বর্মাছড়িতে বিহারের জায়গায় সেনা ক্যাম্প নির্মাণ প্রচেষ্টার প্রতিবাদে এলাকাবাসীর গণবিক্ষোভ ও স্মারকলিপি পেশ

বর্মাছড়ি প্রতিনিধি, সিএইচটি নিউজ
শুক্রবার, ২৪ অক্টোবর ২০২৫
খাগড়াছড়ির লক্ষীছড়ি উপজেলার বর্মাছড়িতে আর্য কল্যাণ বনবিহারের জমি বেদখল করে সেনা ক্যাম্প নির্মাণ প্রচেষ্টার প্রতিাবদে ও মোতায়েনকৃত সেনাদের প্রত্যাহারের দাবিতে গণবিক্ষোভ করেছে বর্মাছড়ি এলাকাবাসী।
আজ শুক্রবার (২৪ অক্টোবর ২০২৫) সকাল ১১টায় বর্মাছড়ি বাজার মাঠে আয়োজিত এই গণবিক্ষোভে এলাকার দুই হাজারের মতো জনগণ অংশগ্রহণ করে মিছিল ও সমাবেশ করেন।
প্রথমে তারা মিছিল সহকারে বর্মাছড়ি বাজার প্রদক্ষিণ করেন। এরপর বাজার মাঠে সমাবেশে মিলিত হন।
মিছিল ও সমাবেশে তারা ‘সেনা ক্যাম্প চাই না” বলে শ্লোগান দেন এবং ক্যাম্প নির্মাণ বন্ধের দাবিতে বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন করেন।

সমাবেশে এলাকার বিশিষ্ট মুরুব্বী প্রদীপ চাকমার সভাপতিত্বে ও রনেল চাকমার সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন বর্মাছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সুইচালা চৌধুরী, ফটিকছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান উষাতন চাকমা, লক্ষীছড়ি উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান শিউলি মারমা, আর্য কল্যাণ বনবিহার পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক বাবুল চাকমা ও সমাজকর্মী পাইচিউ মারমা। এতে স্বাগত বক্তব্য রাখেন সর্তা-বর্মাছড়ি ভূমি রক্ষা কমিটির নেতা প্রহ্লাদ চাকমা।

সমাবেশে বক্তারা বলেন, বর্মাছড়ি এলাকার পরিস্থিতি পুরোপুরি শান্ত থাকার পরেও কেন এখানে সেনা ক্যাম্প দেওয়া হচ্ছে? এই সেনা ক্যাম্প নির্মাণ করা হলে বর্মাছড়ি এলাকার জনগণ মানবে না। তারা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের জায়গা দখল করে সেনা ক্যাম্প নির্মাণ প্রচেষ্টার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান।
বক্তারা আরো বলেন, রাষ্ট্রীয় বাহিনী জনগণের নিরাপত্তার কথা বললেও আদতে তারা জনগণের ওপর নিপীড়ন-নির্যাতন করে থাকে। ফলে জনগণকে সবসময় সেনাবাহিনীর নিপীড়ন-নির্যাতনের ভয়ে থাকতে হয়। এখনে সেনা ক্যাম্প স্থাপন হলে নারীরা অনিরাপদ হয়ে পড়বে। তারা বিহারে আসা-যাওয়া করতে পারবে না।

সমাবেশ শেষে তারা মিছিল নিয়ে সেনাবাহিনী যেখানে ক্যাম্প নির্মাণের চেষ্টা চালাচ্ছে সেখানে যেতে চাইলে পথিমধ্যে সেখান থেকে কিছুটা দূরত্বে সেনারা বাঁশের আড় দিয়ে ব্যারিকেড দেয়। এতে সেনাবাহিনী ও জনগণের মধ্যে মুখোমুখি অবস্থার সৃষ্টি হয়। এ সময় সেনা সদস্যদের অনেকে হেলমেট পরা অবস্থায় লাঠি হাতে ছিলেন।

পরে এলাকাবাসীর সাথে সেখানে দায়িত্বরত সেনা কর্মকর্তা কথা বলেন। বেশ কিছুক্ষণ ধরে কথাবার্তা বলার পর এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে সেখানে ক্যাম্প নির্মাণ বন্ধ ও মোতায়েনকৃত সেনাদের প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে উক্ত সেনা কর্মকর্তার নিকট চট্টগ্রামের চব্বিশ পদাতিক ডিভিশনের জিওসির বরাবরে একটি সারকলিপি হস্তান্তর করেন।
এ সময় এলাকাবাসী সেখানে উপস্থিত সেনা কর্মকর্তাদের কাছ থেকে ক্যাম্প স্থাপনের কারণ জানতে চাইলে তারা উপরের নির্দেশে ক্যাম্প স্থাপন করা হচ্ছে বলে জানান। অপরদিকে বিক্ষুব্ধ জনগণের পক্ষ থেকে জনপ্রতিনিধিরা ক্যাম্প স্থাপন করা হলে নারীদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেন।


জিওসির বরাবরে প্রদত্ত স্মারকলিপিতে বলা হয়,
১। বৌদ্ধ বিহারের জায়গায় ক্যাম্প স্থাপন করা হলে তা ধর্মীয় পরিহানী হবে। ভিক্ষুদের ধ্যান কার্যে বিঘ্ন ঘটবে। ধর্মপ্রাণ দায়ক দায়িকাগণ ধর্মীয় কাজে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিহারে আসতে ইতস্তঃতবোধ করবেন। ধর্মীয় পূজা-পার্বন , নানা উৎসবসহ বিহারের দৈনন্দিন স্বাভাবিক কাজকর্মে ব্যাঘাত সৃষ্টি হবে।
২। আমাদের এলাকায় কোন চুরি-ডাকাতি, খুন, চাঁদাবাজি, অবৈধ মালামাল বহন তথা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে না। এলাকায় কোন সন্ত্রাসী কার্যক্রম চলে না। বর্মাছড়ি বাজারে পাহাড়ি-বাঙালি উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে কোন ভেদাভেদ থাকে না। আমরা উভয় সম্প্রদায় শান্তিতেই বসবাস করছি।
৩। বর্মাছড়ি এলাকার কাছাকাছি খিরাম ও শুকনাছড়ি আর্মি ক্যাম্প নামে দুটো সেনা ক্যাম্প রয়েছে। কাজেই নতুন করে সেনা ক্যাম্প স্থাপন মোটেই কাম্য নয় যা ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সম্পাদিত পার্বত্য চুক্তির লঙ্ঘন। এ চুক্তিতে সকল অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহারের কথা রয়েছে।
৪। আমরা জনগণের মতামত নিয়েছি। তারা কেউ ক্যাম্পের পক্ষে নয়। তারা ক্যাম্প চায় না।
৫। আর্মি ক্যাম্প হলে আমাদের মেয়েরা সম্পূর্ণ অনিরাপদ ও অরক্ষিত হয়ে যাবে। তারা একা একা আর কোথাও যেতে পারবে না। বাসায়ও একা একা থাকতে পারবে না। একা একা জঙ্গলে, জুমে, ঝরণা থেকে পানি আনতে, বাজারে যাওয়া আসা করতে ও প্রতিবেশির বাড়িতে বেড়াতে যেতে পারবে না। তাদেরকে সব সময় যৌন হামলার ভয়ে থাকতে হবে। কারণ আপনারা সব সময় সব সৈন্যকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন এমন গ্যারান্টি দিতে পারবেন না।
৬। আমাদের এলাকায় কোন সন্ত্রাসী নেই। কেউ হয়তো আপনাদের কাছে ভালো সাজার জন্য , কিংবা আপনাদের কাছ থেকে টাকা খাওয়ার জন্য সন্ত্রাসের ব্যাপারে মিথ্যা রিপোর্ট দিয়ে থাকতে পারে । আমাদের এলাকায় চাঁদাবাজিও হয় না। এত ভেতরের এলাকায় কেউ চাঁদাবাজি করে না। চাঁদাবাজি হয় বড় রাস্তায়।
৭। যদি কোন সময় নিরাপত্তার দরকার হয়, আমরা নিজেরা এসে আপনাদের বলবো। আপনাদের সহযোগিতা চাইব। দয়া করে জনগণের অমতে আমাদের এলাকায় ক্যাম্প দেবেন না।
উল্লেখ্য, গত কয়েকদিন আগে খিরাম আর্মি ক্যাম্প থেকে সেনাবাহিনীর একটি দল বর্মাছড়ি বাজার এলাকায় এসে আর্য কল্যাণ বনবিহারের জায়গায় কয়েকটি তাঁবু খাটায় এবং একটি স্থানে হেলিপ্যাডের চিহ্ন দিয়ে রাখে।
গত ২২ অক্টোবর সকাল থেকে তারা সেখানে ক্যাম্প নির্মাণের জন্য জোর প্রচেষ্টা শুরু করে। আজ (২৪ অক্টোবর) সকালে সেখানে আরো অন্তত ১৮০ জন সেনা সদস্য উপস্থিত হয় এবং ড্রোন উড়িয়ে এলাকায় নজরদারি করে।
এমন পরিস্থিতিতে এলাকার বিক্ষুব্ধ জনগণ সেখানে ক্যাম্প স্থাপনের প্রতিবাদে ও মোতায়েনকৃত সেনাদের প্রত্যাহারের দাবিতে এই গণবিক্ষোভের আয়োজন করে।

সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।
