ভাইয়ে ভাইয়ে সংঘাত বড়ই পীড়াদায়ক- রাজা দেবাশীষ রায়

বক্তব্য রাখছেন রাজা দেবাশীষ রায়
দীঘিনালা প্রতিনিধি, সিএইচটি নিউজ
সোমবার, ৭ এপ্রিল ২০২৫
‘ভাইয়ে ভাইয়ে সংঘাত বড়ই পীড়াদায়ক’ বলে মন্তব্য করেছেন রাজা দেবাশীষ রায়।
গতকাল রবিবার (৬ এপ্রিল ২০২৫) বিকালে দীঘিনালার বাবুছড়ায় ৬দিন ব্যাপী বৈ-সা-বি মেলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের উদ্বোধক হিসেবে আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি এ মন্তব্য করেন।
এর আগে তিনি ফিতা কেটে অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেন। সর্বজনীন বৈ-সা-বি উদযাপন কমিটি এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে।

ফিতা কেটে অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করছেন দেবাশীষ রায়
রাজা দেবাশীষ রায় তাঁর বক্তব্যে বলেন, আমাদের এখনো ভাইয়ে ভাইয়ে, দলে দলে সংঘাত চলমান রয়েছে। এটা বড়ই পীড়াদায়ক। তাই কীভাবে এ সংঘাত বন্ধ করা যায় আমাদের সেই চেষ্টা করতে হবে। তিনি এ সংঘাত বন্ধের লক্ষ্যে সবাইকে চেষ্টা চালানোর আহ্বান জানান।
তিনি চাকমা সমাজে একটি পুরোনো রীতি ‘মালেয়ে’ সম্পর্কে বলেন, এই ‘মালেয়ে’ মানে হচ্ছে সমবায়। এটা হচ্ছে সংহতি, একতা ও ভ্রাতৃত্ব। এর মাধ্যমে কেউ ঘর তুলতে গেলে, ঘরের চালা দিতে গেলে, কারোর ধান কাটার জন্য পরস্পরের মধ্যে সহযোগিতা প্রদান করা হয়। আমরা যদি মালেয়ে ডাকি তাহলে সকলে আমাদের সহযোগিতা করবে। তাহলে আমরা কেন এটা করতে পারবো না?
রাজা দেবাশীষ রায় বলেন, আমাদের যেসব ভালো রীতি-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি রয়েছে সেগুলো রক্ষা করা দরকার। জাতির ভালো রীতি, ঐতিহ্য-সংস্কৃতি যদি আমরা রক্ষা করি তাহলে আমাদের উন্নতি হবে। তবে যেগুলো খারাপ সেগুলো আমাদের পরিহার করতে হবে।
তিনি আরো বলেন, আমাদের নারী-পুরুষ এক সাথে এগিয়ে যেতে হবে। কোন একটি জাতিকে উন্নতির শিখড়ে পৌঁছতে হলে নারীদের বাদ দিয়ে তা সম্ভব নয়। আমরা চাকমা, মারমা, ত্রিপুরাসহ যেসব জাতিগুলো রয়েছি আমাদেরকে প্রগতিশীল দর্শন, নীতি মানতে হবে।
বাংলাদেশ রাষ্ট্র এখনো “আদিবাসী” বান্ধব নয়, পাহাড়ি বান্ধব নয় মন্তব্য করে দেবাশীষ রায় বলেন, এখানে বৈষম্য রয়েছে, হিংসে রয়েছে। এখান থেকে উত্তরণ ঘটবে কিনা আমি জানি না। তবে যেই হোক, আমরা যেহেতু এ রাষ্ট্রে বসবাস করছি সেহেতু এ রাষ্ট্র যাতে গণতান্ত্রিক হয় সে চেষ্টা আমাদেরকে করতে হবে।

অনুষ্ঠানে উপস্থিতি লোকজনের একাংশ
তিনি জুম্মদের নিজস্ব কৃষ্টি, ঐতিহ্য ধরে রাখার আহ্বান জানিয়ে বলেন, মুসলমান ধর্মাবলম্বীরা তাদের ঈদের সময় সেমাই, গরু মাংস, ছাগলের মাংস খেয়ে থাকেন। কিন্তু তারা তো আমাদের এখানে ‘চিদোল’ খেতে আসেন না, ‘পাজন’ খেতে আসেন না। তাহলে চাকমা বা জুম্মদের কেন নুডলস, বিরিয়ানি খেতে হবে। আমরা আমাদের রীতি-ঐতিহ্যগুলো যদি রক্ষা না করি, না মানি, তাহলে কারা সেগুলো রক্ষা করে দেবে? সরকার কী আমাদের রীতি-ঐতিহ্য রক্ষা করে দেবে? এটা আশা করবেন না। আমাদেরকেই আমাদের রীতি, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি রক্ষা করতে হবে।
রাজা দেবাশীষ রায় বলেন- আমরা হয়তো এখানে থাকবো, পাকা বিল্ডিংয়ে থাকবো, তিন তলা বিল্ডিংয়ে থাকবো, বড় বড় গাড়িতে চড়বো, কিন্তু জাত না থাকলে কোন কিছুই থাকবে না।
তিনি বলেন, কেউ বড় লোক হয়েছে, পাঁচতলা বিল্ডিংয়ে থাকছে, কিন্তু জাতির উন্নতির জন্য কিছুই করেনি, জাতির উপকারে কিছুই করেনি, সে ধরনের মানুষতো আমরা চাই না। প্রয়োজনে তাদেরকে সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে। যত বড় লোক হোক না কেন, যত বড় মন্ত্রী, এমপি, চেয়ারম্যান হোক না কেন, আমরা যদি সবাই এক থাকি তাহলে সে ধরনের মানুষ আমাদের দরকার নেই।
তিনি আরো বলেন, আগেকার দিনে আমাদের চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যাসহ অন্যান্য জুম্ম জাতিদের ওপর বাইরের চাপ কম ছিল, এখন অনেক বেড়েছে। তাহলে আমরা আমাদের নিজেদের পরিচয়-স্বকীয়তা নিয়ে কীভাবে টিকে থাকবো? এর একমাত্র উপায় হলো “বিঝু’র মতো এসব উৎসবের দিনগুলোতে আমাদের নিজস্ব রীতি, ঐতিহ্য, সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে তুলে ধরা।
তিনি “ফুল বিঝু’র দিনে “ফুল ভাসানো’ শব্দটির আপত্তি জানিয়ে বলেন, “ফুল ভাজানা নয়, ফুল গজানা”। আমি যতটুকু জানি, আমরা গাঙ বা নদী/ছড়া পাড়ে ফুল “গোজেদং’, ফুল ‘ন ভাজেদং’। তবে কখন থেকে ‘ফুল ভাজানা’(ভাসানো) শব্দটি এসেছে আমি জানি না। কাজেই, আমরা ফুল ভাসানোর পরিবর্তে এখন থেকে “ফুল গজানা” (ফুল নিবেদন/অর্পণ) রীতি ফিরিয়ে আনতে পারি।
তিনি অতীতের স্মৃতি তুলে ধরে বলেন, বিঝু উৎসবকে চাকমা, ত্রিপুরা, মারমা, তঞ্চঙ্গ্যাসহ বিভিন্ন জাতি-সম্প্রদায় নিজ নিজ ঐতিহ্যগত নামে পালন করে থাকে। এ উৎসব পালনকালে আমরা ফুল বিঝু ও মূল বিঝুর দিনে নিরামিষ খেতাম।
এখানে আমি বলতে চাই যে, বাঙালিরা তাদের ঈদের দিনে সেমাই-মাংস খান, হিন্দুরা দুর্গাপূজার সময় প্রসাদ বিতরণ করেন। তাহলে আমাদের চাকমা বা অন্যান্য জুম্মরা কেন নুডলস, বিরিয়ানি দেবে? আমিতো লজ্জাবোধ করি। অথচ বাঙালিরা-মুসলিমরা, হিন্দুরা তাদের যে নিজ নিজ ঐতিহ্য রয়েছে সেগুলো পালন করে থাকে।
রাজা দেবাশীষ রায় আরো বলেন, উৎসবের সময়ে আমাদের চাকমা নারীরা পিনোন-খাদি, ত্রিপুরা নারীরা রিনাই, মারমা নারীরা থামি পরিধান করে থাকেন। কিন্তু আমরা পুরুষরা কি পরিধান করি? কখনো পাঞ্জাবি, কখনো কোট, কখনো স্যুট পরে থাকি। পুরুষ হয়ে আমার লজ্জা লাগে। তিনি উৎসবের সময় নিজেদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরিধান করার পরামর্শ দেন।
সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।