রমেল চাকমা হত্যার প্রতিবাদে রাঙামাটিতে অবস্থান ধর্মঘট ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে স্মারকলিপি

0

obostan

রাঙামাটি : সেনাবাহিনীর ব্যাপক বাধার মধ্যে ছাত্রনেতা ও এইচএসসি পরীক্ষার্থী রমেল চাকমা হত্যার প্রতিবাদে ও হত্যাকারী নান্যাচর জোন কমাণ্ডার মোঃ বাহালুল আলম ও মেজর তানভীরসহ জড়িত সেনা সদস্যদের শাস্তি ও বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠনের দাবিতে রাঙামাটিতে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান ধর্মঘট ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বরাবরে স্মারকলিপি প্রদান করেছে বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি) ও রমেল চাকমা হত্যা প্রতিবাদ কমিটি। কর্মসূচিকে ঘিরে ছিল ব্যাপক পুলিশের উপিস্থিতি।

এদিকে কর্মসূচি বানচাল করে দেয়ার লক্ষ্যে সকাল থেকে সেনাবাহিনীর সদস্যরা রাঙামাটি – খাগড়াছড়ি সড়কের বেতছড়ি, ঘিলাছড়ি, কুদুকছড়িসহ বিভিন্ন জায়গায় এবং নান্যাচর উপজেলাসহ বিভিন্ন নৌপথে অবস্থা নিয়ে গাড়ি আটকিয়ে দেয় এবং তল্লাশির নামে হয়রানি করে। এছাড়া সেনারা বেতছড়ি এলাকার দাজ্যা পাড়া নামক স্থানে ফাঁকা গুলিবর্ষণ করে আতঙ্কজনক পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা চালায়। কিন্তু সেনাবাহিনীর ব্যাপক বাধা সত্ত্বেও প্রায় ৫ শতাধিক ছাত্র-জনতা, জনপ্রতিনিধি, মুরুব্বী ও বিভিন্ন সংগঠনের নেতা-কর্মী কর্মসূচিতে যোগ দিয়ে রমেল চাকমাকে হত্যার প্রতিবাদে সামিল হন।

obostan2

‘অবিলম্বে অন্যায় ধরপাকড়, নির্যাতন ও রাজনৈতিক দমন-পীড়ন বন্ধ কর’ এই শ্লোগানে সেনা হেফাজতে ছাত্রনেতা রমেল চাকমার মৃত্যুরজন্য দায়ী নান্যাচর জোন কমা-ার বাহালুল আলম ও মেজর তানভীরের শাস্তি ও বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠনের দাবিতে আজ মঙ্গলবার (২৫ এপ্রিল ২০১৭) দুপুরে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে ঘন্টাব্যপী অনুষ্ঠিত অবস্থান ধর্মঘট কর্মসূচিতে বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ(পিসিপি) রাঙামাটি কৃষি ইনস্টিটিউট শাখার সাধারণ সম্পাদক জিকু চাকমার সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন, পিসিপি রাঙামাটি জেলা শাখার সভাপতি কুনেন্টু চাকমা ও রমেল চাকমা হত্যা প্রতিবাদ কমিটির আহব্বায়ক সুনন্দা তালুকদার। এতে সংহতি জানিয়ে আরো বক্তব্য রাখেন, হিল উইমেন্স ফেডারেশন কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক মন্টি চাকমা ও পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক কাজলী ত্রিপুরা প্রমুখ।।

বক্তারা রমেল চাকমাকে আটকের পর নির্যাতন চালিয়ে হত্যা ও তার মরদেহ পেট্রোল ঢেলে পুড়িয়ে ফেলার ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন, ছাত্র নেতা রমেল চাকমাকে গত ৫ এপ্রিল অন্যায়ভাবে আটক করে ট্রাক পোড়ানো ও বাসের মালামাল লুটের মামলার আসামি হিসেবে দাবি করাটা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। যা নান্যাচর থানার ওসি আব্দুল লতিফের বক্তব্যের মাধ্যমে প্রমানিত হয়েছে। তিনি স্পষ্টভাবে বলেছেন ‘রমেলের নামে থানায় কোন মামলা বা অভিযোগ নেই’।তারা বলেন, রমেলের নামে যদি কোন অভিযোগ বা মামলা থেকেও থাকে, তারপরও দেশের নাগরিক হিসেবে তার সুবিচার পাওয়ার অধিকার ছিল। কাউকে বিনা অপরাধে গ্রেফতার করে জোনে নিয়ে শারীরিক নির্যাতন করে হত্যা করার এক্তিয়ার সেনাবাহিনীর নেই। কিন্তু নান্যাচর জোন কমান্ডার বাহলুল আলম ও মেজর তানভীরসহ অন্য সেনা সদস্যরা রমেল চাকমাকে জোনে নিয়ে গিয়ে অমানুষিক শারীরিক নির্যাতন চালিয়েছে। যার ফলে রমেল চাকমার মৃত্যু হয়েছে। এ দায় থেকে তারা কোনভাবেই মুক্তি পেতে পারে না।

obostan kormosusi1

বক্তারা আরো বলেন, রমেল চাকমার মৃত্যুর পরও সেনারা ক্ষান্ত হয়নি। তারা রমেলের মৃতদেহটিও ছিনিয়ে নিয়ে পরিবারের কাছে হস্তান্তর না করে সামাজিক-ধর্মীয় রীতি-নীতি ছাড়াই পরিবার ও জ্ঞাতিগণের অনুপস্থিতিতে পেট্রোল ঢেলে পুড়িয়ে ফেলেছে। এর চেয়ে জঘন্যতম নিষ্ঠুরতা আর কিছুই হতে পারে না।

বক্তারা পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনা সন্ত্রাস চলছে উল্লেখ করে বলেন, সেনাবাহিনী এখন পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর ন্যায় পাহাড়ি জনগণের উপর নিপীড়ন-নির্যাতন চালাচ্ছে। সেনাবাহিনীর নির্যাতন থেকে সাধারণ গ্রামবাসী থেকে শুরু করে রাজনৈতিক কর্মী, ব্যবসায়ী, জনপ্রতিনিধি কেউই আর নিরাপদ নয়। প্রতিনিয়ত কোথাও না কোথাও অন্যায় ধরপাকড়-নির্যাতনের শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ।

বক্তারা অবিলম্বে রমেল চাকমাকে নির্যাতন চালিয়ে হত্যার সাথে জড়িত নান্যাচর জোন কমাণ্ডার  মোঃ বাহালুল আলম, মেজর তানভীরসহ জড়িত সেনা সদস্যদের গ্রেফতারপূর্বক দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান।

17992229_1490708114313666_1253701419789680702_n

অবস্থান ধর্মঘট কর্মসূচি শুরুর পূর্বে পিসিপি ও রমেল চাকমা হত্যা প্রতিবাদ কমিটির পক্ষ থেকে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে গিয়ে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বরাবরে স্মারকলিপি দেওয়া হয়। এ সময় পিসিপি রাঙামাটি জেলা শাখার সভাপতি কুনেন্টু চাকমা, রমেল চাকমা হত্যা প্রতিবাদ কমিটির আহ্বায়ক সুনন্দা তালুকদার, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক মন্টি চাকমা ও পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক মন্টি চাকমা উপস্থিত ছিলেন।

স্মারকলিপিতে ছাত্র নেতা রমেল চাকমার মৃত্যুর জন্য দায়ি নান্যাচর জোন কমান্ডার বাহলুল আলম ও মেজর তানভীরসহ জড়িত সেনাসদস্যদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান; পুরো ঘটনা তদন্তের জন্য একটি নিরপেক্ষ, স্বাধীন বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন; রমেল চাকমার পরিবারকে যথোপযুক্ত আর্থিক ক্ষতিপূরণ প্রদান এবং ইউপিডিএফ ও তার সহযোগী সংগঠনের উপর চলমান সেনা দমনপীড়ন, তথা অন্যায়ভাবে গ্রেফতার, নির্যাতন, মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি বন্ধের দাবি জানানো হয়।

এদিকে আগামী ২৮ এপ্রিল ২০১৭, শুক্রবার রমেল চাকমার নিজ বাড়ি হ্ডেমরা(হাতিমারা) গ্রামে সামাজিক রীতি ও প্রথা অনুসারে পারিবারিকভাবে তার(রমেল’র) ধর্মীয় ও সাপ্তাহিক ক্রিয়া অনুষ্ঠান ও  ২ মে ২০১৭ মঙ্গলবার নান্যাচর কলেজ মাঠে রমেল চাকমার স্মরণে শোকসভা আয়োজন করা হবে বলে জানিয়েছেন পিসিপি’র কেন্দ্রীয় সভাপতি বিনয়ন চাকমা ও রমেল চাকমা হত্যা প্রতিবাদ কমিটির আহ্বায়ক সুনন্দা তালুকদার।

উল্লেখ্য, গত ৫ এপ্রিল নান্যাচর উপজেলা পরিষদ এলাকা থেকে এইচএসসি পরীক্ষার্থ ও পিসিপি নান্যাচর থানা শাখার সাধারণ সম্পাদক রমেল চাকমাকে আটক করে নান্যাচর জোনের সেনা সদস্যরা। আটকের পর তাকে জোনে নিয়ে গিয়ে মধ্যযুগীয় কায়দায় অমানুষিক নির্যাতন করা হলে রমেল গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে। এরপর সেনারা তাকে থানায় হস্তান্তরে ব্যর্থ হয়ে রাতেই চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করায়। সেখানে সেনা নজরদারিতে দুই সপ্তাহ ধরে চিকিৎসাধীন থাকার পর গত ১৯ এপ্রিল তিনি মারা যান।

পরদিন ২০ এপ্রিল রমেল চাকমার মরদেহ চট্টগ্রাম থেকে বাড়ির উদ্দেশ্যে আনা হলে বুড়িঘাট বাজারে পৌঁছানোর পর পরিবারের লোকজনের কাছ থেকে মরদেহটি ছিনিয়ে নেয় সেনা সদস্যরা। এরপর পরিবারের কাছে মরদেহটি হস্তান্তর না করে ২১ এপ্রিল দুপুরে সেনা সদস্যরা নিজেরাই মরদেহটি পূর্বহাতিমারায় নিয়ে গিয়ে পেট্রোল ঢেলে পুড়িয়ে ফেলে।

এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশব্যাপী ব্যাপক বিক্ষোভ দেখা দিয়েছে। দেশের বিভিন্ন প্রগতিশীল সংগঠন-ব্যক্তি বিক্ষোভে সামিল হচ্ছেন। ব্লগসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলছে নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড়।
———————-
সিএইচটি নিউজ ডটকম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More