মানিকছড়িতে জনৈক বাঙালি বৃদ্ধের খুনের রহস্য সম্পর্কে কিছু কথা

0

।। আপ্রু মারমা, সংবেদন চাকমা ।।
মানিকছড়ি ও রামগড়ের পরিস্থিতি গত আড়াই মাস ধরে উত্তপ্ত হয়ে আছে। সর্বশেষ গতকাল ৩ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার মানিকছড়িতে আবদুল মতিন নামে এক বাঙালি বৃদ্ধের রহস্যজনক মৃত্যুকে কেন্দ্র করে উষামং মারমা ও রিপ্রুচাই মারমা নামে দুই পাহাড়িকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

Commentaryউক্ত দুই ব্যক্তিসহ কয়েকজন পাহাড়ির কাছে বৃদ্ধ তার জমি বিক্রি করতে রাজী না হওয়ায় তাকে খুন করা হয় বলে পুলিশ বৃদ্ধের ছেলে আলী হোসেনের বরাত দিয়ে সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছে। পুলিশের বক্তব্য অনুযায়ী মতিন সাহেব জমির দাম চেয়েছিলেন ১২ লাখ টাকা। কিন্তু “ক্রেতারা দাম কম বলায় মতিন বিক্রিতে রাজী হয়নি। পরে তারা মতিনকে ভয়ভীতি দেখিয়েছিল বলে জানিয়েছেন আলী হোসেন।” কিন্তু বৃদ্ধকে হুমকি দেয়ার বিষয়ে থানায় অভিযোগ করা হয়নি বলে জানান ওসি। [দেখুন সুপ্রভাত বাংলাদেশ ৪ সেপ্টেম্বর২০১৫]

বৃদ্ধের মৃত্যুর পেছনে যে সুগভীর ষড়যন্ত্র রয়েছে তা অত্যন্ত পরিস্কার। প্রথমত: অনুসন্ধানে জানা গেছে বৃদ্ধ আবদুল মতিনের জমি ক্রয়-বিক্রয়ের প্রস্তাব-পাল্টা প্রস্তাব সম্পর্কে প্রতিবেশী ও অভিযুক্তদের পরিবারের সদস্যরা আদৌ অবহিত নন। দ্বিতীয়ত: উষামং মারমারা বৃদ্ধকে হুমকি দিয়ে থাকলে তা থানায় জানানোর কথা। কিন্তু মানিকছড়ি থানার ওসি নিজেই বলছেন পুলিশ সে ধরনের কোন অভিযোগ পায়নি। যেখানে পাহাড়িদের উপর হয়রানি অত্যাচার চালাতে পান থেকে চূন খসতে হয় না, সেখানে এ ধরনের হুমকি তো সেটলারদের জন্য মেঘ না চাইতেই বৃষ্টির মতো। আর আর্মিরা সেটাকে (হুমকিকে) অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে গ্রামে হানা দিয়ে কয়েক ডজন নিরীহ পাহাড়িকে ধরে নিয়ে এসে নির্যাতন করে জেল-হাজতে পাঠাতে না পারলে শান্তি পেতো না। তৃতীয়ত: সাধারণত বাঙালিরাই পাহাড়িদের কাছ থেকে জমি কিনে থাকে অথবা জোর পূর্বক দখল করে নেয়। পাহাড়িরা, বিশেষত মারমারা, বাঙালিদের কাছ থেকে জমি কিনেছে বা কিনতে চেয়েছে এমন ঘটনা মানিকছড়িতে এ যাবত শোনা যায়নি। চতুর্থত: বর্তমানে সেনাবাহিনীর অব্যাহত নির্যাতন হয়রানি ও ভয়ভীতি প্রদর্শনের কারণে পাহাড়িরা এমনিতেই ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে আছে। সেনাদের উস্কানিতে সেটলাররাও যে কোন সময় দাঙ্গা বাঁধিয়ে হামলা চালাতে পারে বলে পাহাড়িদের মধ্যে আশঙ্কা বিরাজ করছে। এই অবস্থায় কোন বাঙালিকে খুন করে সেটলারদের হামলাকে কোন পাহাড়ি স্বেচ্ছায় আমন্ত্রণ জানাবে তা একেবারেই অবিশ্বাস্য। পঞ্চমত: জানা যায় বৃদ্ধ আবদুল মতিন বাঙালির লোকালয় থেকে এক কিলোমিটার মতো দূরে ওই জমিতে ৩০ – ৩৫ বছর ধরে বসবাস করে আসছিলেন। তার বাড়ি থেকে কিছু দূরে একটি বৌদ্ধ বিহার ও ৩ পরিবার পাহাড়ির (মারমা) বাসাবাড়ি রয়েছে। অর্থাৎ পাহাড়িরাই তার প্রতিবেশী। এত বছর ধরে তিনি পাহাড়িদের সাথে বসবাস করে আসছিলেন, অথচ পাহাড়িদের বিরুদ্ধে এই দীর্ঘ সময়ে তার কিংবা তার পরিবারের অন্য সদস্যদের কোন ধরনের অভিযোগ ছিল বলে জানা যায়নি। বৃদ্ধ আবদুল মতিনের খুনের ঘটনা তদন্তে বা পর্যালোচনায় এই দিকটিও যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় নেয়ার প্রয়োজন রয়েছে। ষষ্টত: ঘটনার রাতে বৃদ্ধের স্ত্রী কেন বাড়িতে ছিলেন না, তা এক বিরাট রহস্য, এবং এক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। দেশের পত্র পত্রিকায় অনেক সময় দেখা যায় পুত্রের হাতে পিতা খুন, স্ত্রীর হাতে স্বামী খুন, স্বামীর হাতে স্ত্রী-পুত্র খুন। অন্যকে ফাঁসাতে গিয়ে নিজের নিকট আত্মীয় বা আপনজনকে খুনের ঘটনা এদেশে বিরল নয়। পার্বত্য চট্টগ্রামেও এ ধরনের ঘটনা অতীতে অনেক ঘটেছে। সে সম্পর্কে এখানে বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন নেই। কারণ সে সব ঘটনা কমবেশী সবার জানা। মোট কথা, এই উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে কেউ ব্যক্তিগত কিংবা পারিবারিক শত্রুতাবশতঃ তাকে খুন করে দৃষ্টি ভিন্ন খাতে বা সাম্প্রদায়িক খাতে প্রবাহিত করে নিজেদের আড়াল করতে চাইছে কী না সেটা দেখা দরকার। সপ্তমত: সিএইচটি নিউজ ডটকম -এর রিপোর্ট থেকে জানা যায়, সিন্দুকছড়ি জোন কমান্ডার লে. ক. রাব্বী আহসান বেশ কয়েক বার লাশ ফেলে হলেও পাহাড়িদের জমি বেদখলের হুমকি দিয়েছিলেন। তার বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টির চেষ্টারও অভিযোগ আনা হয়েছে। বৃদ্ধ আবদুল মতিনের খুনের সাথে তার উক্ত হুমকির কোন যোগসূত্র আছে কী না সেটাও পরিস্কার হওয়া উচিত।

আবদুল মতিনের কথিত খুনের ঘটনা তদন্তে সম্ভাব্য সকল ধরনের প্রেক্ষিত থেকে বিচার করে অগ্রসর হওয়ার দরকার আছে। যেহেতু ঘটনার কোন প্রত্যক্ষদর্শী নেই, তাই সাসপেক্ট বা সন্দেহভাজনের তালিকায় তার পরিবারের সদস্যদেরও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। আমরা চাই ঘটনার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের জন্য একটি শক্তিশালী কমিটি গঠন করা হোক, প্রকৃত খুনীরা চিন্নিত হোক। মনগড়া অভিযোগে ও সন্দেহ বশত: কোন নিরীহ ব্যক্তি যাতে হয়রানির শিকার না হয় সেটা দেখা অত্যন্ত জরুরী। উষামং ও রিপ্রুচাই মারমাকে যেভাবে গ্রেফতার করে বৃদ্ধের খুনের সাথে জড়ানো হয়েছে তা কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না। ঘটনার পর গতকাল (বৃহস্পতিবার) সকালে তারা আবদুল মতিনের লাশ দেখতে যান। কিন্তু তারা তার বাড়িতে পৌঁছা মাত্রই বাঙালিরা তাদের উপর চড়াও হয়। সেটলাররা প্রথমে রিপ্রুচাই মারমাকে ধরে পেটাতে থাকে। এটা দেখে উষামং পালানোর চেষ্টা করলে তাকেও তারা ধরে ফেলে এবং পরে মারধরের পর তাদের দু’জনকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। অথচ এটা সহজেই বোধগম্য যে, উষামং ও রিপ্রুচাই খুনের সাথে জড়িত থাকলে কখনোই সেখানে যেতেন না।

খুনের ঘটনা মাত্রেই নিন্দনীয়, অগ্রহণযোগ্য। কিন্তু যেভাবে বৃদ্ধ আবদুল মতিনের খুনের ঘটনাকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে খুনের জন্য পাহাড়িদের দায়ি করে সেটলাররা উত্তেজিত হয়ে তাদের উপর হামলা চালায় ও তাদের দোকানপাট ভাঙচুর করে তাও সভ্য মানুষ মেনে নিতে পারে না। যুক্তির খাতিরে যদি ধরেও নেয়া হয় যে, পাহাড়িদের মধ্যে কেউ উক্ত খুনের সাথে জড়িত; কিন্তু তাই বলে কি পাহাড়ি পেলেই নির্বিচারে তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রতিশোধ নিতে হবে? কোন বাঙালি অপরাধ করলে কী সব বাঙালি দোষী হয়ে গেল? কোন বৃটিশ, বা আমেরিকান বা চীনা নাগরিক খুন করলে কী সব বৃটিশ বা আমেরিকান বা চীনা দোষী হবে? বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, অথচ কিছু লোক অসভ্যের মতো আচরণ করবে বা তাদেরকে অসভ্যের মতো আচরণ করতে দেয়া হবে তা হতে পারে না। সভ্য দুনিয়ার দিকে আমাদের তাকাতে হবে।

দ্বিতীয়ত: সেনাবাহিনী খুনের ঘটনার সাথে জড়িত থাক বা না থাক, দৃশ্যত তারাও কথিত খুনের ঘটনাকে পুঁজি করে ফায়দা লটতে চাইছে। তারা ঘটনার পর পরই বক্রি পাড়ায় কমলাপতি চাকমার (৬০) শিমূল আলুর (ক্যাসাভা) ক্ষেত নষ্ট করে সেখানে তাঁবু খাটিয়ে অবস্থান করছে। খুনের পর পরই তাদের তৎপর হওয়ার মানে ও উদ্দেশ্য কী? খুনের ঘটনা ঘটেছে লাফাইদং পাড়ায় অথচ তারা সে ঘটনাকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে অস্থায়ী ক্যাম্প বসিয়েছে অন্য এক গ্রামে। খুন হলে হয়েছে, কিন্তু সেনা সদস্যদেরকে নিরীহ পাহাড়ির বাগান ধ্বংস করার ও তার জমির উপর জোর করে অস্থায়ী ছাউনি নির্মাণের অধিকার কে দিয়েছে? সহজ সরল নিরীহ অশিক্ষিত পাহাড়িরা এতদিন এ ধরনের অন্যায় অত্যাচার নিরবে অনেক সহ্য করে এসেছে। বহু আগেই তাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকেছে। কিন্তু আর নয়। প্রতিবাদ প্রতিরোধের সময় এসেছে। কোন অন্যায় আর বিনা প্রতিবাদে যেতে দেয়া হবে না — সবাইকে এই প্রতিজ্ঞা করতে হবে।

শেষে আমরা চাই সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে আবদুল মতিনের খুনীদের বের করা হোক, অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হোক। আর নিরীহ উষামং মারমা ও রিপ্রুচাই মারমাকে অবিলম্বে নিঃশর্ত মুক্তি দেয়া হোক। #
——————–

সিএইচটিনিউজ.কম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More