রাঙামাটি শহরে প্রান্তর চাকমা’র ওপর হামলাকারীদের গ্রেফতারের দাবিতে কুদুকছড়িতে বিক্ষোভ

রাঙামাটি প্রতিনিধি, সিএইচটি নিউজ
বুধবার, ১৪ মে ২০২৫
“উগ্র সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিস্ট অপশক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান” শ্লোগানে রাঙামাটি শহরের বনরূপা বাজার এলাকায় গত ১২ মে সমাবেশের নামে উগ্র সেটলার বাঙালি কর্তৃক একটি ঔষধ কোম্পানির এরিয়া বিক্রয় প্রতিনিধি প্রান্তর চাকমার উপর হামলার প্রতিবাদে এবং হামলাকারীদের গ্রেফতার ও শাস্তির দাবিতে কুদুকছড়িতে এক বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে ছাত্র-জনতার সংগ্রাম পরিষদ।
আজ বুধবার (১৪ মে ২০২৫) বিকাল ৩ টার সময় রাঙামাটি সদর উপজেলার কুদুকছড়ি নির্বাণপুর বন ভাবনা কেন্দ্রের মুল ফটক থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়। মিছিলটি সেখান থেকে রাঙামাটি-খাগড়াছড়ি সড়ক হয়ে কুদুকছড়ি বাজার প্রদক্ষিণ করে বড় মহাপূরম উচ্চ বিদ্যালয়ের মুল ফটকে সমাবেশে মিলিত হয়।

বিক্ষোভ মিছিল পরবর্তী সমাবেশে ছাত্র-জনতার সংগ্রাম পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি উষাতন চাকমার সভাপতিত্বে ও সহ-সাধারণ সম্পাদক শ্যামল কার্বারীর সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন, ছাত্র-জনতার সংগ্রাম পরিষদের সহ-অর্থ সম্পাদক ক্যাচিঅং মারমা ও সহ- সভাপতি তেরেসা চাকমা। এছাড়া সংগঠনটির অর্থ সম্পাদক হরিকুমার কার্বারীও এতে উপস্থিত ছিলেন।
ক্যাচিঅং মারমা কাজী মুজিবুর রহমানের পাহাড়ি বিদ্বেষী বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন, তিনি পাহাড় নিয়ে কি শুরু করেছেন জানি না। মনে হয় তারা পাহাড়কে দখল করতে চায়। কাজেই, আমাদের বেঁচে থাকার একমাত্র পথ হচ্ছে লড়াই সংগ্রাম করা।
তিনি কাজী মুজিবুরকে একজন সুবিধাবাদী, আদর্শহীন ব্যক্তি উল্লেখ করে বলেন, এই ব্যক্তি কয়েকদিন আগে আওয়ামী লীগে ছিলেন, এখন ভোল পাল্টিয়ে পাহাড়িদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক বক্তব্য দিচ্ছেন, যুদ্ধ ঘোষণা করছেন। এটা তার কীসের মতলব?
ক্যচিঅং মারমা বলেন, আমরা পাহাড়িরা সহজ সরল। আমরা সবসময় নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকার হচ্ছি। কিন্তু কাজী মুজিবের সাথে রয়েছে প্রশাসন-সেনাবাহিনী। লড়াই- সংগ্রামই হচ্ছে আমাদের একমাত্র পথ।
তিনি আরো বলেন, গত কয়েকদিন আগে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে মাইকেল চাকমার স্বায়ত্তশাসনের প্রস্তাবকে নিয়ে তারা (মুজিবুররা) প্রতিবাদ করছেন। কিন্তু এই স্বায়ত্তশাসনের দাবিতো আজকের নয়। এই দাবিটাই হচ্ছে পাহাড়িদের বহু পুরনো দাবি। তারা কি এতদিন শুনেন নাই?
তিনি বলেন, পাহাড়িরা মনে করে স্বায়ত্তশাসন দেয়া হলে তারা নিপীড়ন-নির্যাতন থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি পাবে। কিন্তু সেটলাররা চাচ্ছে তারা পাহাড়কে দখল করে পাহাড়িদেরকে ভূমি থেকে উচ্ছেদ করবে, পাহাড়িদের নির্যাতন করবে, পাহাড়ি নারীদের ওপর নিপীড়ন চালাবে। তাই সকল অন্যায়-অবিচার, নিপীড়ন, ভূমি বেদখল ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে আমাদের সবাইকে সোচ্চার হয়ে প্রতিবাদ করতে হবে।

তেরেসা চাকমা বলেন, কাজী মুজিবুর রহমান বলেছেন আমরা পাহাড়িরা নাকি চীন, মায়ানমারসহ বিভিন্ন দেশ থেকে এসেছি। আমি তাকে বলতে চাই, আগে আপনার পরিচয় বের করুন। তারপর আমাদের পরিচয় নিয়ে কথা বলুন। আপনি সমতল থেকে সেটলার হিসেবে এখানে এসেছেন। কেন আপনাদের সেটলার বলা হয় সে বিষয়ে জানুন।
তিনি রাঙামাটিতে প্রান্তর চাকমার ওপর হামলার বিষয়ে বলেন, তিনি তো কোন অপরাধ করেননি। কেন আপনারা তার ওপর হামলা করেছেন?
তিনি বান্দরবানে খেয়াং নারী ধর্ষণকারীদের এখনো চিহ্নিত ও গ্রেফতারে প্রশাসন আইনগত কোন পদক্ষেপ না নেয়ায় ক্ষোভ প্রকশ করেন এবং বলেন, দিন দিন এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে, যার ফলে এখন আমাদের কোথাও কোন নিরাপত্তা নেই। গত ১২ মে রাঙামাটি শহরে সেনাবাহিনী ও প্রশাসনের সামনে প্রান্তর চাকমার ওপর হামলা করা হলেও প্রশাসন নিরব ভূমিকা পালন করেছে। অথচ সেদিন রাঙামাটিতে আরেক ঘটনায় এক পাহাড়ি নারীর যৌন হয়রানি করা ব্যক্তিকে জনতা ধোলাই দিলে সেখানে সেনাবাহিনী ও পুলিশ গিয়ে জনগণকে জবাবদিহি করতে বাধ্য করেছে।
তিনি বলেন, আমরা বরাবরই শোষিত ও নিপীড়িত জাতিগোষ্ঠি। আমাদেরকে কোন অধিকার দেওয়া হচ্ছে না। ইউপিডিএফের ‘পূর্ণস্বায়ত্তশাসন’ প্রস্তাবের বিরুদ্ধে কিছু উগ্র সংগঠন রাস্তায় নেমে আমাদের ওপর হামলা করা হচ্ছে। তারা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি করতে চায়। কিন্তু আমরা কোন দাঙ্গা-হাঙ্গামা চাই না। আমরা শান্তিপূর্ণভাবে থাকতে চাই।
তিনি উগ্র সেটলারদের সতর্ক করে দিয়ে বলেন, আপনারাও সাবধান হয়ে যান। কোন প্রকার দাঙ্গা সৃষ্টি করবেন না। তাহলে আমরাও প্রতিরোধ গড়ে তুলবো। আমরা এখনো শান্তিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছি। কাজেই, আমাদের মনে আগুন জ্বালাবেন না।

তিনি প্রশ্ন করে বলেন, আমাদেরকে অধিকার দিতে আপনাদের এত গা জ্বলে কেন? দেশে আপনারা যে অধিকার ভোগ করছেন আমরাও সে অধিকার চাই। এক দেশে দুই নীতি মানি না, মানবো না।
সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আপনারা পাহাড়ে আমাদের ওপর যে নিপীড়ন-নির্যাতন হয়, ধর্ষণ হয় সেগুলো সঠিকভাবে প্রচার করবেন। শুধু সমতলের খবরগুলো নয়, পাহাড়িদের সুখ-দুঃখের কথাও তুলে ধরবেন।
তিনি পাহাড়ে ধর্ষণ, খুন, গুম, নিপীড়ন-নির্যাতনের সঠিক বিচার করার জন্য ইউনুস সরকারের প্রতি আহ্বান জানান এবং বলেন, পাহাড়ে যে সেটলার সমস্যা তা নিয়ে আপনার সরকার নিরব থাকলে সমাধান হবে না। আপনাকে রাজনৈতিকভাবে এর সমাধান করতে হবে।
তিনি সবাইকে আন্দোলনে এগিয়ে আহ্বান জানিয়ে বলেন, দেশ, জাতি বাঁচলে আমরা বাঁচবো। আমরা বাঁচলে আমাদের মাটি বাঁচবে। আর মাটি বাঁচলে আমরা স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারবো।
সভাপতি উষাতন চাকমা বলেন, গত ১২ মে রাঙামাটিতে প্রান্তর চাকমার ওপর যারা হামলা করেছে তাদেরকে দ্রুত আইনের আওতায় আনতে হবে।
তিনি বলেন, কাজী মুজিবুর রহমান গিরগিটির মত রূপ বদলান। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে তিনি সে দলের লেজুড়বৃত্তি করেন। আমরা পাহাড়ে শান্তিতে বসবাস করতে চাই। আমরা এই সমাবেশ থেকে দাবি জানাই, সেটলারদের সম্মানজনকভাবে সমতলে পুনর্বাসন করুন।
তিনি আরো বলেন, কিছুদিন আগে থানচিতে ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়েছে চিংমা খিয়াং নামে এক নারীকে। সে ঘটনার ন্যায় বিচারের দৃশ্যমান কোন তৎপরতা আমরা এখনো দেখতে পাচ্ছি না।
প্রশাসনকে উদ্দেশ্য করে উষাতন চাকমা বলেন, বিভক্ত আছি বলে আমাদেরকে দুর্বল ভাববেন না। আমরা যখন মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াবো, আমরা যখন জ্বলে উঠবো, তখন পালানোর রাস্তা পাবেন না।
তিনি হুঁশিয়ারি দিয়ে প্রশাসনের উদ্দেশ্যে আরো বলেন, সময় থাকতে কাজী মুজিবুরের মত গিরগিটিদের সামলান। না হলে পাহাড়ে যেকোন পরিস্থিতির জন্য প্রশাসনকে দায়ী থাকতে হবে।
তিনি আরও বলেন, আমরা বাঙালিদের বিরুদ্ধে নয়, অবৈধ সেটলারদের বিরুদ্ধে। আমরা সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে নয়, সেনাশাসনের বিরুদ্ধে।
তিনি সমাবেশে অংশগ্রহণকারীদের ধন্যবাদ জানিয়ে আগামীতে যে কোন আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার জন্য আহ্বান জানান।
সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।