শহীদ ভরদ্বাজ মুনি’র আত্মবলিদানের দুই যুগ
ডেস্ক রিপোর্ট।। আজ ১৩ অক্টোবর পার্বত্য চট্টগ্রামে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রথম শহীদ ভরদ্বাজ মুনি’র আত্মবলিদানের দুই যুগ পূর্ণ হল। নব্বইয়ের দশকে সূচিত গণতান্ত্রিক লড়াই সংগ্রামে “১৩ অক্টোবর” রক্তে লেখা একটি দিন! ১৯৯২ সালের এদিনে দীঘিনালা সদরে ছাত্র গণসমাবেশের ডাক দেয় তৎকালীন বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ ও পাহাড়ি গণপরিষদ। এ আহ্বানে সাড়া দিয়ে সেদিন আক্ষরিক অর্থে মাইনি উপত্যকায় ছাত্র জনতার ঢল নামে। শত শত আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা পিসিপি ও পাহাড়ি গণপরিষদ আহূত ছাত্র-গণসমাবেশে যোগ দিতে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। কোথাও সারিবদ্ধভাবে আবার কোথাও খণ্ড খণ্ড মিছিল আকারে বিভিন্ন বয়সের মানুষ সমাবেশস্থলের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে, যেন মুক্তিকামী জনতার একেকটি কাফেলা! সমাবেশে অংশ নিতে এমনি একটি দলের সহযাত্রী হয়ে সেদিন ৭০ বছরের বয়োবৃদ্ধ ভরদ্বাজ মুনিও রাজপথে নেমেছিলেন। কিন্তু সেনাসৃষ্ট সন্ত্রাসী গুণ্ডাদের (‘একক বাংলা ত্রিপুরা পরিষদ’, স্থানীয় বখাটেদের দিয়ে গঠিত সেনাচক্রের ঠ্যাঙ্গারে বাহিনী, পরবর্তীতে মুখোশবাহিনী) হামলায় মাইনি ব্রিজের সন্নিকটে তিনি শহীদ হন। হামলায় গুরুতর জখম হয়েছিলেন বয়স্ক নারীসহ আরও অর্ধ শতাধিক লোক। বিশেষ করে দৌঁড়াতে না পারার কারণে বয়স্করাই বেশি হামলার শিকার হয়েছিলেন। দুর্বৃত্তদের হামলা থেকে বাঁচতে অনেকে স্রোতস্বিনী মাইনি নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মরক্ষা করেছিলেন।

পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ ও পাহাড়ি গণপরিষদ আহূত শান্তিপূর্ণ এ ধরনের সমাবেশে বর্বরোচিত হামলায় বলতে গেলে গোটা মাইনি উপত্যকার জনতা ফুঁসে ওঠে। তারপর দ্রুত মোড় নেয় ঘটনার। দীঘিনালায় সূচিত হয় গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নতুন অধ্যায়! ১৩ অক্টোবরের দীঘিনালা আর তারপরের দীঘিনালার পার্থক্য যেন রাত-দিনের! পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যত্র পিসিপি’র শাখা-প্রশাখার বিস্তার ঘটলেও ইতিপূর্বে দীঘিনালায় সংগঠনের নেতা-কর্মীদের দালাল স্পাইদের ভয়ে আত্মগোপন করে থাকতে হতো। সেনা রক্তচক্ষুর ভয়ে সবাইকে সন্ত্রস্ত থাকতে হতো, দালাল স্পাই প্রতিক্রিয়াশীলদের প্রচণ্ড দাপটে সন্ধ্যে না হতেই কারাগারের মত নিজ নিজ ঘরে ফিরে দরজা বন্ধ করে থাকতে হতো। ১৩ অক্টোবর শহীদ ভরদ্বাজ মুনি’র আত্মবলিদানের মধ্য দিয়ে সেনা-প্রশাসন দালাল স্পাই প্রতিক্রিয়াশীলদের দাপট চূর্ণ হয়ে যায়। জাগরণ ঘটে ছাত্র-জনতার, শহীদের রক্তে দীঘিনালায় রচিত হয় শক্ত আন্দোলনের ভিত্তি। পাড়ায় পাড়ায় গড়ে ওঠে পিসিপি ও পিজিপি (পাহাড়ি গণপরিষদ)-এর কমিটি।
১৩ অক্টোবর ১৯৯২ সেনা-দুর্বৃত্তদের যৌথ হামলার মুখে তড়িঘড়ি করে সমাবেশ শেষ করতে হয়। সমাবেশে যোগদানকারী নেতৃবৃন্দ আলোচনা সাপেক্ষে কয়েক গ্রুপে বিভক্ত হয়। শীর্ষ নেতৃত্ব সেদিনই এলাকা ত্যাগ করে খাগড়াছড়ি সদরে ফিরে যান, অপর অংশ দীঘিনালায় অবস্থান নিয়ে গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে, সেনা ও দুর্বৃত্তদের অপতৎপরতার বিরুদ্ধে পাড়ায় পাড়ায় মিটিঙ করে জনমত সংগঠিত করতে থাকে। উপজেলা সদরের সমাবেশ সেনা-প্রশাসন বানচাল করে দিলেও প্রত্যন্ত অঞ্চলে দ্বিগুণ উৎসাহে পিসিপি সভা ও সংগঠন গড়তে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সেনা দালাল প্রতিক্রিয়াশীলরা পিসিপি ও পাহাড়ি গণপরিষদের নেতা-কর্মীদের সাংগঠনিক তৎপরতার ফলে কোণঠাসা হয়। মাইনি এলাকায় পিসিপি’র অগ্রযাত্রা রুদ্ধ করতে ভরদ্বাজ মুনি’কে খুন করে সেনাচক্র প্রকারান্তরে আন্দোলনের আগুনে ঘি ঢেলে দেয়ার কাজই করেছিল, দাবানলের মত নবচেতনায় জ¦লে উঠেছিল মুক্তিকামী ছাত্র-জনতা।

উল্লেখ্য যে, ১৩ অক্টোবরের ছাত্র গণসমাবেশে তৎকালীন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি প্রসিত খীসা ও সাধারণ সম্পাদক করুণাময় চাকমাসহ বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতাও উপস্থিত ছিলেন। দুর্বৃত্তদের হামলার মুখে তড়িঘড়ি করে তাদের সবাইকে উপজেলা সদর ও থানায় অবস্থান গ্রহণ করতে হয়। এ সময় পরিকল্পনা মত সেনা ও পুলিশ প্রহরাধীনে ‘একক বাংলা ত্রিপুরা পরিষদ’ নামধারী বখাটে যুবকদের (পাহাড়ি ও সেটলার সমন্বয়ে গঠিত) একটি মিছিল পিসিপি নিষিদ্ধের দাবি জানায়। পিসিপি’র নেতৃবৃন্দ থানায় অবস্থান নিলে সেখানে তারা ব্যান্ডেজ করা কয়েক জন সেটলার যুবককে হাসি ঠাট্টা করতে দেখতে পান। আগে থেকেই পরিকল্পনা মত সেনাচক্র কৃত্রিম ব্যান্ডেজ করা কয়েকজন সেটলার যুবককে থানায় রেখেছিল, যাতে পাল্টা-পাল্টি মারামারির ঘটনা সাজিয়ে পিসিপি’র বিরুদ্ধে মামলা দেয়া যায়। গুরুতর আহত সেজে থাকলেও হাসি তামাশা ধস্তাধস্তিতে মশগুল যুবকদের কৃত্রিমতা ধরা পড়ে যায়। পিসিপি নেতৃবৃন্দের থানায় অবস্থান গ্রহণের ফলে ষড়যন্ত্রে ব্যর্থ হয়ে আহত সেজে থাকা সেটলার যুবকরা থানা ত্যাগ করে। সেনাচক্রের চক্রান্ত তাতে ভণ্ডুল হয়ে যায়। পরে দীঘিনালার তৎকালীন সেনা ব্রিগেড কমান্ডার (কর্ণেল পদবীর) নিজে থানায় গিয়ে পিসিপি’র নেতৃবৃন্দের সাথে সাক্ষাৎ করলে এ সময় পিসিপি নেতৃবৃন্দের সাথে তার বাকবিতণ্ডা হয়। ঘটনার সাথে ব্রিগেড কমান্ডার সেনা সংশ্লিষ্টতার কথা অস্বীকার করে বলেন ‘উপরওয়ালা আছে, উনি বিচার করবেন’। পরে জানা যায়, দীঘিনালায় মোতায়েনকৃত সেনাদের মধ্যকার একটি চক্র ব্রিগেড কমান্ডারের অজ্ঞাতে তা ঘটিয়েছিল। সেনাচক্রের অন্যতম পাণ্ডা ছিল ব্রিগেড স্টাফ মেজর হায়দার নামের এক সেনা কর্মকর্তা। হামলার ঘটনাস্থল পরিদর্শন কালে এবং থানায় অবস্থানকালে পিসিপি নেতৃবৃন্দ তাকে প্রশ্ন ও বাক্যবাণে ধরাশায়ী করে। পিসিপি নেতৃত্বের সম্মুখে উক্ত সেনা কর্মকর্তা মুখ তুলে কথা বলতে পারেন নি, পরাজিত সৈনিকের মত তিনি ছিলেন অবনত মস্তকে।
——————
সিএইচটি নিউজ ডটকম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।