অন্য মিডিয়া
রাজশাহীতে ৫৩ বছরের বসতভিটা থেকে পাহাড়িয়া পরিবারগুলোকে ‘উচ্ছেদ করতে’ ভোজের আয়োজন

রাজশাহী নগরের হড়গ্রাম মহল্লার এই আদিবাসাী পাড়ায় ৫৩ বছর ধরে বসবাস করে পাহাড়িয়া সম্প্রদায়ের কয়েকটি পরিবার।ছবি: প্রথম আলো
অন্য মিডিয়া ডেস্ক, সিএইচটি নিউজ
বৃহস্পতিবার, ৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫
রাজশাহী সিটি করপোরেশনের ২ নম্বর ওয়ার্ডের মোল্লাপাড়া। ৫৩ বছর আগে এখানে ১৬ কাঠা জমিতে বাড়ি করে বসবাস শুরু করে পাহাড়িয়া সম্প্রদায়ের ছয়টি পরিবার। তিন প্রজন্মে ৬টি বাড়ি এখন ১৬টি হয়েছিল। এই অবস্থায় তাদের ভিটে থেকে ‘উচ্ছেদের আয়োজন’ করছেন সাজ্জাদ আলী নামের এক ব্যক্তি। নগরের হড়গ্রাম এলাকার বাসিন্দা সাজ্জাদ আলীর দাবি, তিনি ১৯৯৪ সালে এই জমি কিনেছেন।
ঘরভিটে ছেড়ে যাওয়ার আগে এই পরিবারগুলোকে ‘খাসি খাওয়ানোর’ কথা ছিল আগামীকাল শুক্রবার (৫ সেপ্টেম্বর)। শুধু তা–ই নয়, উচ্ছেদের শিকার পরিবারগুলোকে তিনি পুনর্বাসনের জন্য মোট ৩০ লাখ টাকা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। বিষয়টি জানাজানি হলে আদিবাসীপাড়া হিসেবে পরিচিত ওই এলাকায় আজ বৃহস্পতিবার হাজির হন পুলিশ প্রশাসন, মানবাধিকার ও গণমাধ্যমকর্মীরা। আপাতত সেই উচ্ছেদের আয়োজন বন্ধ করা হয়েছে। জমির মালিকানা নিয়ে ফয়সালা হওয়ার আগপর্যন্ত পাহাড়িয়া পরিবারগুলো সেখানেই থাকবে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
সাজ্জাদের চাপে অবশ্য ইতিমধ্যে ৩টি পরিবার জায়গা ছেড়ে চলে গেছে। এখন ১৩টি পরিবার আছে। শুক্রবার ভোজের পর তাদের বাড়ি ছাড়ার জন্য রোববার পর্যন্ত সময় দিয়েছিলেন সাজ্জাদ আলী।
পাড়ার বাসিন্দারা জানিয়েছেন, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেক ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী পরিবার ভারতে চলে গিয়েছিল। স্বাধীনতার পর তারা দেশে ফিরে আর বাড়িঘর পায়নি। একজন হিন্দু ব্যক্তি তাঁর ১৬ কাঠা জমিতে ছয়টি পরিবারকে বাস করতে দেন। সেই মালিক অনেক আগেই মারা গেছেন। এখন সাজ্জাদ আলী দাবি করছেন, মালিকের মৃত্যুর আগে এই জমি তাঁর কাছে বিক্রি করে গিয়েছেন।
মহল্লার বাসিন্দারা জানান, বছর দুয়েক আগে সাজ্জাদ আলী তাঁদের বাড়ি ছাড়তে বললে তৎকালীন ওয়ার্ড কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম দুই পক্ষকে নিয়ে বসেছিলেন। সেখানে সাজ্জাদ আলীর কাগজপত্র দেখে কাউন্সিলর বলেছিলেন, এই দলিল জাল। তখন কৌশলে কাউন্সিলরের কার্যালয় থেকে পালিয়ে যান সাজ্জাদ আলী। এরপর তাঁদের আর উচ্ছেদের চেষ্টা করা হয়নি। গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের তিন দিন পর সাজ্জাদ আলী আবার মহল্লায় এসে সবাইকে ঘর ছাড়তে বলেন। পাহাড়িয়ারা বাড়ি ছাড়তে না চাইলে একপর্যায়ে কিছু টাকা দেওয়ার প্রস্তাব দেন সাজ্জাদ।
পাড়ার বাসিন্দারা বলছেন, পরিস্থিতি এমন যে তাঁরা কারও কাছে যেতে পারছেন না। কাউন্সিলরও নেই। তাই চিন্তাভাবনা করে টাকা নিতে রাজি হয়েছিলেন। সাজ্জাদ আলীর হিসাব অনুযায়ী, যুদ্ধের পর ছয়টা পরিবার ছিল, ওই ছয় পরিবার ধরে ৫ লাখ টাকা করে দেবেন। এখন তাঁর ছেলেরা টাকা ভাগ করে নেবেন। পরে অবশ্য ছয় বাড়ির প্রত্যেককে ছয় লাখ টাকা করে দিতে চেয়েছেন তিনি। বাড়ি ছাড়তে প্রথমে তিন মাস সময় দেওয়া হয়েছিল। এরপর ১৫ দিন, ৭ দিন ও ১০ দিন করে সময় দেওয়া হয়েছে। মাসখানেক আগে টাকাও দেওয়া হয়েছে। সবশেষ ১০ দিনের সময় শেষ হবে শুক্রবার। সেদিন খাসি কেটে খাওয়ানো হবে। এরপর রোববারের মধ্যে তাঁদের এলাকা ছেড়ে চলে যেতে হবে।
এই মহল্লায় প্রথম যে ছয়জন প্রথম বাড়ি করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে শুধু ফুলমণি বিশ্বাস বেঁচে আছেন। কথা বলতে পারেন, তবে কথা বলার সময় চোখ বন্ধ করেই বলেন। বয়স কত হয়েছে জানতে চাইলে চোখ বন্ধ করেই বললেন, ‘শুধু মুনে আছে দারুসার রাইটের সময় (১৯৬২ সাল) এক ছেইলের মা।’ জায়গা ছাড়তে হবে, এখন কোথায় যাবেন—জানতে চাইলে বৃদ্ধ ফুলমণি বিশ্বাস বলেন, ‘কোথায় যাব? আমরা তো এখুন আন্ধার ঘরে হাইতড়্যাই তো পাছি ন্যা। আন্ধার ঘরে মানুষ কিছু পায় কি না? ওই রকম আমরাও কিছু খুঁইজে পাছি ন্যা।’
মহল্লার রুবেল বিশ্বাস, শান্ত বিশ্বাস ও রিংকু বিশ্বাস ঘরবাড়ি ভেঙে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে চলে গেছেন। তাঁরা আত্মীয়স্বজনদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন বলে মহল্লার বাসিন্দারা জানান। তাঁরা নিজেরাও এখন একই রকম প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কেউ কেউ অন্য জায়গায় গ্রামের দিকে একটু জমি কিনেছেন। কিন্তু বাড়ি করার টাকা হাতে নেই।
মহল্লার বাসিন্দা পার্বতী রানী অন্তঃসত্ত্বা। বললেন, ‘আমি পোয়াতি। এখুন কার বাড়িত গিয়ে উঠব?’ এই মহল্লার তরুণ শিপেন বিশ্বাস এবার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছেন। শিপেন জানালেন, এ মহল্লায় প্রথম বাড়ি করা ছয়জনের একজন তাঁর দাদা বামনা পাহাড়িয়া। এখানেই জন্ম তাঁর বাবা টুনু বিশ্বাসের। তাঁরাও রোববারের পর এই জমি ছেড়ে চলে যাবেন।

রাজশাহীতে খাসি–ভোজের আড়ালে পাহাড়িয়া সম্প্রদায়ের ১৬টি পরিবারকে ‘উচ্ছেদ’ ঠেকাতে ঘটনাস্থলে পুলিশ। বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজশাহী নগরের মোল্লাপাড়া মহল্লায়। ছবি: প্রথম আলো
এদিকে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশের পর আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে পুলিশের একটি দল নিয়ে আদিবাসীপাড়ায় আসেন কাশিয়াডাঙ্গা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আজিজুল বারী। তিনি পাহাড়িয়াদের প্রশ্ন করেন, ‘আপনারা কেন থানায় যাননি?’ জবাবে মিল্কি বিশ্বাস বললেন, ‘সাজ্জাদ আলী বলেছেন যে তোমরা যদি বাড়াবাড়ি করো, যেটুকু টাকা দিচ্ছি, সেটাও দিব না। এটার জন্য আমরা কোনো জায়গাতে যেতে পারলাম না। আমরা টাকা নিতে বাধ্য হলাম।’
বিশনি বিশ্বাস বললেন, ‘এখানে জন্ম জায়গা। আমরা যদি এখানে থাকতে পারি, থাকতে চাই। জন্ম জায়গা ছেড়ে কেউ চলে যেতে চায়? কেহু তো চাই না। কিন্তু আমরা কুনু জাগাতেই যাইনি। আমাদেরকে বুলেছে, তোমরা যুদি হাঁটাহাঁটি করো, তাহিলে কুনু টাকাই পাবা না।’
সেখানে ছিলেন সাজ্জাদ আলীর কেয়ারটেকার মো. শাহীন। ওসি আজিজুল বারী সাজ্জাদ আলীকে কয়েকবার ফোন করান তাঁকে দিয়ে। একপর্যায়ে একটি দলিল হাতে আসেন সাজ্জাদ। তিনি দাবি করেন, এই জায়গা তিনি ১৯৯৪ সালে কিনেছেন। পুনর্বাসন করে জায়গা দখলে নিচ্ছেন। খাসি কেটে খানার আয়োজনের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘তারা এখানে এত দিন ছিল। চলে যাচ্ছে। আমি তাদেরকে মুরগি খাওয়াতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তারাই বলেছে যে খাসি খাওয়াতে হবে।’
এ সময় বিভিন্ন মানবাধিকার ও আদিবাসী সংগঠনের নেতারাও সেখানে আসেন। ওসি আজিজুল বারী প্রতিটি বাড়ির তালিকা করে নেন। তিনি ১৩টি পরিবার থেকে ১৩ জন এবং সাজ্জাদ আলীকে বিকেল ৫টায় কাশিয়াডাঙ্গা জোনের উপপুলিশ কমিশনারের (ডিসি) কার্যালয়ে ডাকেন।
পরে ওসি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি সংবাদমাধ্যমে জেনে এখানে এসেছি। এই বিষয়গুলো নিয়ে তাঁরা কখনো আগে থানায় যাননি। নিউজ হওয়ার পর আপনারা এসেছেন, আমরাও এসেছি। আমরা সকলে মিলে যেটা সুষ্ঠু সমাধান হয়, সেটা করব। যেটাতে মানবাধিকার লঙ্ঘন হবে না, সেটা করব। আপাতত এখানকার বাসিন্দারা এভাবেই থাকবেন। জমির কাগজপত্র চুলচেরা বিশ্লেষণ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
সূত্র: প্রথম আলো
সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।