লামায় ম্রো-ত্রিপুরাদের সাথে সংসদীয় কমিটির তামাশা
সুনয়ন চাকমা

গত ২৬ এপ্রিল পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্যরা ম্রো সম্প্রদায়, ত্রিপুরা সম্প্রদায় ও রাবার বাগান সংশ্লিষ্ট এলাকা পরিদর্শন’-এর নামে ম্রো ও ত্রিপুরা গ্রামবাসীদের সাথে যা করেছেন তাকে তামাশা ছাড়া আর অন্য কিছু বলে অভিহিত করা যায় না। তাদের সফরের ঘোষিত উদ্দেশ্য দেখে এটা যে কারোর মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, তারা বান্দরবানের লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজের ভূমি বেদখল ও জুলুমের শিকার তিন গ্রামের ভুক্তভোগীদের কথা শুনে এবং সংশ্লিষ্ট এলাকা ঘুরে দেখার পর সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে বাস্তবসম্মত সুপারিশসহ একটি রিপোর্ট পেশ করবেন। কিন্তু কোন কিছুর ফেইস ভ্যালু দেখে কিছু একটা মনে করা এক জিনিস, আর বাস্তবতা অন্য জিনিস। কমিটির মান্যবর সদস্যরা লামায় গিয়ে তদন্ত নয়, পরিবেশ ধ্বংসকারী, জুলুমবাজ ও ভূমিদস্যু কোম্পানির পক্ষে নির্লজ্জের মতো ওকালতি করে আসলেন, যেন তারা কোম্পানির ভাড়া করা দালাল।
তোমরা প্রতি পরিবার ৫ একর করে জমি নাও, অন্যথায় সময় যত গড়াবে সবাই তত ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’ ম্রো-ত্রিপুরাদের কাছে এই ছিল তাদের মূল বক্তব্য। সেখানে বিতর্কীত রাবার কোম্পানিটির কুকর্ম ও জঘন্য সব অপরাধের কোন কথা ছিল না। ভুক্তভোগী গ্রামবাসীদের দুঃখের কথা, , দুর্দশার কথা শোনা হলো না। তারা বড় আশা করে কমিটির কাছে একটি স্মারকলিপি দেন, সে ব্যাপারেও কোন আলোচনা হলো না। যা হলো কেবল কোম্পানির হয়ে দালালি, ওকালতি ও প্রচ্ছন্ন হুমকি। যারা জনপ্রতিনিধি, জনগণের ভোটে যারা নির্বাচিত, তারা এমন আত্মঅবমাননাকর কাজ করতে পারে না। আসলে এটা স্পষ্ট যে, সংসদীয় কমিটির সদস্যরা ম্রো ও ত্রিপুরাদের ওপর জোর করে কোম্পানির দেয়া প্রস্তাব গেলাতে লামা গিয়েছিলেন।
পাঁচ একর জমির এই প্রস্তাব ভূমি দস্যু কোম্পানি লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ নিজে বহু আগে দিয়েছে। আর সঙ্গত কারণে ম্রো-ত্রিপুরা গ্রামবাসীরাও তা প্রত্যাখ্যান করেছে। সেই পর থেকে তাদের ওপর কোম্পানির নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যায়। একের পর এক সাজানো মামলা, জেল-জুলুম, হামলা, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া, লুটপাট কোন কিছু বাদ যায়নি। চতুর কোম্পানি হয়তো মনে করে থাকতে পারে ‘সহজ সরল’ ম্রো-ত্রিপুরারা এতদিনে হয়ত ভর্তা হয়ে গেছে; তাই সে বুদ্ধি করে এবার সেই একই পাঁচ একর প্রস্তাব নিয়ে ঘটকালি করতে সংসদ সদস্যদের পাঠিয়েছে।
ম্রো-ত্রিপুরারা ‘সহজ সরল’ হতে পারে, কিন্তু বোকা নয়। কোম্পানির ভাড়াটে দালালরা সেখানে গিয়ে সেটা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছে। গ্রামবাসীরা তাদের প্রস্তাব তাদের মুখের ওপর ছুঁড়ে দিয়েছে এবং পরদিন অর্থাৎ ২৭ তারিখ বান্দরবান জেলা সদরে সাজানো সালিশী বৈঠক বয়কট করে। তারা সাফ জানিয়ে দিয়েছে, তারা লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজের গরু মেরে জুতা দান গ্রহণ করতে রাজী নয়। তারা অনেক সহ্য করেছে, তাদের অনেক জমি কেড়ে নেয়া হয়েছে। এবার তারা তাদের শেষ সম্বলটুকু যে কোন মূল্যে রক্ষা করতে প্রস্তুত। এটা তাদের অস্তিত্বের লড়াই, বাঁচা মরার যুদ্ধ।
সংসদীয় কমিটির সদস্যরা ভূমির বিষয়টি এমনভাবে উপস্থাপন করেছে যেন কোম্পানি দয়া পরবশ হয়ে হতদরিদ্র ম্রো ও ত্রিপুরাদেরকে ৫ একর করে জমি ভাগ দিচ্ছে। হায় সময় হায় দিন বদল!! তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ, আমি আজ চোর বটে।’ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা নামক বস্তুটি যেন যাদুর কাঠি। যে জমি বাপ দাদা চৌদ্দ পুরুষ ধরে ম্রো-ত্রিপুরাদের বলে জগতবাসী জানে, সেই জমি আজ এক কলমের আঁচড়ে অন্যের হয়ে গেল! আর নিজের জমির অধিকার দাবি করা এখন হয়ে গেছে মস্তবড় অপরাধ। সেজন্য বিনা দোষে আজ ম্রো-ত্রিপুরারা জেল খাটে, আর শত অপরাধ করেও ভূমি দস্যুরা ছড়ি ঘোরায় আর দালাল হাঁকায়। তারা আজ দয়ালুও সাজে!
কমিটির আহ্বায়ক এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরী ‘পরিদর্শনে’ গিয়ে বলেছেন, ‘পাড়াবাসীর কোনো পরিবারের নামে জমির মালিকানা দলিল নেই।’ (দেখুন: প্রথম আলো, ২৭ এপ্রিল ২০২৩)। তার এই বক্তব্য যাদুকরের ভ্যানিসিং এগ ম্যাজিক দেখানোর মতো। ডিমগুলো ছিল, এখন নেই (দর্শকের সামনে), কিন্তু ডিমগুলো আছে। ম্রো-ত্রিপুরাদের জমির মালিকানাও ছিল, এখন নেই (কাগজে কলমে), কিন্তু তবুও মালিকানা আছে। আমরা জানি ম্যাজিশিয়ানের মতো আপনারা ম্রো-ত্রিপুরাদের জমির মালিকানা লুকিয়ে রেখেছেন।
আইনের বিভিন্ন উৎসের কথা আপনারা জানেন। প্রথা বা ইংরেজীতে কাস্টম হলো এমন একটি উৎস। ম্রো-ত্রিপুরাদের জমির মালিকানার উৎস হলো আবহমানকাল ধরে চলে আসা এই প্রথা, যা আমাদের রাষ্ট্র ও সরকার কখনও মেনে নেয়, আবার কখনও শক্তির জোরে ক্ষুণ্ন করে। ম্রো- ত্রিপুরাদের যে জমি সরকার অবাসিন্দাদের কাছে লিজ দিয়েছে সেটা অন্যায়, বেআইনী ও চরম বৈষম্যমূলক। লিজ দেয়ার প্রক্রিয়ার মধ্যেও বিস্তর গলদ রয়েছে। অন্যায় ও বেআইনী এ কারণে যে, সরকার একের জমি অন্যের কাছে লিজ দিতে পারে না। দ্বিতীয়ত, লিজ দেয়ার আগে স্থানীয় হেডম্যানের কোন মতামত, সুপারিশ নেয়া হয়নি, যদিও নেয়া বাধ্যতামূলক। আর বৈষম্যমূলক এই কারণে যে, যদি লিজ দিতেই হয়, তাহলে প্রথমে সেটা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পাওয়ার অধিকার রয়েছে স্থানীয় ম্রো ও ত্রিপুরাদের এবং তারপর পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী পাহাড়ি বাসিন্দাদের। কিন্তু সরকার যাদের কাছে লিজ দিয়েছে তারা ৯৯% অবাসিন্দা বা পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরের বাসিন্দা। এখন যে ম্রো-ত্রিপুরাদের কাছে পাঁচ একর জমির প্রস্তাব দেয়া হচ্ছে তাও বৈষম্যমূলক। কারণ অন্যান্য বিষয় বাদ দিলেও, যেখানে পার্বত্য চট্টগ্রামের অনাবাসী হওয়া সত্ত্বেও কোম্পানির সদস্যদের প্রত্যেককে ২৫ একর করে দেয়া হয়েছে, সেখানে স্থায়ী বাসিন্দা ও ওই জমি বংশপরম্পরায় ভোগদখল করা সত্ত্বেও ম্রো ও ত্রিপুরাদের মাত্র পাঁচ একর করে দেয়ার প্রস্তাব দেয়া হচ্ছে। এটা কি করে মেনে নেয়া যায়?
আমরা চাই ম্রো ত্রিপুরাদের সাথে এই তামাশা বন্ধ হোক, তাদের প্রতি অন্যায় অবিচারের অবসান হোক এবং তাদের ন্যায্য দাবি মেনে নেয়া হোক। (সমাপ্ত)
* লেখক: পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সাবেক সভাপতি।
লেখাটি তাঁর ফেসবুক থেকে নেওয়া।
সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।
সিএইচটি নিউজের ইউটিউব চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব করুন