বাবুছড়ায় জমি অধিগ্রহণ: বিজিবির ৫১ ব্যাটালিয়ন কি আইনের উর্ধে?
সিএইচটিনিউজ.কম
।। মন্তব্য প্রতিবেদন ।।
জোর যার মুল্লুক তার। যার কাছে ক্ষমতা, তার হাতে আইন। দীঘিনালার বাবুছড়ায় বিজিবির ৫১ ব্যাটালিয়নের জন্য জোর করে জমি দখল ও তার পরবর্তী ঘটনাবলী এই প্রবাদতুল্য বচনগুলোকেই যেন সত্য প্রমাণিত করেছে।
অধিগ্রহণের জন্য নোটিশ জারি:
বিজিবি বাবুছড়ায় একটি ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তর স্থাপনের জন্য প্রথম জমি অধিগ্রহণের চেষ্টা চালায় ২০০৫ সালে। এর জন্য সে বছর ৩১ মার্চ ৪নং দীঘিনালা ইউনিয়নের যতœ মোহন কার্বারী পাড়া ও শশী মোহন কার্বারী পাড়ার মোট ৪৫ একর টিলা ও ধান্য জমি হুকুম দখলের নোটিশ জারি করা হয়। এই জমির মালিক ১১টি জুম্ম পরিবার, যাদের নামে এই নোটিশ ইস্যু করা হয়েছিল। [স্মারক নং ৬৩/এল,এ শাখা, তারিখ-৩১/০৩/২০০৫] জমিগুলো দীঘিনালা ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত হলেও তা বাবুছড়ার কাছে। উক্ত নোটিশ জারির সাথে সাথে বিজিবি লাল পতাকা পুঁতে ওই জমির চারদিকে বেষ্টনী দেয়। উল্লেখিত ১১ পরিবার অধিগ্রহণ নোটিশের বিরুদ্ধে মহামান্য হাইকোর্টে রিট মামলা দায়ের করলে মহামান্য আদালত ২০০৫ সালের ১৯ মে বিজিবির (তখন বিডিআর) ৫১ ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তর স্থাপনের উদ্দেশ্যে জমি অধিগ্রহণের জন্য জারিকৃত নোটিশ কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না এই মর্মে রুল জারি করেন এবং উক্ত রুল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত ভূমি অধিগ্রহণ নোটিশ স্থগিতের নির্দ্দেশ দেন। [রিট মামলা নং-৩৪৫৫-৩৪৬৪/২০০৫] উক্ত রিট আবেদন এখনো নিষ্পত্তি হয়নি।
এরপরও উক্ত জমি অধিগ্রহণের উদ্দেশ্যে এ বছর গত ১০ এপ্রিল জেলা প্রশাসকের কার্যালয় (এল,এ শাখা) থেকে জেলা প্রশাসকের পক্ষে ভূমি হুকুম দখল কর্মকর্তা মো. আলী আফরোজ ক্ষতিপূরণ গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে ১১ জনের নামে নতুন করে নোটিশ ইস্যু করেন। [স্মারক নং ০৫.৪২.৪৬০০.০১৮.০১৪.০২.১৩ (অংশ-২)]। এই ১১ জনের মধ্যে ৩ জন রয়েছেন, যাদের নামে আগের বারও নোটিশ জারি করা হয়েছিল। অর্থাৎ ২০০৫ সালে প্রথম বার যে ১১ জনের নামে নোটিশ ইস্যু করা হয়, নতুন নোটিশে তাদের মধ্য থেকে ৮ জনকে বাদ হয়েছে এবং

অপরদিকে নতুন ৮ জনকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু উক্ত জমি বিষয়ে মহামান্য হাইকোর্টে এখনও রিট আবেদন নিষ্পত্তি হয়নি বিধায় ভূমি মালিকদের কেউই ক্ষতিপূরণ গ্রহণ করেননি।
অধিগ্রহণে আইন মানা হয়নি:
বাবুছড়ায় যে জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে তা সম্পূর্ণ অবৈধ। কারণ জেলা পরিষদ আইনের ৬৪(১-খ) ধারায় স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে: “আপাতত: বলবৎ অন্য কোন আইনে যাহা কিছু থাকুক না কেন… (খ) পরিষদের নিয়ন্ত্রণ ও আওতাধীন কোন প্রকারের জমি, পাহাড় ও বনাঞ্চল পরিষদের সহিত আলোচনা ও উহার সম্মতি ব্যতিরেকে সরকার কর্তৃক অধিগ্রহণ ও হস্তাস্তর করা যাইবে না।” অর্থাৎ জমি অধিগ্রহণ করতে হলে জেলা পরিষদের সম্মতি নেয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এই আইনের রচয়িতা হলো সরকার। অথচ সরকারই তার রচিত এই আইন ভঙ্গ করেছে। গত ১২ জুন খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসকের আহুত আইন-শৃঙ্খলা বিষয়ক সভায় জেলা প্রশাসক মোঃ মাসুদ করিম স্বীকার করেন যে, বাবুছড়ায় বিজিবির ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তর স্থাপনের জন্য ভূমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে জেলা পরিষদের কোন সম্মতি নেয়া হয়নি। দ্বিতীয়ত, হাইকোর্টে রিট আবেদন নিষ্পত্তি হওয়ার আগেই আদালতের আদেশ অমান্য করে জেলা প্রশাসকের জমি অধিগ্রহণ ও উক্ত জমি বিজিবিকে হস্তান্তর সুষ্পষ্ট আদালত অবমাননা।
এছাড়া, জমি অধিগ্রহণের আগে এলাকার হেডম্যান ও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মতামত চাওয়া হয়নি। যদিও তাদের মতামত নেয়ার জন্য আইনে কোন বাধ্যবাধকতা নেই, তারপরও বিজিবির মতো জনগণের করের টাকায় পালিত একটি বাহিনীর কাছে জনগণের এটাই কাম্য।
মাস্তানের ভূমিকায় বিজিবি
দেশের আইন আদালতকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বিজিবির সদস্যরা গত ১৪ মে দিবাগত রাতে আনুমানিক ৩ টায় সমতল জেলায় মাতব্বরের চর দখলের মতো অথবা বলা যায় প্রভাবশালী মাস্তানের অন্যের সম্পত্তি দখলের মতো বেআইনীভাবে বাবুছড়ায় অধিগ্রহণকৃত জমি নিজেদের দখলে নেয়। তার পরদিন অর্থাৎ ১৫ মে খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসকের একজন প্রতিনিধি

যত্ন মোহন কার্বারী পাড়ায় বিজিবি এভাবে লাল পতাকার খুঁটি দিয়ে পাহাড়িদের জমি বেদখল করে নেয়। ছবি: সিএইচটিনিউজ.কম।
বাবুছড়ায় গিয়ে বিজিবিকে ‘তাদের জমি’ বুঝিয়ে দেয়। এরপর বিজিবি লাল পতাকা পুঁতে তাদের বেদখলকৃত জমির সীমানা চিহ্নিত করে।
বিজিবির ৫১ ব্যাটালিয়নের মাস্তানীর প্রমাণ আরেকবার পাওয়া যায় ১০ জুন। এদিন স্থানীয় জনগণ বিজিবির ভূমি বেদলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানালে বিজিবি, পুলিশ ও সেটলাররা যৌথভাবে তাদের উপর হামলা চালায়। এতে মোট ১৮ জন পাহাড়ি গুরুতর আহত হন, যাদের অধিকাংশই হলেন নারী। বিজিবির সদস্যরা বন্দুকের বাট দিয়ে মধ্যযুগীয় কায়দায় প্রতিবাদকারীদের মারধর করে। কিন্তু বিজিবি এতেও সন্তুষ্ট নয়। তাদের প্রতিশোধ পরায়ণতা কতদূর যেতে পারে তা পরবর্তী ঘটনা দেখিয়ে দিয়েছে। ঘটনার পরদিন বিজিবির জনৈক সুবেদার বাবুছড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সুগত প্রিয় চাকমা, একই ইউনিয়নের প্রাক্তন চেয়ারম্যান পরিতোষ চাকমা ও স্থানীয় হেডম্যান প্রান্তর চাকমাসহ ২৫০ জনের বিরুদ্ধে ফৌজদারী মামলা দায়ের করে। এমনকি খাগড়াছড়ি জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এডভোকেট আশুতোষ

চাকমা ও তার ছোট ভাই খোকন চাকমাকেও এই মামলায় আসামী করা হয়েছে। [যারা মনে করেন তথাকথিত জাতীয় রাজনৈতিক দলের সাথে জড়িত থাকলে শাসকগোষ্ঠীর নির্যাতন থেকে বাঁচা যাবে, তাদের এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নেয়া দরকার।] ওই মামলার প্রেক্ষিতে পুলিশ গত ১৩ জুন খাগড়াছড়ি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৪ নারীকে ও তাদের দেখতে আসা দুই ষাটোর্ধ ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে। পুলিশ উক্ত চার নারীকে হাসপাতালে পাহারা দিয়ে রাখলেও, আদালত দুই বৃদ্ধকে জেলে পাঠানোর নির্দেশ দেয়।
নিজের বাড়িতে প্রবেশাধিকার নেই:

বিজিবির হামলায় আহত অনেককে দীঘিনালা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসা শেষে তারা নিজের বাড়ি যেতে চাইলে বিজিবি তাদের বাধা দেয়। বিজিবি তাদের বাড়িঘর ও জমিজমা কাঁটা তার দিয়ে চিহ্নিত সীমানার ভেতরে অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছে। ফলে নিজ বাড়িতে যেতে না পেরে এখন ১৪ পরিবার পাহাড়ি বাবুছড়া হাই স্কুলে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। বর্তমানে তারা সেখানে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। তাদের পাশে দাঁড়াবার যেন কেউ নেই। তারা যেন এ দেশের নাগরিক নন।
অপরদিকে যত্ন মোহন কার্বারী পাড়ায় ২নং বাঘাইছড়ি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়টিও বিজিবি বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে এ স্কুলের ২৫০ জন ছাত্রছাত্রীর শিক্ষা জীবন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এই স্কুলটি পাকিস্তান আমলে ১৯৬৭ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। সে সময় এর নাম ছিল কায়দে আজম সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়। স্বাধীনতার পর স্কুলটির নাম পরিবর্তন করা হয়েছে।
উকিল নোটিশ ও জেলা প্রশাসকের জবাব
মহামান্য হ্ইাকোর্টের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ভূমি হুকুম দখল করায় ভূমি মালিকদের পক্ষে এডভোকেট ইদ্রিসুর রহমান খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসককে উকিল নোটিশ প্রদান করেন। জেলা প্রশাসক ২৮ মে এই উকিল নোটিশের যে জবাব দেন তাতে বলা হয়: প্রস্তাবিত ৪৫ একর থেকে ২৯.৮১ একর জমি হুকুম দখল করা হয়েছে। [স্মারক নং-০৫.৪২.৪৬০০.০১৮.০১৪.০২১৪-১১৭] অর্থাৎ ১৫.১৯ একর বন্দোবস্তীকৃত জমি বাদ দিয়ে ২৯.৮১ একর জমি ‘খাস’ দেখিয়ে চূড়ান্তভাবে অধিগ্রহণ করে বিজিবিকে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, ১৫.১৯ একর জমি কাগজে কলমে হুকুম দখল করা না হলেও প্রকারান্তরে তা দখল করারই সামিল। কারণ অধিগ্রহণকৃত এই ২৯.৮১ একর জমি এক দাগে কিংবা পাশাপাশি দাগে নেই; তা বেশ কয়েকটি দাগে বিভক্ত। দেখা গেছে একটা দাগের জমি অধিগ্রহণ দেখিয়ে তার পাশের দাগের জমিগুলো বাদ দিয়ে আবার পরের দাগের জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। ফলে অদখলকৃত দাগের জমিগুলো দখলকৃত জমির ফাঁকে ফাঁকে রয়ে গেছে। এর অর্থ হলো এই – যাদের জমি অধিগ্রহণ করা হয়নি তাদের পক্ষে অধিগ্রহণকৃত জমি অতিক্রম করে তাদের সেই জমিতে বসবাস বা চাষাবাদ করা সম্ভব হবে না। বিজিবি ইতিমধ্যে কাটা তারের বেষ্টনী দিয়ে তাদের জমি ঘিরে ফেলায় অধিগ্রহণ না-করা জমিগুলোও ওই বেষ্টনীর ভেতরে পড়ে গেছে। ফলে বিজিবির বাধার কারণে তারা তাদের নিজ বাড়িতে পর্যন্ত যেতে পারছেন না। আর ২৯.৮১ একর জমি ‘খাস’ দেখানো হলেও তা প্রকৃত প্রস্তাবে পাহাড়ি জনগণের যৌথ মালিকানাধীন সম্পত্তি। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রথাগত ভূমি আইন অনুসারে পার্বত্য চট্টগ্রামে কোন জমি খাস নেই। ১৯০০ সালের পার্বত্য শাসনবিধির ৫০(১) ধারা মোতাবেক স্থানীয় মৌজা প্রধান বা হেডম্যান এই যৌথ মালিকানাধীন জমি থেকে বসতভিটার জন্য বিভিন্ন সময় জমি বরাদ্দ দিয়ে থাকেন। জেলা প্রশাসনের হুকুম দখলকৃত ২৯.৮১ একর জমির বিপরীতে হেডম্যান প্রদত্ত বৈধ মালিকানার দলিল রয়েছে।
জেলা প্রশাসক উকিল নোটিশের জবাবে আরো উল্লেখ করেন যে, বাবুছড়া ইউনিয়নে বিজিবির কোন ক্যাম্প নেই। ভারত সীমান্তবর্তী এলাকায় বিজিবির কোন ক্যাম্প না থাকায় ১৪৩ কিলোমিটার আন্তর্জাতিক সীমানা অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। তার এই বক্তব্য মোটেই সত্য নয়। কারণ বাবুছড়া ইউনিয়নে ভারত সীমান্তবর্তী এলাকায় ৩৬ নং কুকিছড়া মৌজায় ১টি স্থায়ী বিজিবি ক্যাম্প রয়েছে। এই ক্যাম্পটি পাকিস্তান আমলে বসানো হয়েছিল। এছাড়া বাবুছড়া ইউনিয়নে ৩৫ নং ডুলুছড়ি মৌজায় ওয়াইটং নামক এলাকায় আরো একটি বিজিবি ক্যাম্প রয়েছে, যা ১৯৮৫ সালে স্থাপন করা হয়। জেলা প্রশাসক উক্ত জবাবে আরো বলেন, বর্তমানে স্থাপিত ৫১ নং বিজিবির ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তরটি ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকার কাছাকাছি। তার এই

বক্তব্যও সত্য নয়। প্রকৃত অর্থে প্রস্তাবিত বাবুছড়া বিজিবি ব্যাটালিয়নের সদর দপ্তর থেকে ভারত সীমান্তের দূরত্ব প্রায় ৫০-৫৫ কিলোমিটার।
উচ্ছেদ, কেবলই উচ্ছেদ
১৯৮৯ সালে সেনা নির্যাতনের কারণে যত্ন মোহন কার্বারী পাড়া ও শশী মোহন কার্বারী পাড়াসহ বাবুছড়া এলাকার অধিকাংশ জনগণ ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। ১৯৯৮ সালে পার্বত্য চুক্তির পর সরকারের সাথে জুম্ম শরণার্থীদের সম্পাদিত ২০ দফা প্যাকেজ চুক্তির ভিত্তিতে গ্রামবাসীরা দেশে ফিরে এলেও তাদের মধ্যে অনেকে এখনো নিজেদের জমি ফিরে পায়নি। যারা জমি ফিরে পায়নি তারা বর্তমানে ভাড়া দিয়ে অন্যের জমিতে বাড়ি-ঘর করে কোন রকমে দিনাতিপাত করছেন। বিজিবির জন্য জমি অধিগ্রণের ফলে ভারত প্রত্যাগত বহু শরণার্থী এবার স্থায়ীভাবে জমি হারাবেন। এর আগে ১৯৮৫ সালে বাবুছড়া আর্মি ক্যাম্প স্থাপন করা হলে অনেক পাহাড়ি জমি হারিয়েছিলেন। ভারত প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থীদের জায়গা জমি থেকে উচ্ছেদ করে বিজিবির ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তর স্থাপনের ব্যাপারে জুম্ম শরণার্থী টাস্ক ফোর্সের মতামত বা পরামর্শ নেয়া হয়েছে কিনা প্রশ্ন করা হলে জানানো হয় যে, এ ধরনের কোন মতামত, পরামর্শ বা ছাড়পত্র নেয়া হয়নি।
বৌদ্ধ বিহারের জমিও অধিগ্রহণ
অধিগ্রহণকৃত ২৯.৮১ একর জমির ভিতরে ৯৬০ দাগ নম্বরে ১৫ শতাংশ জমির উপর জেতবন বৌদ্ধ বিহার নামে একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ছিল। এই বৌদ্ধ বিহারটি ১৯৮৯ সালে এলাকার জনগণ ভারতে শরণার্থী হওয়ার আগ পর্যন্ত বর্তমান ছিল। এলাকার জনগণের অনুপস্থিতিতে সেনাবাহিনী ও আনসার বাহিনীর সদস্যরা তখন বৌদ্ধ বিহারের জমি বেদখল করে নিয়েছিল। এই জমি এখনো বেদখলমুক্ত করা যায়নি। শরণার্থী থেকে প্রত্যাবর্তনের পর বহুবার চেষ্টা করেও বাবুছড়া আর্মি ক্যাম্পের সেনা সদস্যদের বাধার কারণে নতুন করে ওই বিহার নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি। এই বৌদ্ধ বিহারটি অনেক পুরনো। যখন থেকে ঐ এলাকায় জনবসতি গড়ে উঠেছিল তখন বৌদ্ধ বিহারটি নির্মাণ করা হয়। বর্তমানে এই বৌদ্ধ বিহারটির জমিও বিজিবি দখল করে নিয়েছে।
স্থানীয়দের প্রতিক্রিয়া
যত্ন মোহন কার্বারী পাড়া ও শশীমোহন কার্বারী পাড়ায় বিজিবি যে তাদের জমি জোরপূর্বক বেদখল করে তাদের ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তর স্থাপন করছে এব্যাপারে প্রতিক্রিয়া জানতে চাওয়া হলে যত্ন মোহন কার্বারী পাড়ার বাসিন্দা গোপা চাকমা বলেন,

“বিজিবি সদস্যদের উপস্থিতি আমাদের নানাবিধ সমস্যার সৃষ্টি করেছে। আমরা আমাদের জমির ওপর বিজিবি ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তর চাই না। মেয়েরা পুকুরে গোসল করার সময় বিজিবি সদস্যরা তাদের দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। তারা আমাদের বাড়ির উঠোন দিয়ে যাতায়াত করে, বদনা দিয়ে পুকুরের পানি ব্যবহার করে। মানা করলেও শুনে না। [পাহাড়িরা বদনাকে একমাত্র পায়খনার কাজে ব্যবহার করে, মুখ ধোয়া বা গোসলের জন্য বদনা ব্যবহার করাকে হীন কাজ মনে করে]। রাস্তায় চেক পোস্ট বসানোর ফলে রাতের বেলায় চলাফেরা ও ঘোরাফেরা করতে পারছি না। রাস্তা বন্ধ হওয়ার ফলে ছাত্রছাত্রীদের স্কুলে যাওয়া ও প্রাইভেট পড়তে যাওয়া পর্যন্ত বন্ধ করতে হয়েছে। আগে রাত ১০-১১টা পর্যন্ত চলাফেরা করলেও কোন সমস্যা হতো না। এখন আমরা সবচেয়ে মেয়েরা বেশী নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি।”
গোপা চাকমা ১০ জুন বাবুছড়ায় বিজিবি-পুলিশের যৌথ হামলায় গুরুতর আহত হয়েছেন। বর্তমানে তিনি খাগড়াছড়ি হাসপাতালে পুলিশী প্রহরায় চিকিৎসাধীন। অর্থাৎ তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তিনি আহত হওয়ার আগের দিন এক সাক্ষাতকারে উপরোক্ত কথাগুলো বলেছিলেন।
শশীমোহন কার্বারী পাড়ার বাসিন্দা বাবুল চাকমা (শশী মোহন কার্বারীর নাতি) বলেন তারাই ওই এলাকায় আদি বাসিন্দা। তাদের আগে অন্য কারোর বসতি সেখানে ছিল না। বিজিবি তাদের জমিগুলো জোর করে দখল করেছে অভিযোগ করে তিনি আরো বলেন:
“বিজিবি সদস্যরা গোসলের জন্য আমরা যে পুকুরটা ব্যবহার করি সেটাও বেদখল করেছে। আমরা ১৯৮৯ সালে একবার নিজ বাস্তুভিটা থেকে শরণার্থী হওয়ার ফলে উচ্ছেদ হয়েছিলাম। বিজিবি আসায় আমাদেরকে আরো একবার উচ্ছেদ হতে হচ্ছে। আমরা বংশ পরম্পরায় সেই ব্রিটিশ আমল থেকে এই জায়গায় বসবাস করে আসছি। আমরাই বাঘ-ভালুকের সাথে যুদ্ধ করে এই জায়গাগুলো বসবাসের উপযোগী করেছি। এই পাড়ায় আমাদের আগে অন্য কারোর বসতি ছিলনা। আমরাই এখানে আদি বাসিন্দা।”
শশী মোহন কার্বারীর স্ত্রী রঞ্জন মালা চাকমা বিজিবির ভূমি অধিগ্রহণ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে আবেগ প্রবণ হয়ে পড়েন। তিনি বলেন,
“যে জায়গায় আমরা বংশ পরম্পরায় বসবাস করে আসছি সে জায়গা আমরা কিভাবে বিজিবির হাতে তুলে দেবো? যে জায়গা আমরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে বসবাসের জন্য উপযোগী করেছি, যে জায়গায় আমার স্বামীর শ্মশান রয়েছে, যে জায়গায় আমাদের অনেক সুখ-দুঃখের স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে, সে জায়গা হাতছাড়া হওয়া মৃত্যুর সামিল।”
৪নং দীঘিনালা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বাবু চন্দ্র রঞ্জন চাকমা বলেন, বিজিবি ক্ষমতার জোর খাতিয়ে সেখানে অবস্থান করছে, তাই তাদেরকে কেউ মেনে নিতে পারছে না। তিনি যতœ মোহন কার্বারী পাড়া ও শশী মোহন কার্বারী পাড়া থেকে বিজিবি সদস্যদের প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে বলেন:
“যত্ন মোহন কার্বারী পাড়া ও শশী মোহন কার্বারী পাড়ায় নিরীহ হত দরিদ্র পরিবারগুলোর ভুমি রক্ষার জন্য দীঘিনালার সর্বস্তরের মুরুব্বীরা একত্রিত হয়েছি। কারণ অন্যায়ভাবে বিজিবির ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তর স্থাপিত হলে অনেক দরিদ্র পরিবার উচ্ছেদের শিকার হবেন। গত ১৪ মে গভীর রাতে বিজিবির সদস্যরা যেভাবে আদালত অবমাননা করে চুরি করে অবস্থান নিয়েছে তা অবৈধ ও আইনের প্রতি বুড়ো আঙ্গুল দেখানোর সামিল। ”
৫১নং দীঘিনালা মৌজার হেডম্যান বাবু প্রান্তর চাকমা। বিজিবি যে ২৫০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে তিনি তাদের একজন। বাবুছড়ায় প্রতিবাদকারী পাহাড়িদের উপর বিজিবি-পুলিশী হামলার আগের দিন তার সাক্ষাতকার গ্রহণ করা হয়। তিনি বলেন,
“বিজিবির জন্য জমি অধিগ্রহণের ব্যাপারে হেডম্যান হিসেবে আমি কিছুই জানিনা বা আমাকে কিছুই জানানো হয়নি। আমার মতে, নিরীহ দরিদ্র পাহাড়ি পরিবারগুলোকে তাদের পিতৃপুরুষের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করে দীঘিনালায় বিজিবির ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তর স্থাপন মোটেই যুক্তিযুক্ত নয়।”
জনগণের প্রতিবাদ

দীঘিনালায় কোন পাহাড়ি চায় না বাবুছড়ায় বিজিবির ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টার নির্মাণ করা হোক। এ জন্য তারা হাইকোর্টে মামলা করেছেন। ২০১৩ সালের ৬ অক্টোবর স্বরাষ্টমন্ত্রী বরাবর একটি স্মারকলিপি দেন। এরপর গত ২৭ মে বাবুছড়া এলাকার জনগণ এবং ৮ জুন দীঘিনালার সকল নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিগণ বাবুছড়ায় বিজিবির ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তর স্থাপনের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি দেন। শুধু তাই নয়, জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে সর্বস্তরের জনগণ মানববন্ধন ও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা টিএনও অফিসের সামনে অবস্থান ধর্মঘট পালন করেন। এর পর গত ১০ জুন বাবুছড়ায় বিজিবির সামনে প্রতিবাদ করা হলে বিজিবি প্রতিবাদকারীদের উপর নির্বিচারে হামলা চালিয়ে ১৮ জনকে মারাত্মকভাবে আহত করে।
বিজিবি কি আইনের উর্ধে?
সবার একই প্রশ্ন, বিজিবির ৫১ ব্যাটালিয়ন কি আইনের উর্ধে? তাদের উপর কি দেশের আইন ও সংবিধান প্রযোজ্য নয়? তারা মহামান্য হাইকোর্টের আদেশ অমান্য করার সাহস পায় কীভাবে? তাদেরকে কি নিরীহ মানুষের উপর নির্বিচারে অত্যাচার চালানোর লাইসেন্স দেয়া হয়েছে? বিজিবির ৫১ ব্যাটালিয়নের সদস্যরা এখন কেবল তাঁবু খাটিয়ে বেদখলকৃত জমিতে অবস্থান করছে, এখনো স্থায়ী হয়নি। তারপরও জনগণের উপর তাদের এত জুলুম। যদি তারা একেবারে স্থায়ীভাবে সেখানে থাকে, তাহলে আশেপাশের জনগণের বছরের পর বছর কী করুণ দশা হবে তা সহজেই অনুমেয়। বিজিবি আসলে অন্য পোষাকে সেনাবাহিনী ছাড়া আর কিছু নয়। কারণ বিজিবির যারা কমান্ডার তারা সেনাবাহিনী থেকে ডেপুটেশনে দায়িত্ব পালন করে থাকেন। পার্বত্য চট্টগ্রামে বিজিবি হোক, সেনাবাহিনী হোক, বা আধা সামরিক বাহিনী হোক — তাদের সবার লক্ষ্য একই: পাহাড়ি জনগণের উপর উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদী শাসন-শোষণ জারী রাখা। গত বছর মাটিরাঙ্গার তাইন্দং-এ পাহাড়ি গ্রামে হামলায় বিজিবির ভূমিকা এই সত্যকে তুলে ধরেছে। উক্ত হামলার ষড়যন্ত্রের আসল হোতা হলো সেখানে নিয়োজিত বিজিবির সদস্যরাই। তারাই পর্দার আড়াল থেকে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেছিল।
দীঘিনালায় বিজিবির ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তরের কি আদৌ প্রয়োজন আছে?
দীঘিনালার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে দেয়া স্মারকলিপিতে বলেন দীঘিনালায় বিজিবির ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তর স্থাপনের কোন প্রয়োজন নেই। এ জন্য তারা ৫টি কারণ উল্লেখ করেন, যার একটিতে বলা হয়েছে, “অধিগৃহীত এলাকার আশেপাশে বেশ কয়েকটি সামরিক ও আধা সামরিক বাহিনীর ক্যাম্প রয়েছে। যেমন, প্রায় কয়েকশ’ গজ পশ্চিমে রয়েছে আর্মিদের বাবুছড়া সাবজোন, উত্তরে জারুলছড়ি আর্মি ক্যাম্প ও নারেইছড়ি বিজিবি ক্যাম্প, দক্ষিণে রাঙাপানিছড়া (তথাকথিত কার্বারীটিলা) আনসার-ব্যাটালিয়নের ক্যাম্প ও দক্ষিণ-পশ্চিমে কাটারুংছড়া আর্মি ক্যাম্প। এছাড়া, উপজেলার কবাখালীতে সেনাবাহিনীর একটি ক্যান্টনমেন্টসহ দীঘিনালায় আরো অসংখ্য ক্যাম্প রয়েছে। সর্বোপরি পাশের উপজেলা বাঘাইছড়িতে বিজিবি’র একটি ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তর ও খাগড়াছড়ি জেলা সদরে সেক্টর সদর দপ্তর রয়েছে। দীঘিনালার সাথে জেলা সদর ও পার্শ্ববর্তী উপজেলাসমূহে যোগাযোগ ব্যবস্থা অত্যন্ত ভালো। অতএব, দীঘিনালায় নতুন করে বিজিবি’র ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তর স্থাপনের কোন প্রয়োজন ও যৌক্তিকতা নেই।”
সরকারের উচিত হবে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও জনগণের দাবি মেনে নিয়ে অবিলম্বে যতœ মোহন কার্বারী পাড়া থেকে বিজিবির ৫১ ব্যাটালিয়নের সদস্যদের প্রত্যাহার করা, আর বাবুছড়ার জনগণকে শান্তিতে থাকতে দেয়া। সরকারের কাছে এই সামান্য চাওয়া ছাড়া তাদের আর কোন দাবি নেই। [সমাপ্ত]
—————–