বিপুল চাকমাসহ ৪ জনকে হত্যা ও পাহাড়-সমতলে সকল রাজনৈতিক হত্যার বিচার দাবিতে গণতান্ত্রিক ছাত্রজোটের বিক্ষোভ সমাবেশ

ঢাকা প্রতিনিধি, সিএইচটি নিউজ
শনিবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫
শহীদ বিপুল-সুনীল-লিটন-রুহিনসহ পাহাড় ও সমতলে সংঘটিত সকল রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের বিচার, পার্বত্য চট্টগ্রামে চলমান সেনাশাসন প্রত্যাহার এবং সেনা অভিযানের নামে ধরপাকড়, নির্যাতন ও হয়রানি বন্ধের দাবিতে ঢাকায় বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে গণতান্ত্রিক ছাত্র জোট।
আজ শনিবার (১৩ ডিসেম্বর ২০২৫) বিকাল ৪টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাজু ভাস্কর্য পাদদেশে এই বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
সমাবেশের শুরুতে গণতান্ত্রিক ছাত্র জোটের নেতৃবৃন্দ শহীদ বিপুল-সুনীল-লিটন-রুহিন বিকাশে প্রতি ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান এবং এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।

সমাবেশের সভাপতি ও পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সভাপতি অমল ত্রিপুরা বলেন, পতিত আওয়ামী সরকারের সাথে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মধ্যে কোন পার্থক্য দেখতে পাই না। অন্তর্বর্তী সরকারেরে ১৪ মাসে পরস্থিতির কোন পরিবর্তন ঘটেনি। সারাদেশে প্রতিনিয়ত গুম, খুন, হত্যা, নিপীড়ন, বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের নিপীড়নের চিত্র তুলে ধরে অমল ত্রিপুরা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি মোকাবেলা করে জীবন অতিবাহিত করছে। ২০২৫ সালে পুরো বছর জুড়ে চলছে সন্ত্রাস দমনের নামে সেনাবাহিনীর অপারেশন। সেনা অভিযানে নামে সাধারণ পাহাড়িদের বাড়ি-ঘরে তল্লাশি, হয়রানি, ধরপাকড় এবং নির্যাতনের মতো প্রতিনিয়ত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে।
অমল ত্রিপুরা আরো বলেন, “নারী নেত্রী কল্পনা চাকমা বলেছিলেন পাহাড়ের নিপীড়ন সমতলে নেমে আসবে। গতকাল ওসমান হাদীকে হত্যার চেষ্টা কল্পনা চাকমার বক্তব্যের সত্যতা প্রমাণ করে৷ ওসমান হাদীর রাজনৈতিক অবস্থান যাই হোক এসকল ঘটনার নিন্দা এবং পাহাড়-সমতলে সকল রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবি জানাই।”
তিনি আরো বলেন, নির্বাচন কমিশন ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন তফসিল ঘোষণা করেছে। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনা অভিযান অব্যাহত রেখে জনগণের মধ্যে ভয়-ভীতকর পরিস্থিতি জিইয়ে রেখে কিভাবে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে?
তিনি অবিলম্বে পার্বত্য চট্টগ্রামে চলমান সেনা অভিযান বন্ধ করে গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করা, পাহাড়িদের প্রথাগত ভূমি অধিকার ও জাতিসত্তা সাংবিধানিক স্বীকৃতি সহ পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের অধিকার পূর্ণস্বায়ত্তশাসন মেনে নেয়ার আহ্বান জানান।

সাবেক ছাত্রনেতা ইকবাল কবীর বলেন, “বিপুল চাকমা কেবল পাহাড়ের জনগোষ্ঠীর মুক্তির লড়াইয়ে সীমাবদ্ধ ছিলেন না, তিনি সমতল–পাহাড়ের যৌথ ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলন, শিক্ষা রক্ষা আন্দোলন ও ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। রাষ্ট্রীয় গুন্ডাবাহিনী মোকাবিলা করে পাহাড়ে আন্দোলন সংগঠিত করার দুঃসাহস দেখানোর কারণেই রাষ্ট্র তাঁদের হত্যা করেছে।
তিনি আরও বলেন, পাহাড় থেকে সমতল যতদিন না দমন–পীড়ন বন্ধ হচ্ছে, ততদিন সংগ্রাম চলবে।
সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সভাপতি সালমান সিদ্দিকী বলেন, “ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়—উগ্র জাতীয়তাবাদী ধারণা শেষ পর্যন্ত ফ্যাসিবাদের দিকেই সমাজকে ঠেলে দেয়। এই দেশেও ঠিক এই পথেই বারবার স্বৈরাচারের জন্ম হয়েছে। ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষের ওপর নিপীড়ন চালিয়ে কখনোই একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মাণ করা সম্ভব নয়। পাহাড় বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ; অথচ সেই পাহাড়কে নিপীড়নের মাধ্যমে দমিয়ে রেখে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার কোনো পথ নেই।”

বিপ্লবী ছাত্র-যুব আন্দোলনের সহ-সভাপতি নাইম উদ্দীন তাঁর বক্তব্যে বলেন, “সরকার পরিবর্তন হলেও ‘আদিবাসীদের’ জীবনে কোনো মৌলিক পরিবর্তন আসেনি। পাহাড়ে বসবাসরত বিভিন্ন জাতিসত্তার জনগণের ভূমি সমস্যার সমাধান এখনো হয়নি। চলমান জাতিগত নিপীড়নের মধ্য দিয়ে লাভ হচ্ছে কেবল গুটিকয়েক শাসকশ্রেণির ও তাদের এ শোষণব্যাবস্থা রক্ষা করতেই পাহাড়ে বরাবর সেনা মোতায়ন জোরদার করা হয়েছে। এ সেনাবাহিনী জনগণের পক্ষে নয় বরং সাম্রাজ্যবাদী ও তাদের তাঁবেদার দালাল শাসকদের স্বার্থ রক্ষা করে। এ নিপীড়ন বন্ধ করতে নিপীড়িত জাতিসত্তার জনগণের সাথে নিপীড়িত বাংগালীদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করা জরুরি সেই শাসকশ্রেণির বিরুদ্ধে। আমরা আন্তর্জাতিক ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে কথা বললেও নিজেদের রাষ্ট্রের ভেতরে আদিবাসীদের ওপর চলমান নিপীড়ন নিয়ে নীরব থাকি। যে রাষ্ট্র শ্রমিক, কৃষক, আদিবাসী ও নারীদের ওপর নিপীড়ন চালায়, সেই রাষ্ট্র কাঠামো ভেঙে জনগণের কাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্র গঠনের সংগ্রামে শামিল হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক ফাহিম আহমেদ চৌধুরী বলেন, “এই চারজন তরুণ নেতার হত্যাকাণ্ডের বিচার যেমন হয়নি, তেমনি পাহাড়ে নিপীড়নও বন্ধ হয়নি। আওয়ামী আমলের মতোই ইন্টেরিম আমলেও রাষ্ট্রীয় সহিংসতা অব্যাহত রয়েছে। তিনি সাম্প্রতিক সময়ে ওসমান হাদীর ওপর গুলি চালিয়ে হত্যাচেষ্টার ঘটনার উল্লেখ করে বলেন, এটি প্রমাণ করে যে অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশেও রাজনৈতিক কর্মী ও ভিন্নমতাবলম্বীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়নি। সমতলে গুলির ঘটনা আমাদের বিচলিত করলেও পাহাড়ে প্রতিদিন চলমান সেই গুলির শব্দ আমরা উপেক্ষা করি—এটাই রাষ্ট্রীয় বৈষম্যের বাস্তব চিত্র।

বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর সাধারণ সম্পাদক জাবির আহমেদ জুবেল বলেন, “পাহাড় ও সমতলের সংগ্রামকে একই বিন্দুতে যুক্ত করার ক্ষেত্রে বিপুল চাকমাদের ভূমিকা ছিল ঐতিহাসিক। তারা কখনোই নিজেদের লড়াই পাহাড়ে সীমাবদ্ধ রাখেননি; এই লড়াই ছিল দেশের গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের জন্য। তিনি বলেন, “ফ্যাসিবাদী আমলে যেমন গুম, খুন ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি ছিল, অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়েও তার ধারাবাহিকতা দেখা যাচ্ছে। কল্পনা চাকমার গুমের কোনো বিচার যেমন হয়নি, তেমনি সাম্প্রতিক সময়ে ওসমান হাদীর ওপর প্রকাশ্যে হত্যাচেষ্টার ঘটনায়ও আমরা জান–মালের নিরাপত্তা নিয়ে গভীর অনিশ্চয়তার মুখোমুখি হয়েছি। তিনি বলেন, পাহাড়ে এই সহিংস বাস্তবতা আরও তীব্র, যেখানে সেনাবাহিনী ও তাদের মদদপুষ্ট সন্ত্রাসীদের ভূমিকা বারবার সামনে আসছে এবং প্রত্যেক হামলা, নিপীড়নের বিচারের দাবি উঠলে আদিবাসীদের আওয়ামী দোসর ট্যাগ দেওয়া হয়৷ অথচ পাহাড়ের এই নেতাদের আহ্বানে পাহাড়ের আদিবাসী জনগোষ্ঠী ২৪ এর ডামি নির্বাচন প্রত্যাখান করে ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত হয় নাই।”
সমাবেশে সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে গণতান্ত্রিক যুব-ফোরামের সভাপতি জিকো ত্রিপুরা বলেন, “সেনাবাহিনীর মদদপুষ্ট রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসীদের হাতেই এই চারজন তরুণ নেতাকে হত্যা করা হয়েছে। অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে দাঁড়িয়ে আজও এই হত্যাকাণ্ডের বিচার না হওয়া গভীর উদ্বেগজনক।”
সমাবেশ থেকে অবিলম্বে সকল রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের বিচার, পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাশাসন প্রত্যাহার এবং পাহাড়–সমতলে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করার জোর দাবি জানানো হয়।
সমাবেশে সঞ্চালনা করেন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি তামজীদ হায়দার চঞ্চল।
সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।
