বলেন, “পার্বত্য চট্টগ্রামের খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটিতে পার্বত্য জনগণের উৎসবের অংশীদার হতে গিয়ে আমরা তাঁদের শোকের ও ক্ষোভের অংশীদার হয়েছি। অঞ্চলের জনগণ ও কর্তৃপক্ষের বিভিন্নস্তরে কথা বলে এবং বাস্তব অবস্থা দেখে বুঝেছি সমগ্র এলাকায় কার্যতঃ একটি সামরিক শাসন চলছে। সমগ্র বেসামরিক প্রশাসন আঞ্চলিক সামরিক প্রশাসনের অধীনস্ত এলাকায় সংবাদপত্র বা সাংবাদিকদের কোন স্বাধীন কার্যক্রম নেই। চলাফেরার স্বাধীনতা সাংঘাতিকভাবে সীমাবদ্ধ।”

বিবৃতিতে তারা লোগাঙ হত্যাকাণ্ডের স্বাধীন, নিরপেক্ষ বিচার বিভাগীয় তদন্তসহ ৬ দফা দাবি জানিয়েছিলেন। দাবিগুলো হচ্ছে-
(১) অবিলম্বে লোগাং হত্যাকাণ্ডের স্বাধীন, নিরপেক্ষ বিচার বিভাগীয় তদন্ত করতে হবে। পুরো ঘটনা বিস্তারিতভাবে প্রকাশের ব্যবস্থা করতে হবে এবং দায়ী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। পর্যায়ক্রমে এতদিন যত হত্যাকাণ্ড, ধর্ষণ, নিপীড়ন হয়েছে সেই ঘটনাবলীর বিচার বিভাগীয় তদন্তকার্য পরিচালনা করে সকল তথ্য প্রকাশ করতে হবে ও দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি দিতে হবে।

(২) পার্বত্য চট্টগ্রামে গত ২০ বছরে সৃষ্ট পরিস্থিতি, রাজস্ব ব্যয় ও তার ফলাফল সম্পর্কে শ্বেতপত্র প্রকাশ করতে হবে।

(৩) পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক সমস্যা রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সমাধানের জন্য বলপ্রয়োগের নীতি বর্জন করে বিষয়টিকে সংসদের অধীনস্থ করতে হবে এবং ঐ সংসদে খোলাখুলি আলোচনার ব্যবস্থা করতে হবে।

(৪) সংসদ সদস্য ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন জাতীয় কমিটি গঠন করে তার মাধ্যমে ঐ অঞ্চলের বিভিন্ন ব্যক্তি-গোষ্টি-দল ও সামাজিক শক্তিসমূহের সঙ্গে আলোচনা শুরু করতে হবে এবং ঐ অঞ্চলে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চালু করবার প্রয়োজনীয় পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।

(৫) প্রশাসনকে সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণমুক্ত করে বেসামরিক নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিত্বমূলক প্রশাসন কার্যকর করতে হবে।

(৬) অঞ্চলের সমগ্র জনগণকে হাতেগোণা কিছু লোকের শান্তিবাহিনীর সঙ্গে এক করে দেখার বিদ্যমান দৃষ্টিভঙ্গি বর্জন করতে হবে। ক্ষুদ্র জাতিসত্তাসমূহ যাতে নিজ নিজ ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে এ দেশের সব মৌলিক অধিকার ধারণ করে পূর্ণাঙ্গ নাগরিক হিসাবে বেঁচে থাকতে পারেন সেজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

লোগাং হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ঢাকায় পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের শোক মিছিল, ১৮ এপ্রিল’৯২

হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ ১৮ এপ্রিল ’৯২ ঢাকায় এক শোক মিছিলের আয়োজন করে এবং পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের তৎকালীন সভাপতি প্রসিত বিকাশ খীসার নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে গিয়ে লোগাং হত্যাকাণ্ডের বিচার বিভাগীয় তদন্ত ও দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি প্রদান সম্বলিত একটি স্মারকলিপি প্রদান করেন।

এই বর্বর গণহত্যার প্রতিবাদ এবং নিহতদের উদ্দেশ্যে ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন ও শ্রদ্ধা নিবেদনের লক্ষ্যে ১৯৯২ সালের ২৮ এপ্রিল পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত হয় লোগাং অভিমুখে ঐতিহাসিক মৌন পদযাত্রা। হাজার হাজার নারী-পুরুষ এ পদযাত্রায় অংশ নেন। ঢাকা থেকে আসা রাজনৈতিক দলের নেতা, ছাত্র নেতা, সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী-লেখকরাও পাহাড়ি জনগণের সাথে সংহতি জানিয়ে এই পদযাত্রায় অংশ নেন। সেনাবাহিনীর সকল বাধা-বিঘ্ন অতিক্রম করে সেদিন লোগাং পোড়াভিটায় গিয়ে তারা ফুল দিয়ে নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান।

লোগাঙ অভিমুখে পদযাত্রা, ২৮ এপ্রিল ১৯৯২। ফাইল ছবি

শহীদদের স্মরণে ‘লোগাঙ স্মৃতিস্তম্ভ’ নির্মাণ, পরে সেনা-প্রশাসন তা গুড়িয়ে দেয়

পার্বত্য চট্টগ্রামে শহীদদের স্মরণে প্রথম স্থায়ী স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয় ১৯৯৩ সালের ১০ এপ্রিল অর্থাৎ লোগাঙ গণহত্যার প্রথম বার্ষিকীতে। সেটি স্থাপিত হয় একেবারে খাগড়াছড়ি শহরের গুরুত্বপূর্ণ সংযোগস্থল চেঙ্গি স্কোয়ার সংলগ্ন, সার্কিট হাউসের প্রবেশমুখে বলতে গেলে প্রশাসনের নাকের ডগায়।

১০ এপ্রিল সকাল দশ/এগারটার দিকে পাঁচ-ছয় শ’ ছাত্র-ছাত্রীর মিছিল চেঙ্গিস্কোয়ারে সমাবেশে রূপ নেয়। সংক্ষিপ্ত সমাবেশ শেষে পরিকল্পনা মতো শ্লোগান দিতে দিতে মাইনি ভ্যালি নির্দেশিত সাইনপোস্ট-এর ঢিবিতে স্মৃতিস্তম্ভটি স্থাপিত হয়। তিন গণতান্ত্রিক সংগঠন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, পাহাড়ি গণপরিষদ ও হিল উইমেন্স ফেডারেশন-এর পক্ষ থেকে নেতৃবৃন্দ স্মৃতিস্তম্ভে ফুলের তোড়া দিয়ে সম্মান জানায়। বিকেলে দিকে ঢাকা থেকে আমন্ত্রিত রাজনৈতিক দল, ছাত্র সংগঠন ও সংবাদকর্মীরা ডলফিন বাসযোগে (তখন ডলফিন একমাত্র বাস সার্ভিস) খাগড়াছড়ি এসে পৌঁছে। চেঙ্গিস্কোয়ারে অপেক্ষমান ছিল শত শত ছাত্র ও উৎসুক জনতা। বাস থেকে নেমেই আমন্ত্রিত অতিথিগণ পর্যায়ক্রমে ফুলের তোড়া দিয়ে লোগাঙ স্মৃতিস্তম্ভে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। চেঙ্গিস্কোয়ারে স্থাপিত স্মৃতিস্তম্ভ সেদিন আক্ষরিক অর্থে পার্বত্য চট্টগ্রামের শহীদ মিনারের রূপ পরিগ্রহ করে। এটি হয়ে ওঠে প্রতিবাদী মানুষের আবেগের মূর্ত প্রতীক। ইতিপূর্বে পার্বত্য চট্টগ্রামের কোথাও শহীদদের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ ছিল না। ‘৯২ সালে লোগাঙ পোড়াভিটা হত্যাকাণ্ডস্থলে তাৎক্ষণিকভাবে স্থাপিত হয়েছিল বাঁশের তৈরি অস্থায়ী স্মৃতিস্তম্ভ।

কিন্তু পাকবাহিনীর একুশের শহীদ মিনার গুড়িয়ে দেওয়ার মতোই সেনাবাহিনীও লোগাঙ স্মৃতিস্তম্ভ সহ্য করতে পারেনি। সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ নির্দেশে সেটি ২৫ এপ্রিল ‘৯৩ গুড়িয়ে দিয়ে মাইনি ভ্যালি নির্দেশিত সাইনপোস্টের নাম-নিশানা মুছে ফেলা হয়। খাগড়াছড়িতে বড় কোন বিক্ষোভ যাতে সংগঠিত হতে না পারে, সে লক্ষ্যে ঘটনার পর পনের/বিশ দিন শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে মোতায়েন ছিল দাঙ্গা পুলিশ।

 গণতান্ত্রিক ছাত্র ঐক্যের কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে লোগাঙ হত্যাকাণ্ডে নিহতদের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করা হচ্ছে। চেঙ্গী স্কোয়ার, খাগড়াছড়ি, ১০ এপ্রিল ১৯৯৩। ফাইল ছবি


লোগাঙ হত্যাকাণ্ডে নিহতদের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করছেন জাসদ নেতা নুরুল আম্বিয়া (মাঝে) সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ, ১০ এপ্রিল ১৯৯৩, চেঙ্গী স্কোয়ার, খাগড়াছড়ি।  #ফাইল ছবি 


স্মৃতিস্তম্ভটি নির্মিত হয়েছিল খবংপুজ্জ্যায়। তা ছিল একটি আরসিসি পিলার (Reinforced Cement Concrete pillar). কয়েক দিন ধরে নির্মিত হলেও অন্যদের পক্ষে তা কী, আঁচ করতে পারা সম্ভব ছিল না। গোয়েন্দা সংস্থা তৎপর থাকলেও তারাও ঠাহর করতে পারেনি। পরিকল্পনা জানতেন সংগঠনের মাত্র অল্প ক’জন ব্যক্তি। ঘটনার দিন মিছিল সহকারে ঠেলাগাড়িতে করে আরসিসি পিলারটি চেঙ্গি স্কোয়ারে নেওয়া হয়। আগের দিন সন্ধ্যের দিকে নির্ধারিত স্থানে দু’জন কর্মী স্তম্ভটি স্থাপনের লক্ষ্যে গর্ত খুঁড়ে রাখে। স্থানটি ছিল খাগড়াছড়ি সড়ক ও জনপদ বিভাগের আওতাভুক্ত। প্রশাসন জায়গার মালিকানা দাবি করায় সে নিয়ে দ্বন্দ্ব বাঁধে।

খাগড়াছড়িতে সে সময় ব্রিগেড কমাণ্ডার হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন হাসান মশহুদ চৌধুরী। পরে তিনি সেনা প্রধান হন এবং অবসরের পর ২০০৭-৮ সালে জরুরী অবস্থার সময় দুর্নীতি দমন কমিশনে দায়িত্ব পালন করেন।

ব্রিগেড কমান্ডার স্মৃতিস্তম্ভটি সার্কিট হাউজের মতো স্পর্শকাতর জায়গায় বলে বেশ উদ্বেগ প্রকাশ করতেন। তিনি খাগড়াছড়ি জেলা পিসিপি’র প্রতিনিধি ডেকে স্মৃতিস্তম্ভ সরিয়ে নেওয়ার অনুরোধ জানান। সার্কিট হাউজের বাইরে অন্য কোন স্থানে নির্মিত হলে সহায়তারও আশ্বাস দিয়েছিলেন। স্মৃতিস্তম্ভটি জনগণের এবং স্বাভাবিকভাবে সেটা সরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে পিসিপি অপারগতা জানিয়েছিল।

সেনা কর্তৃপক্ষ খাগড়াছড়ির সড়ক ও জনপদ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী হাবিবুর রহমানকে দিয়ে স্মৃতিস্তম্ভটি সরিয়ে নিতে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, খাগড়াছড়ি জেলা শাখাকে নোটিশ দেয়ার ব্যবস্থা করে। উক্ত নোটিশে ৭ দিনের মধ্যে স্মৃতিস্তম্ভটি সরিয়ে নেওয়ার তাগিদ দেওয়া হয়। কিন্তু উক্ত ৭ দিন অতিবাহিত না হতেই ব্রিগেড কমাণ্ডার হাসান-এর নির্দেশে নির্বাহী প্রকৌশলী হাবিবুর রহমান স্মৃতিস্তম্ভ ভেঙে দিতে বাধ্য হন। তাকে মধ্যরাতে ঘুম থেকে তুলে তার বিভাগীয় বুলডোজার দিয়ে স্মৃতিস্তম্ভটি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। সে সময় ঘটনাস্থলে ব্রিগেড কমাণ্ডার হাসান মশহুদ চৌধুরীসহ খাগড়াছড়ির উর্ধ্বতন সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তারা সেখানে উপস্থিত ছিলেন।

স্মৃতিস্তম্ভটি ভেঙে ফেলায় স্বাভাবিকভাবে বেশ প্রতিক্রিয়া হয়। সর্বস্তরের জনগণ অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। ঘটনার প্রতিবাদে ২৬ মে ’৯৩ ছাত্র-জনতা খাগড়াছড়িতে বিক্ষোভ মিছিল করে স্মৃতিস্তম্ভটি পুনঃনির্মাণ করার ঘোষণা দেয়।

লোগাঙ গণহত্যার দীর্ঘ ৩৩ বছর হয়ে গেলো। এ সময়ে দেশে ক্ষমতার নানা পালাবদল ঘটেছে। কিন্তু কোন সরকারই বর্বর এ গণহত্যার বিচার করেনি। শুধু এই গণহত্যা নয়, পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িদের উপর এ যাবত ডজনের অধিক গণহত্যা ও আরো কয়েক ডজন সাম্প্রদায়িক হামলা সংঘটিত হয়েছে। কিন্তু কোন ঘটনারই বিচার ও দোষীদের শাস্তি হয়নি। ফলে এখনো বার বার সাম্প্রদায়িক হামলার শিকার হতে হচ্ছে পাহাড়ি জনগণকে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ চায় রাষ্ট্র লোগাঙ গণহত্যাসহ এ যাবত পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িদের উপর সংঘটিত সকল গণহত্যার শ্বেতপত্র প্রকাশ করে সুষ্ঠু বিচার করুক। তাই রাষ্ট্রের উচিত এর যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে দায়মুক্ত হওয়া।



This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More