বিজুতে আনন্দ করবেন, ফাঁকে লোগাং এর কথা স্মরণ করবেন: ইমতিয়াজ মাহমুদ

0

বিজু নিয়ে আলাপ করলেই লোগাং এর কথা মনে পড়ে। কেননা আমার দেখা মতে সেই একবারই বিজু উৎসব বর্জনের কথা হয়েছিল- সেবারের বিজু ছিল কান্নার বিজু, ক্রোধ ও বেদনার বিজু। আপনি যখন এইবার বিজুতে আনন্দ করবেন, আনন্দ নিশ্চয়ই করবেন- সেটা জীবনেরই অংশ, সারা দিনের আনন্দের এক ফাঁকে অন্তত একটা মিনিটের জন্যে হলেও লোগাং এর কথা স্মরণ করবেন। ভুলবেন না।

ইমতিয়াজ মাহমুদ। সংগৃহিত ছবি

(১)

বিজু (বা বিঝু) উদযাপনে আমাদের সময় আড়ম্বর এতো হতো না। আমরা বাড়ী বাড়ী যেতাম, পাজন খেতাম। চৈত্র সংক্রান্তিতে সবজি একটা আমাদের ঘরেও হতো, অনুমান করি অনেক বাঙালীর ঘরেই হয়, কিন্তু রাঙামাটিতে চাকমা পাজন যেটা আমাদের ঘরের সবজিটা ঠিক সেটার মতো নয়। একশ রকমের উদ্ভিতজাত ফল, মুল, ফুল, লতা পাতা মিশিয়ে পাজন হয়। সবার ঘরে একরকম স্বাদ হয় না। উপাদান ভেদে বা রান্নার স্টাইলের কারণে একেক রকম স্বাদ হয় একেক ঘরে- কিন্তু সুস্বাদু হয় সবার ঘরেই। বছরের এই তারিখটা, এই দিনের আবহাওয়া এই সবকিছু মিলিয়ে পাজন আর আমাদের শরীরের মধ্যে যে সমীকরণ হয়, সেইটাই বৈশিষ্ট্য।

এখনকার মতো মেলা, কনসার্ট বা এইরকম অন্য কোন বিশেষ গণ-আয়োজন এগুলি হতো না। কারো কারো বাসায় পার্টির মতো হতো। আমাদের উদযাপন ছিল ঐ যে, সকলের ঘরে ঘরে গিয়ে খাওয়া, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়া, কিঞ্চিৎ পান করা এইসব। শুধু যে পাজন খেতে দিতো লোকে সেটা নয়, সাথে নানাপ্রকার সুস্বাদু খাবারও থাকতো। ভারি কোন খাবার সাধারণত পরিবেশন করা হতো না।কোন কোন বাড়ীতে ভাত হয়তো দিত সাথে, পোলাও কোরমা এইসব খাবার বিজুর সাথে যুক্ত ছিল না। পাজনের মধ্যে অনিবার্যভাবে কাঁঠাল তো থাকবেই, তীব্র স্বাদের মধ্যে কাঁচা আম থাকতো, আর করলা বা উচ্ছে এইসব। সব মিলিয়ে অমৃত।

আমি যখন রাঙামাটি কলেজ থেকে পাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই, তখনো পর্যন্ত আমার মনে একটা সিদ্ধান্ত ছিল যে যেখানেই থাকি বিজুতে অন্তত একদিন আমি যে কোন অবস্থাতেই রাঙামাটি থাকবো। পড়ে যখন বাপু বদলই হয়ে গেলেন রাঙামাটি থেকে কক্সবাজারে, পরিবাররে সবাই চলে গেলে কক্সবাজার তখন থেকে ধীরে ধীরে বিজুর সময় রাঙামাটি যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। বিজু হয় চৈত্র সংক্রান্তিতে আর আমদের পরিবারে আড়ম্বরের সাথে উদযাপিত হয় পহেলা বৈশাখ। নিতান্ত অনিবার্য কোন কারণ না থাকলে পহেলা বৈশাখ পুরো পরিবারের সাথে উদযাপন করতে হয়। আমার মা থাকতেও এটা ছিল, এখনো এই নিয়ম বিদ্যমান আছে।

(২)

এখন তো আমার নিজেরই একটা পরিবার হয়েছে প্রিয়তমা স্ত্রী আর দুই কন্যার সাথে এই অধমকে মিলিয়ে। আমরা উৎসব হিসাবে দুই ঈদ, পহেলা বৈশাখ, ক্রিসমাস, ইংরেজি নববর্ষ, দুর্গা পূজা এই সবই উদযাপন করি। এই সবকিছুর মধ্যে পহেলা বৈশাখটা হচ্ছে প্রধান। দুই ঈদের বা অন্য কোন পালা পার্বণের চেয়ে পহেলা বৈশাখটা আমাদের কাছে উদযাপনের হিসাবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। পহেলা বৈশাখের সুবিধা হচ্ছে যে এর সাথে কোন ধর্মীয় আচার আচরণ জড়িত নাই, আপনি আপনার ইচ্ছামতো যেভাবে চান সেভাবেই উৎসব বা উদযাপন সাজাতে পারেন। আমরা চেষ্টা করি সব ভাইবোন ওদের বাচ্চা কাচ্চা সবাই অন্তত এক বেলা একসাথে হতে।

আনন্দ তো করবই, আনন্দই মুল- কিন্তু যে আনন্দ আমার সাংস্কৃতিক পরিচয় ও সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারকে ধারণ করে না সেটা বড়ই নিম্নমানের স্থূল আনন্দ। 

পহেলা বৈশাখ যদি আপনি ঢাকায় উদযাপন করতে চান তাইলে তো বিজুর সময় আর রাঙামাটি যেতে পারবেন না। এই কারণে আমার আর বিজুতে রাঙামাটি যাওয়া হয়না। জেনেছি যে এখন নাকি রাঙামাটিতে বিজু উপলক্ষে অনেক আয়োজন হয়। অনেক মেলা হয়, দোকানপাট বেসে, কনসার্ট হয়, গান বাজনা নাচের অনুষ্ঠান হয়। আমি যদি রাঙামাটি থাকতাম তাইলে সম্ভবত বিজু উপলক্ষ্যে ছোট একটা সাহিত্য সংকলন করতে চেষ্টা করতাম। কেউ কেউ নিশ্চয় সেটা করেন, আমারই হয়তো জানা নেই। বেশী অনুষ্ঠান হতে থাকলে অনেক সময় উৎসবের মুল সুরটা ম্লান হয়ে যায়- বিজু উপলক্ষ্যে রাঙায় এরকম হয় কিনা জানিনা।

সমানে বিজু, রাঙামাটিতে এখন নিশ্চয়ই ছেলে মেয়ে বুড়ো বুড়ী সবাই বিজুর প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। উদযাপনের ধরন পাল্টেছে, উৎসবের ব্যপ্তিও বেড়েছে নিশ্চয়ই। তথাপি মুল সুরটা কখনো পাল্টায় না। চৈত্রের দাবদাহ, বছরের শেষ দিন, পাহাড়ে প্রকৃতির রূপ রঙ পরিবর্তনের সূচনা এই সব মিলিয়ে চাকমা সমাজের এই উৎসবের দিনে চাকমা তরুণ তরুণীরা নিজেদের উৎসের দিকে ফিরে তাকাবেন, আত্ম পরিচয়, জাতিগত অধিকার, বৈষম্য বঞ্চনার বিরুদ্ধে লড়াই এই সবকিছুই নিশ্চয়ই তরুণদের উৎসব উদযাপনের অনুষঙ্গ হয়ে আছে এখনো। নিজের দিকে ফিরেও তাকাবো এবং নিজের পরিচয়েই আনন্দ করবো।

(৩)

আনন্দ তো করবই, আনন্দই মুল- কিন্তু যে আনন্দ আমার সাংস্কৃতিক পরিচয় ও সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারকে ধারণ করে না সেটা বড়ই নিম্নমানের স্থূল আনন্দ। রাঙাতে তরুণ বন্ধুরা যারা আছেন, আমি জানি এই বিজুতে আপনাদের উদযাপনের সুরেও বিশ্বব্যাপী আদিবাসী মানুষের যে চলমান সংগ্রাম বৈষম্য ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে সেই সূরও এসে মিশে যাবে। গেংখুলির সুরে দেখবেন একটা প্রলম্বিত উদাসীন সুর অন্তর্ভুক্ত থাকে- সেই সুরটা হচ্ছে পাহাড়ের মানুষের জীবনের আনন্দের সাথে উচ্ছ্বাসের সাথে কান্নার সংযোগ। সেই কন্নাটা, সেটা মনে রাখবেন।

বিজু নিয়ে আলাপ করলেই লোগাং এর কথা মনে পড়ে। কেননা আমার দেখা মতে সেই একবারই বিজু উৎসব বর্জনের কথা হয়েছিল- সেবারের বিজু ছিল কান্নার বিজু, ক্রোধ ও বেদনার বিজু। আপনি যখন এইবার বিজুতে আনন্দ করবেন, আনন্দ নিশ্চয়ই করবেন- সেটা জীবনেরই অংশ, সারা দিনের আনন্দের এক ফাঁকে অন্তত একটা মিনিটের জন্যে হলেও লোগাং এর কথা স্মরণ করবেন। ভুলবেন না।

সকলেই ভাল থাকুন। আনন্দ হোক।

* লেখাটি লেখক ইমতিয়াজ মাহমুদ-এর ফেসবুক থেকে নেওয়া।



This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More