রামগড়ে অপহৃত ব্যক্তিকে ছেড়ে দিয়েছে ঠ্যাঙাড়েরা
অপহরণের পর ঠ্যাঙাড়েরা তাকে গুইমারা সেনা ব্রিগেডে নিয়ে যায়। সেনাদের নির্দেশে পরে তাকে ছেড়ে দেয়।

অপহরণের শিকার হওয়া বাসনা মোহন চাকমা।
রামগড় প্রতিনিধি, সিএইচটি নিউজ
সোমবার, ১ সেপ্টেম্বর ২০২৫
খাগড়াছড়ির রামগড়ে সমাবেশ থেকে ফেরার পথে অপহৃত বাসনা মোহন চাকমাকে (৪২) অপহরণের কয়েক ঘন্টা পর নির্যাতন ও হয়রানির পর ছেড়ে দিয়েছে সেনা মদদপুষ্ট ঠ্যাঙাড়ে সন্ত্রাসীরা।
আজ সোমবার (১ সেপ্টম্বর ২০২৫) বেলা পৌনে ১২টার সময় নাকাবা বাজার থেকে সমাবেশের গাড়ি থেকে নামিয়ে ঠ্যাঙাাড়েরা তাকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। বিকাল আনুমানিক সাড়ে ৪টার দিকে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
ভুক্তভোগী বাসনা মোহন চাকমার বাড়ি মানিকছড়ি উপজেলার যোগ্যছোলা ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডের গুজা পাড়ায়। তার পিতার নাম বড়পেদা চাকমা।
অপহরণের পর তাকে মোটর সাইকেলে করে নিয়ে যাওয়ার পথে সন্ত্রাসীরা তাকে অস্ত্র ও ছুরি দেখিয়ে মেরে ফেলার হুমকি দেয় ও শারিরীক নির্যাতন করে।
পরে তাকে গুইমারা সেনা ব্রিগেডে নিয়ে সেনাদের হাতে তুলে দেয়। এরপর সেনাদের জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ না পাওয়ায় তাকে ছেড়ে দিতে ঠ্যাঙাদের নির্দেশ দেয় সেনারা।
অপহরণকারীদের কবল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর তিনি ঘটনার বর্ণনা দেন। তিনি জানান, “রামগড়ের সমাবেশ থেকে গাড়িতে করে ফেরার পথে নাকাবা বাজারে পৌঁছলে বাঙালি ৪ জন, চাকমা ছেলে ১ জন ও মারমা ছেলে ১ জন এসে গাড়ি থেকে আমাকে নামতে বলে এবং তাদের মোটর সাইকেলে উঠতে বলে। আমি গাড়ি থেকে নামিনি। পরে তারা আমাকে টেনে নামায়। আমি ধস্তাধস্তি করে তাদের কাছ থেকে সরে গিয়ে আরেকটি গাড়িতে গিয়ে উঠি এবং সেখানে থাকা লোকজনকে আমাকে বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করি। তারা (ঠ্যাঙাড়েরা) আবার সেই গাড়িতে গিয়ে আমাকে বন্দুক তাক করে নামায়। সেখানেও তাদের সাথে ধস্তাধস্তি হয়। পরে আমাকে গুলি করে মেরে ফেলতে পারে ভেবে আমি আর পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করিনি। এরপর তারা আমাকে তাদের মোটর সাইকেলে তুলে নিয়ে যায়।
“বাঙালি লোকটি মোটর সাইকেলটি চালিয়ে নেয় ও চাকমা ছেলেটি পিছনে বসা ছিল। নেয়ার সময় পথে পথে থামিয়ে নানা কথাবার্তা জিজ্ঞাসা করে, ঠিকানা জিজ্ঞাসা করে। বাঙালি লোকটি ছুরি বের করে মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে বলে ‘তোমাকে মেরে ফেলকে কিছুই হবে না’। ছুরি ছাড়াও তার হাতে বন্দুকও ছিল। তবে তার সাথে থাকা চাকমা ছেলেটি তাকে কোন কিছু না করতে বলে। জায়গাটা আমার পরিচিত ছিল না। পরে যখন একটি ছড়া পার হয়ে যাই তখন ছড়াটি চিনতে পারি।
“সেখানে আমার পরিচিত এক ব্যক্তি আমাকে দেখে আফসোস করেন। সেখানে তারা (ঠ্যাঙাড়েরা) আমাকে দোকানে বসিয়ে কোমাল পানীয় স্প্রিড ও বিস্কুট খেতে দেয়।
“এরপর দু’টি মোটর সাইকেল আসে, যেগুলোতে চালক ছিল দু’জন বাঙালি। চাকমা ছেলেটি সেখানে থেকে যায় এবং আমাকে বলে ‘তাদের সাথে চলে যান, আপনাকে তারা ছেড়ে দেবে’।
“পরে বাঙালি লোকগুলো মোটর সাইকেলে নিয়ে আমাকে গুইমারা ব্রিগেডে নিয়ে যায়। সেখানে সেনাবাহিনী আমাকে কোথা থেকে কেন ধরে নিয়ে এসেছে সে বিষয়ে জিজ্ঞাসা করে। তখন আমি বলি যে, ‘ইউপিডিফের লোকজন ডাকার কারণে আমি রামগড়ে সমাবেশে গেছি। সেখান থেকে ফেরার সময় তারা অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে আমাকে ধরে নিয়ে আসে’।
“সেনারা আমাকে ইউপিডিএফ কর্মি কতজন থাকে জিজ্ঞাসা করে। তখন আমি বলি, আমি সেটা জানি না। আমাকে একজন ফোন দিয়ে ডেকেছে তাই আমি সমাবেশে গেছি। তখন সেনারা বলেন, ‘আমরা জনগণের জন্য কাজ করি, সাধারণ জনগণকে আমরা কোন কিছু করি না। তোমরা যে কাজগুলো করছো সেটা আর করো না’।
“তখন আমি সেনাদেরকে বলি, আমি তো কোন পার্টি করি না। পার্টি করলে কী আমি এই পোশাকে থাকতাম? আমি একজন সাধারণ পাবলিক। তারা আমাকে বিনা কারণে আপনাদের এখানে ধরে নিয়ে এসেছে।
“তারপর সেনারা তারা (ঠ্যাঙাড়েরা) আমাকে ভাত খাইয়েছে কিনা জিজ্ঞাসা করে। আমি বলি খাওয়ায়নি। এতে সেনারা ভাতের ব্যবস্থা করার কথা বললে আমি খাব না বলে তাদের বলি। তখন আমি বলি, আমার শরীর ভালো লাগছে না, তারা (ঠ্যাঙাড়েরা) আমাকে মারধর করেছে। আমাকে যেখানে ধরেছে সেখানে মারধর করেছে বলে সেনাদেরকে বলি। তখন সেনারা বলেন যে, ‘তারা ধরেছে সেটা তাদের ব্যাপার। আমরা সাধারণ মানুষকে কোন কিছু করি না’।
তারপর সেনারা আমাকে ভিডিও করে রাখে। ভিডিও ধারণের সময় তারা জিজ্ঞাসা করে, ‘আমাকে সেনাবাহিনী মারধর করেছে কিনা, তখন আমি বলি আমাকে সেনাবাহিনী মারধর করেনি’।
“পরে সেনারা যারা আমাকে ধরে নিয়ে এসেছে তাদের হাতে তুলে দিয়ে ছেড়ে দেয়ার নির্দেশ দেয়।
“এরপর তারা (ঠ্যাঙাড়েরা) আমাকে গুইমারা বাজারে তাদের অফিসে নিয়ে যায়। সেখানে নেয়ার পর আমার মোবাইল থেকে কার্বারি, মুরুব্বীদের নাম্বারগুলোা নিয়ে নেয়। পরে আমাকে সেখানে যোগাযোগ করতে যাওয়া মুরুব্বীদের হাতে তুলে দেয় এবং আমি ফিরে আসি।”
তিনি নাকাবা বাজার থেকে ধরে নেয়ার সময় বেঁধে নিয়ে যায় জানিয়ে বলেন, নেওয়ার অর্ধেক পথে দোকানে গিয়ে তারা বাঁধনটি খুলে দেয়। তাকে ব্রিগেডে নেয়ার সময় বাঁধা অবস্থায় ছিলেন না বলে জানান। অপহরণের স্থান থেকে নেয়ার পথে বিভিন্ন স্থানে অন্তত ১০/২০ বার থামিয়ে সন্ত্রাসীরা তাকে মারধর করেছে বলেও জানান তিনি।
অপহরণকারীদের চেনেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সবাইকে চিনি না। তবে যে বাঙালি লোকটি মারধর করেছে তার নাম বাপ্পি। আওয়ামী লীগের মাইজউদ্দিনের চামচা ছিল। তার হাতে ছুরি ও বন্দুক ছিল। তার বাড়ি মানিকছড়ি সদরের গরু বাজার বলে জানি’।
উল্লেখ্য, আজ সোমবার (১ সেপ্টেম্বর) সকালে পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনা অভিযানের নামে দমন-পীড়নের প্রতিবাদে রামগড়ের যৌথখামার এলাকায় পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ ও গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ আয়োজন করে। উক্ত সমাবেশে অংশগ্রহণ করেছিলেন বাসনা মোহন চাকমা। সমাবেশ শেষে ফেরার পথে নাকাবা বাজারে লোকজন বহনকারী গাড়িগুলো পৌঁছলে সেখানে ঠ্যাঙাড়েদের হামলার কবলে পড়ে এবং বাসনা মোহন চাকমা অপহরণের শিকার হন।
ঠ্যাঙাড়ে সন্ত্রাসীরা বাসনা মোহন চাকমাকে বলেছে, ইউপিডিএফভূক্ত সংগঠনগুলোর দু’জনকে হত্যা বা অপহরণের টার্গেট ছিল তাদের। তার সাথে ধস্তাধস্তি হওয়ার করণে তাদের টার্গেট মিস হয়েছে। তবে ঠ্যাঙাড়েরা ডিওয়াইএফের রামগড় উপজেলা সভাপতি ধনু ত্রিপুরার ওপর হামলার চেষ্টা চালিয়েছিল। তবে তিনি অক্ষত অবস্থায় সরে যেতে সক্ষম হন।
সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।