রাঙামাটিতে সাম্প্রদায়িক হামলা ও অনিক চাকমাকে হত্যার এক বছর : বিচারের উদ্যোগ নেই সরকারের

0
গত বছর ২০ সেপ্টেম্বর রাঙামাটি শহরে সেটলারদের তান্ডবলীলা ও অনিক চাকমাকে হত্যার চিত্র। ফাইল ছবি 

রাঙামাটি প্রতিনিধি, সিএইচটি নিউজ
শনিবার, ২০ সে সেপ্টেম্বর ২০২৫

গত বছর ১৯ সেপ্টেম্বর দীঘিনালায় পাহাড়িদের ওপর সেটলারদের হামলা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ, হত্যা এবং খাগড়াছড়ি সদরে সেনাবাহিনী কর্তৃক ছাত্র-জনতার ওপর হামলা ও গুলি করে জুনান চাকমা ও রুবেল ত্রিপুরাকে হত্যার প্রতিবাদে পরদিন (২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪) “সংঘাত ও বৈষম্য বিরোধী পাহাড়ি ছাত্র আন্দোলন” নামে শিক্ষার্থীদের একটি প্লাটফর্মের উদ্যোগে রাঙামাটি শহরে বিক্ষোভ মিছিলের আয়োজন করা হয়। ১,৫০০-২,০০০ জনের অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের মিছিলটি সকাল পৌনে দশটার দিকে জিমনেসিয়াম থেকে শুরু হয়ে বনরূপা পেট্রোল পাম্প পর্যন্ত যায়। সেখান থেকে ফিরে আসার সময় সেটলার বাঙালিরা মিছিলের পেছন দিকে হামলা চালায়।

প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা মতে, প্রথমে একজন বাঙালি ছেলে মসজিদে ঢিল ছোঁড়ে। তারপর মসজিদ থেকে মাইকে ঘোষণা দেয়া হয় চাকমারা মসজিদ আক্রমণ করছে। এরপর বাঙালিরা সংঘবদ্ধভাবে পাহাড়িদের মিছিলের ওপর হামলা চালালে তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। পাহাড়িরা বিজন সরণী ও কালিন্দীপুরসহ যে যেদিকে পারে পালিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা চালায়। পরে সেটলাররা পুরো শহরে তান্ডবলীলা চালায়।

হামলাকারীরা কালিন্দীপুরে কাপ্তাই কর্ণফুলি কলেজের ছাত্র অনিক কুমার চাকমাকে লাঠিসোটা ও ইট দিয়ে আঘাত করে নৃশংসভাবে হত্যা করে। এ হত্যার ঘটনায় ফিশারির বাসিন্দা সিএনজি চালক জাহাঙ্গীর ও এসএ পরিবহনের কর্মচারী (পার্সেল বিলিকারী) ইসমাইল, ইসরাত হোসেনসহ আরো বেশ কয়েকজন সেটলার বাঙালি জড়িত ছিল বলে জানা যায়।

সেটলারদের এ হামলায় অন্তত ৬৯ জন পাহাড়ি আহত হন। এছাড়া সংঘর্ষ চলাকালে বাঙালিদের মধ্য থেকেও কয়েকজন আহত হয়েছিলেন।

ঘটনার পরবর্তী ২৭ সেপ্টেম্বর অনিকের মা তারা সুন্দরী চাকমা রাঙামাটি চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ৯ জনের নাম উল্লেখ করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।

মামলায় আসামী করা হয় রাঙামাটি শহরের বাস টার্মনিাল সংলগ্ন শান্তি নগর এলাকার মো জাহাঙ্গীর (২৮), চম্পক নগর এলাকার মো সাইফুল(৩০), এ জে আর কুরিয়ার সার্ভিসের কর্মী ইসরাত হাসান শুভ (২৬) চম্পক নগর এলাকার মো ইসমাইল (৩০), চম্পক নগরের বাসিন্দা সিএনজি চালক মো. কামাল (৩০), একই এলাকার সিএনজি চালক মো ইয়াসিন (৩০), চম্পক নগর গাত্তো পাড়ার মো মান্নান মিস্ট্রি (২৮), দক্ষিণ কালিন্দীপুরের পান দোকানদার মো. রাকিব (২৮), রাঙামাটি হাসপাতাল এলাকার মো বুজ্যা (২৬)।

অনিক চাকমা হত্যার ঘটনায় এ পর্যন্ত পুলিশ মো মামুন, মো আবরার. মো ফিরোজ হোসাইন, মো জালাল হোসেন এবং মো জাহাঙ্গীর আলম নামে ৫ জনকে গ্রেফতার করে। তবে এদের মধ্যে মো মামুন ছাড়া বাকী আসামীরা জামিনে রয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে।

এছাড়া এক বছরেও মামলায় অভিযুক্ত আরো বাকী আসামিদের গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। 

সেদিন হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় রিগ্যাল ফার্নিচার শো রুম, রাঙামাটি পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টার, শেভরন ডায়াগনস্টিক সেন্টার, হোটেল গ্রান্ড মাস্টার, পেট্রোল পাম্প, রূপালী ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক ও সীমান্ত ব্যাংক, রাসেল স্টোর, ডিডিএন নেটওয়ার্ক-এর ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ। এছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বনরূপা, দক্ষিণ কালিন্দীপুর, বিজন সরণি, উত্তর কালিন্দীপুর ও হাসপাতাল এলাকার ছোটবড় অন্তত ১০০টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।

হামলাকারী সেটলাররা আঞ্চলিক পরিষদের গ্যারেজে রাখা গাড়িগুলো পুড়িয়ে দেয়। সংগৃহিত ছবি

বাঙালি সেটলাররা পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের অফিসেও হামলা করে এবং গ্যারেজে রাখা ৯টি গাড়ি ও একটি মোটর সাইকেল পুড়িয়ে দেয়। এছাড়া ছয়টি সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ছয়টি ট্রাক ও তিনটি বাসে ভাংচুর এবং দুটি বেবিট্যাক্সি ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। ১৮টি বসতবাড়ি, ৮৯টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, ৮৫টি ভাসমান দোকানে ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ, দুটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ভাংচুর করা হয় বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়।

হামলাকারীরা সেটলাররা কাঁঠালতলিতে মৈত্রী বিহার ও তবলছড়িতে আনন্দ বিহারেও হামলা-ভাঙচুর ও লুটপাট চালায়। তারা মৈত্রী বিহার থেকে দুটি দান বাক্সসহ অন্য তিনটি দান বাক্সের টাকা লুট করে নিয়ে যায়।

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নোবেলজয়ী ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্বগ্রহণের দেড় মাস না পোরেতেই এ বর্বরোচিত হামলার ঘটনাটি সংঘটিত হয়।

ঘটনার পর ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তিন উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ (স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়), লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী (স্বরাষ্ট্র) ও সুপ্রদীপ চাকমা (পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক) রাঙামাটি সফর করেন। তারা একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিটি গঠনের ঘোষণা দেন। 

এরপর ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ সরকার হামলার ঘটনা তদন্তের জন্য চট্টগ্রাম ডিভিশনের অতিরিক্ত কমিশনার (উন্নয়ন) মোহম্মাদ নুরুল্লা নুরীকে প্রধান করে ৭ সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে।

কিন্তু রহস্যজনক কারণে সরকার এক বছরেও এ ঘটনার তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করেনি এবং ঘটনার বিচারে কোন উদ্যোগ নেয়নি। এই বিচারহীনতার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িদের ওপর বার বার এ ধরনের হামলার ঘটনা সংঘটিত হচ্ছে।



This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More