মতামত

মাইসছড়ি: জমির মালিক হওয়া যেখানে অপরাধ

0

এম চাকমা


পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি বেদখলের হটস্পটগুলোর একটি হলো মাইসছড়ি। এখানে এই সমস্যা এতই প্রকট যে, পাহাড়ি লোকজন সব সময় কখন তাদের জমিতে ভূমিদস্যুদের থাবা পড়ে সেই আশঙ্কায় দিন কাটাতে বাধ্য হয়। ভূমি দস্যুতা এখানে কোন অপরাধ নয়, তাই ভূমি দস্যুদের কোন শাস্তি হয় না। বরং যারাই এতে বাধা দেয়ার চেষ্টা করে তাদেরই বিরুদ্ধে মামলা হয়, শাস্তি হয়। আর যার জমি কেড়ে নেয়া হয় অর্থাৎ যে ভূমির মালিক তার দুর্ভোগ ও হয়রানির সীমা থাকে না, যেন জমির মালিক হওয়াই তার অপরাধ। একে তো জমি হারানোর তীব্র মনোবেদনা, তারপর মরার উপর খাড়ার ঘা’র মতো নিকটস্থ ক্যাম্পে হাজির হওয়ার জন্য ডাক পড়ে। জমির দলিল দেখাতে হয়, যেন ক্যাম্প নয়, ভূমি অফিস। মহোদয় ভূমি দস্যু ও ভূমি মালিকের মধ্যে ‘আপোষ-নিষ্পত্তির’ ফর্মূলা দেন। দস্যুবৃত্তির পুরস্কার আছে, অতএব  জমি ভাগ করতে হবে!

গত বছর ৫ জুলাই দক্ষিণ জয়সেন পাড়ায় সেটলার বাঙালিরা পাহাড়িদের গ্রামে হামলা চালিয়ে ৩৭টি ঘরবাড়ি পুড়িয়ে ভাংচুরে কলে তছনছ করে দেয়। ফাইল ছবি

মাইসছড়িতে বর্তমানে পাহাড়িদের জন্য জমির মালিক হওয়াই যেন সবচেয়ে বড় অপরাধ। প্রমাণস্বরূপ সাম্প্রতিক কালের কিছু উদাহরণ দেয়া যাক। বদানালা গ্রামে বসবাস দেবপ্রিয় চাকমার। সেখানে তার ১৯৬৪-৬৫ সালে সরকারী বন্দোবস্তীপ্রাপ্ত ৩ একর জমি আছে। গত নভেম্বরে (২০২২ সাল) মোঃ সাইফুল নামে এক সেটেলার তার জমির কিছু অংশ দখল করে একটি বাড়ি নির্মাণ করে। মাইসছড়ি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সাজাই মারমা তাকে অন্যের জমিতে বাড়ি করতে নিষেধ করেন।  কিন্তু সাইফুল তাতে পাত্তা দেয়নি, কারণ তার খুঁটির জোর আছে। এলাকায় এ নিয়ে তীব্র ক্ষোভ ধূমায়িত হয়ে ওঠে এবং গ্রামের লোকজন একদিন ওই সেটেলারের তোলা অবৈধ বাড়ি ভেঙে দেয়ার চেষ্টা করে। সেটেলার পক্ষ মওকা পেয়ে যায়; আর যায় কোথায়! মামলার ছুরি চালানো হয় জমির মালিকসহ বেশ কয়েকজনের নামে। এমনকি একজন সরকারী চাকুরীজীবীকেও মামলায় আসামী করা হয়; তিনি ছুটিতে সেই রাতেই বাড়ি এসেছিলেন। তাকেও আসামী করা হলো। আর যে অন্যের জমিতে অবৈধ অনুপ্রবেশ করে অবৈধ দখল নিয়েছে তার কিছুই হলো না, বরং নিরাপত্তা বাহিনী এখন তার সেই অবৈধ বাড়ি নিয়মিত পাহারা দিয়ে যাচ্ছে। (তা না হলে ‘নিরাপত্তা বাহিনী’ হবে কেন!)

ডাকাতদের একটা নিয়ম আছে। তারা একবার যার বাড়িতে ডাকাতি করে, বার বার সেই বাড়িতেই ডাকাতি করে। মাইসছড়ির ভূমি দস্যুরাও দস্যুবৃত্তির এই সূত্রটির স্বার্থক প্রয়োগ করে চলেছে। দক্ষিণ জয়সেন পাড়ার হৃদয় চাকমা, ইউপি নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতাও করেছিলেন একবার। তার জমির পরিমাণ ৮ একর, খতিয়ান নং আর – ১৯। তার এই জমিতে প্রথম সেটেলার নখর বসে ২০০৭  সালে সেনা-সমর্থিত জরুরী অবস্থার সময়। সে বছর ১২ জুলাই জাহিদুল নামে জনৈক সেটেলার সেনা সদস্যদের সাহায্য নিয়ে তার জমির একাংশ জোরপূর্বক দখল করে নেয়। বাধা দেয়াতে কোন কাজ হয়নি। জাহিদুল থেমে থাকেনি। সে আবার ২০০৯ সালের ৩ ডিসেম্বর হৃদয় চাকমার কাছ থেকে আরও জমি কেড়ে নিতে তার লাগানো গাছ কেটে দেয়। বাধা দিলে সংঘর্ষ বেঁধে যায়। অতঃপর স্থানীয় মেম্বার সাহেব সেটেলার লিডারদের নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে সালিশ করেন, উভয়ের জমির ‘সীমানা’ ঠিক করে দেয়া হয়। কিন্তু জাহিদুল তাও মানেনি। ২০১১ সালের ৫ এপ্রিল সে আবার হৃদয় চাকমার জমিতে অবৈধ প্রবেশ করে গাছ কাটে। এবার উপজেলা নির্বাহী অফিসার সমঝোতার উদ্যোগ নেন, তিনি “সীমানা” পূর্ববৎ বহাল রাখেন, আর জাহিদুলকে গাছ না কাটার নির্দেশ দেন। কিন্তু সেই নির্দেশকেও বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সে হৃদয় চাকমার জমি জোর করে দখলে নিয়ে বাড়ি নির্মাণ করে। বলা নিষ্প্রয়োজন, এতে কেউ তার কেশাগ্রও স্পর্শ করতে পারেনি।

বদনালা গ্রামে দেবপ্রিয় চাকমার জায়গায় মো. সাইফুল নামে এক সেটলার বাঙালির তৈরি করা ঘর। সেনাবাহিনীর সদস্যরা বর্তমানে নিয়মিত ওই বাড়িতে পাহার দেয় বলে জানা যায়।

তবে ঘটনা এখানেই শেষ নয়। পাহাড়ে একটা জোঁক রক্ত খেয়ে ঝরে পড়লে আরও একটা ধরে। হৃদয় চাকমারও সেই দশা হয়। জাহিদুলের পর এবার বেলাল হোসেন। সে ২০১২ সালের ৭ মার্চ জমি-ডাকাতি করতে তার জমির জঙ্গল সাফ করে। হৃদয় আদালতের শরণাপন্ন হন। চার বছর মামলা চলার পর আদালত রহস্যজনক কারণে মামলা খারিজ করে দেন। এতে উৎসাহিত হয়ে হৃদয় চাকমার নামীয় দুই একর পরিমাণ জমির দখল নিতে জাহিদুল, বেলাল ও গফুর হামলে পড়ে। গত ১০ জানুয়ারী তারা তার বাগানের গাছ কাটতে যায়। হৃদয় এতে বাধা দেন, আর মহালছড়ি থানায় অভিযোগ করেন। কিন্তু কোন ফল হয়নি।

এ রকম ভূমি দস্যুতার ঘটনা বলে শেষ করা যাবে না। বদানালার দেবপ্রিয় চাকমার জমিও (উপরে বর্ণিত) অনেকবার বেদখলের কবলে পড়েছে। তার জমির একাংশ এখনও সেটেলাররা বেদখল করে সেখানে বসবাস করছে।

ভূমি-ডাকাতিতে যে কেবল নিরাপত্তা বাহিনীর উস্কানি-সহযোগিতা থাকে তা নয়, রাজনৈতিক দলের নেতারাও সেটেলারদের এই সেবাদানে পরাক্সমুখ হন না। ২০২১ সালের ৫-৬ অক্টোবরের ঘটনা। দৃশ্যপট: মাইসছড়ি ইউনিয়নের ৩ নং ওয়ার্ডের মানিকছড়ি ও নুনছড়ির মধ্যবর্তী এলাকা। সেখানে পাঁচ জন পাহাড়ির ৫ একর পরিমাণ জমির অবৈধ দখল নিতে পাকুজ্যাছড়ি গুচ্ছগ্রামের সেটেলাররা রকেট-গতিতে ২৫টি বাড়ি নির্মাণ করে। এতে নেতৃত্ব দেয় মাইসছড়ি ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি জহিরুল ইসলাম ওরফে জহির।

দক্ষিণ জয়সেন পাড়ায় সেটলারদের হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত পাহাড়িদের জায়গায় স্থাপন করা হয় সেনা ক্যাম্প (গোল চিহ্নিত)। ওই ক্যাম্পের সেনারা পাহাড়িদের নিজ জায়গা-বসতভিটায় যেতে বাধা প্রদান করে থাকে বলে অভিযোগ রয়েছে। ফাইল ছবি

ডাকাতির সাথে গলায় গলায় ভাব হলো হামলা, খুন, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের; অনেক সময় ধর্ষণেরও। বেশী দেরীর কথা নয়, গত বছর (২০২২) ৫ জুলাই-এর ঘটনা। জয়সেন পাড়ার পাহাড়িদের কিছু জমি দখল করতে কয়েক শত সেটেলার ৩৭টি বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়, ভাঙচুর করে ও ব্যাপক লুটপাট চালায়। এ হামলায় নেতৃত্ব দেয় জাহিদুল, ইউসুফ ও জাহাঙ্গীর। হামলাকারীদের নিরাপত্তা দেয়ার জন্য আশেপাশে মোতায়েন করা হয় সেনা ও পুলিশ সদস্য। প্রকাশ্য দিবালোকে হামলা, হামলাকারীরাও চিহ্নিত। কিন্তু তারপরও তারা গ্রেফতার হলো না, শাস্তি সুদূরের কথা। অন্যদিকে ঘটনার পর থেকে জমির মালিকরা আর তাদের জমিতে, ক্ষেতে যেতে পারছে না। কারণ ২১ জুলাই থেকে তাদের ওই জমিতে নিরাপত্তা বাহিনী ক্যাম্প বসিয়ে দিয়েছে। এভাবে অসহায় পাহাড়ির নিজের জমি পর হয়ে যায়। পাহাড়ে সেটেলার হামলা ও ভূমি হারানোর এই হলো প্যাটার্ন, যা অতীতেও বহুবার হয়েছে এবং আশঙ্কা করা যায় ভবিষ্যতেও হবে।

ভূমি বেদখলে নিরাপত্তা বাহিনীর সহ-অপরাধী হওয়ার আরও একটি দৃষ্টান্ত হলো গত বছর ১৫ মার্চ ডিপ্পোছড়ি গ্রামের হামলা। এদিন জয়সেন পাড়ার মোঃ নাজিম, বেলাল ও নজরুলের সেটেরার বাহিনী পাহাড়িদের ৯টি বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। হামলার সময় একদল সেনা সদস্য ঘটনাস্থলের পাশে অবস্থান নেয়। ভয়ে পাহাড়িরা ঘরে ছেড়ে পালিয়ে যায়।

ভূমি দস্যুদের লোলুপ দৃষ্টি থেকে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের জমিও বাদ যায় না। উদাহরণ আছে। গত বছর ১০ ফেব্রুয়ারী আবু বক্কর ও শাহীনের নেতৃত্বে সেটেলাররা লেমুছড়ির আর্য সমাধি ভাবনা কুটিরের ১৫ একর জমি বেদখল করতে গেলে ব্যাপক উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। জমি বেদখলে ব্যর্থ হওয়ার পর সেটেলাররা দুপুরের দিকে জয়সেন পাড়ায় হামলার চেষ্টা চালায়, তবে সেখানেও তাদেরকে প্রতিরোধ করা হয়।

এভাবে সংগঠিত হয়ে রুখে দাঁড়ালে অনেক সময় ভূমি দস্যুরা পিছু হটে যেতে বাধ্য হয়। ২০১১ সালের ৯ ও ১৭ সেপ্টেম্বরও তাই হয়েছিল। হাজাছড়ি ও মানিকছড়ি রবিচন্দ্র পাড়ায় ভূমিদস্যু সেটেলাররা পাহাড়িদের জমিতে জোর করে বাড়ি নির্মাণ করে। তবে গ্রামের লোকজন এক হয়ে প্রতিরোধ করে এবং অবৈধ বাড়িগুলো ভেঙে দেয়।

বন্দোবস্তীকৃত বা রেকর্ডিয় জমি জবরদখল করা ভূমিদস্যুদের জন্য কিছুটা অসুবিধাজনক, যদি ভূমি মালিক সাহস করে প্রতিবাদ করেন। কিন্তু তারপরও তারা হাল ছাড়ে না। এ ক্ষেত্রে তাদের কৌশল হলো ঐ পাহাড়ি ভূমি মালিকের জমিকে “বিরোধপূর্ণ” করে দেয়া, যাতে নিজের জমি সে ভোগদখল করতে না পারে। একটি ঘটনা এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। দক্ষিণ জয়সেন পাড়ার কার্বারী নোয়ারাম চাকমার ৫ একর বন্দোবস্তীকৃত জমি রয়েছে। ১৯৬৫-৬৬ সালে সরকারীভাবে জমিটি রেজিস্ট্রি করা। এই জমি পাকুজ্যাছড়ি গুচ্ছগ্রামের রশিদ নামে জনৈক সেটেলার বাঙালি ১৯৮২ সালের একটি কবুলিয়ত দেখিয়ে বেদখলের চেষ্টা চালায়। ২০১৭ কিংবা ১৮ সালের দিকে ঠিক হয় আমিন-কানুনগো দিয়ে উক্ত জমি মাপা হবে। প্রশাসনের মতলব ছিল নোয়ারাম চাকমার ৫ একর জমি মেপে দেয়ার পর বাকি জমি রশিদকে দিয়ে দেয়া। কিন্তু যখন আমিন-কানুনগোরা বুঝতে পারে যে জমির পরিমাণ ৫ একরের বেশী হবে না, তখন সেটেলাররা গ-গোল পাকায়, ফলে জমি আর পরিমাপ করা হয়নি। পরে থানা থেকে জানিয়ে দেয়া হয় কোন পক্ষ উক্ত জমিতে প্রবেশ করতে পারবে না। ফলে মালিকানার সরকারী দলিল থাকা সত্বেও প্রশাসন-ভূমিদস্যু সেটেলারদের মিলিত ষড়যন্ত্রের কারণে নোয়ারাম চাকমা তার জমি ভোগ দখল করতে পারছেন না।

বদনালায় দেবপ্রিয় চাকমার জমি থেকে অবৈধ দখলদার সেটলার কর্তৃক নির্মিত ঘর উচ্ছেদ ও জয়সেন পাড়া থেকে নিরাপত্তা বাহিনীর চৌকি তুলে নেয়ার দাবিতে এলাকাবাসী বিক্ষোভ মিছিল করেন। ছবি: ১৬ ডিসেম্বর ২০২২।

গত শতকের আশির দশকে, নির্দিষ্ট করে বললে ১৯৮২ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত চার বছরে মহালছড়ি উপজেলায় শত শত বাঙালি সেটেলার পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়। তখন থেকেই পাহাড়িদের জীবন থেকে শান্তি উধাও হয়ে যায়। পাহাড়িদের হাজার হাজার একর ভূমি জোরপূর্বক কেড়ে নিয়ে বাঙালিদের দেয়া হয়। ভূমি বেদখল প্রাত্যহিক ঘটনায় পরিণত হয়। মাইসছড়ি ইউনিয়নের যেসব এলাকায় বাঙালিদের পুনর্বাসন করা হয় সেগুলো হলো জয়সেনপাড়া, লেমুছড়ি, বদানালা, পাকুজ্যাছড়ি, কাটিং টিলা। মাইসছড়ি ইউনিয়ন ছাড়াও মহালছড়ি সদর ইউনিয়নেও বাঙালিদের বসতি দেয়া হয়। সরকারী ব্যবস্থাপনায় তাদের পুনর্বাসনের জন্য তখন পশ্চিম কিয়াংঘাটে অস্থায়ী ট্রানজিট ক্যাম্প খোলা হয়। ডিএসপি ছিলেন এই ক্যাম্পের চেয়ারম্যান, সহসভাপতি করা হয় বিন্দু কুমার চাকমাকে ও সেক্রেটারী করা হয় স্কুল শিক্ষক সভাপূর্ণ চাকমাকে (বর্তমানে মৃত)। জানা যায় সে সময় অনেকে বাঙালিদের পুনর্বাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন, কিন্তু কোন কাজ হয়নি।

১৯৮৬ সালে শান্তিবাহিনীর সশস্ত্র প্রতিরোধের মুখে বাঙালিদের ভূমি বেদখল কার্যক্রম কিছুটা বাধার মুখে পড়ে। সেনাবাহিনী কৌশলগত কারণে জয়সেন পাড়া ও অন্যান্য এলাকা থেকে সেটেলারদের সরিয়ে নিয়ে পাকুজ্যাছড়ি গুচ্ছগ্রামে জড়ো করে। তবে পার্বত্য চুক্তির পর ২০০০ সাল থেকে তাদেরকে আবার জয়সেন পাড়ায় ফিরিয়ে নেয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। পাহাড়িদের বন্দোবস্তীকৃত ও দখলীয় জমিতে চলে তাদের পুনর্বাসন। ফলে আবার ভূমি বেদখল শুরু হয়। জেএসএস তখন ইউপিডিএফকে নির্মূলে এতই ব্যস্ত যে চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করে পাহাড়িদের জমিতে এই সেটেলার পুনর্বাসন কার্যক্রমের বিরোধীতা করার ফুরসৎ তারা পায়নি। তবে কোন কোন ভূমি মালিক নিজেদের উদ্যোগে আইনী পথে প্রতিরোধের চেষ্টা চালান। ৩৭ একর জমি বেদখলের বিরুদ্ধে মামলা হয়। জেলা প্রশাসন থেকে উক্ত জমিতে পুনর্বাসন কার্যক্রম না চালানোর নির্দেশ আসে। ফলে জয়সেন পাড়া থেকে ২/৩ পরিবার বাদে বাকি সকল সেটেলার পরিবার চলে যায়। কিন্তু ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর সেটেলারদের ভূমি বেদখল কার্যক্রম আবার জোরদার হয়। তৎকালীন খাগড়াছড়ির সংসদ সদস্য ওয়াদুদ ভূঁইয়া জয়সেন পাড়ায় পাহাড়িদের জমি বেদখল করে সেটেলারদের পুনর্বাসন করে। বর্তমানে এখানে আনুমানিক ৬০০ সেটেলার পরিবার বাস করছে বলে জানা যায়।

এত জমি বেদখল করার পরও সেটেলারদের ভুখ মেটে না। সুুযোগ পেলেই তারা পাহাড়িদের জমিতে হামলে পড়ছে। এ ব্যাপারে সবচেয়ে বেশী আগ্রাসী হলো জয়সেন পাড়ার সেটেলার জহিরুল হক ওরফে জয়দার, জাহেদুল ইসলাম ও আবদুল আজিজ। জহিরুল ২০০৩ সালে সিন্দুকছড়ি থেকে জয়সেন পাড়ায় চলে আসার পর থেকে ভূমি বেদখলে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছে। পাহাড়িদের জমি কেড়ে নিতে তারা সাম্প্রদায়িক হামলা চালাতেও কসুর করে না। ২০০৬ সালের ৩ এপ্রিল বৌদ্ধ শিশুঘর নামের একটি আশ্রমের জমি কেড়ে নেয়ার জন্য মাইসছড়ির নোয়াপাড়া ও সাপ্রু কার্বারী পাড়ায় বর্বর হামলা চালানো হয়। এ সময় ৫০ জন পাহাড়ি আহত হয়, ৪ পাহাড়ি নারী গণধর্ষণের শিকার হয় ও এক বৌদ্ধ ভিক্ষু লাঞ্ছিত হন।

২০০৭ সালে দেশে জরুরী অবস্থার সময় সারা পার্বত্য চট্টগ্রাম জুড়ে ভূমি বেদখলের মহোৎব শুরু হলে মাইসছড়িতেও সেটেলাররা মালকোচা দিয়ে নেমে পড়ে। তবে পাহাড়িরাও এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা চালান। মহালছড়ি ভূমি রক্ষা কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটি ২০০৭ সালের ৯ ডিসেম্বর মাইসছড়িসহ মহালছড়ির বিভিন্ন স্থানে ভূমি বেদখলের প্রতিবাদে ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। অপরদিকে ২১ নভেম্বর (২০০৭) মাইসছড়িতে ভূমি আগ্রাসন বন্ধের দাবি জানিয়ে  ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট-এর পক্ষ থেকে খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসকের কাছে একটি স্মারকলিপি দেয়া হয়।

বর্তমানে ভূমি বেদখলের বিরুদ্ধে মাইসছড়িতে পাহাড়িদের মধ্যে চরম ক্ষোভ ও অসন্তোষ বিরাজ করছে। তারা অনেক অন্যায় অবিচার নির্যাতন সহ্য করেছে, আর সহ্য করতে রাজী নয়। ভূমি রক্ষা ও হৃত ভূমি পুনরুদ্ধারের জন্য তারা এখন মরণপণ লড়াইয়ে প্রস্তুত। কোন ধরনের ভয়ভীতি দেখিয়ে তাদের নিবৃত্ত করা যাবে না।

———————

মহালছড়িতে এক পাহাড়ির রেকর্ডিয় জায়গায় সেটলার বাঙালির ঘর নির্মাণ (chtnews.blogspot.com)
পিতৃভূমি, ইস্যু নং ০৪, ২৬ ডিসেম্বর ২০০৭।


সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।


সিএইচটি নিউজের ইউটিউব চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব করুন

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More