শেখ হাসিনা ও একটি ঐতিহাসিক ভুলের পুনরাবৃত্তি

0

রাজনৈতিক ভাষ্যকার, সিএইচটিনিউজ.কম

কে যেন বলেছেন, ইতিহাসের শিক্ষা হচ্ছে এই যে, ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না। বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ইতিহাস থেকে শিক্ষা না নেয়ার মধ্যে একজন। সংবিধান সংশোধন বিষয়ক বিশেষ সংসদীয় কমিটির সাথে বৈঠকের পর গত ৩০ এপ্রিল তার সরকারী বাস ভবন গণভবনে সংবাদিকদের সাথে আলাপকালে তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয়দেরকে আদিবাসীহিসেবে বিবেচনা করা যায় না। গালফ টাইমস-এ প্রধানমন্ত্রীর উক্ত আলাপ সম্পর্কে প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয়েছে:

Asked whether her party supported the demand to recognise the tribal population of Chittagong Hill Tracts as indigenous, the Prime Minister replied that tribals in the Chittagong Hill Tracts cannot be considered as indigenous.

“History shows that the origin of the tribal people was outside the boundaries of this country. It is we Bengalis, who are indigenous to this land,” she said.

(http://www.gulf-times.com/site/topics/article.asp?cu_no=2&item_no=431349&version=1&template_id=44&parent_id=24)

শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি আসনও তার ঝুলিতে যোগ হয়। এরপর গত বছর ২১ জুলাই সরকার সংসদ উপনেতা সাজেদা চৌধুরীকে প্রধান করে সংবিধান সংশোধনের জন্য একটি বিশেষ সংসদীয় কমিটি গঠন করে৷ জুম্ম জনগণের দীর্ঘ দিনের দাবি হলো সংবিধানে জাতিসত্তার স্বীকৃতি ও পার্বত্য চট্টগ্রামকে স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের মর্যাদা দেয়া। সংবিধান সংশোধনের জন্য উক্ত কমিটি গঠিত হলে পাহাড়ি জনগণের এই দাবিগুলো ১৯৭২ সালের পর আবার সামনে চলে আসে। পাহাড়িদের বিভিন্ন সংগঠন ও শ্রেণী-পেশার মানুষের মধ্যে এ নিয়ে এক চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। তাদের অনেকের ধারণা ছিল, যেহেতু আওয়ামী লীগ বিগত সংসদ নির্বাচনসহ বিভিন্ন সময় পার্বত্য অঞ্চলের সমস্যার সমাধানের কথা বলেছে, পাহাড়ি জনগণের প্রতি তার আন্তরিকতার কথা বলেছে, সেহেতু এবার হয়তো জাতিসত্তার অধিকার ও স্বীকৃতি মিলবে। উল্লেখ্য, পাহাড়িদের এই অংশটি আন্দোলনের পরিবর্তে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের মনোরঞ্জন করেই জনগণের অধিকার আদায়করতে বেশী আগ্রহী৷ তাই, শেখ হাসিনার উপরোক্ত উক্তি তাদেরকে চরমভাবে হতাশ করবে — এতে কোন সন্দেহ নেই৷ তবে আন্দোলনের স্বার্থে তাদের এই স্বপ্নভঙ্গের দরকার ছিল বৈকি!

অবশ্য, ইউপিডিএফ-এর নেতৃত্ব চুক্তির আগে থেকেই আওয়ামী লীগ সম্পর্কে জেএসএস-এর হাই কমান্ডসহ সকলকে সতর্ক করে আসছিল। কিন্তু তা সত্বেও জেএসএস নেতৃবৃন্দ শেখ হাসিনার ওপর অগাধ আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপন করেছিলেন৷ চুক্তির পর আওয়ামী লীগের প্রথম মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার আগ পর্যন্ত জেএসএস নেতা সন্তু লারমার এই আস্থা ও বিশ্বাস অক্ষুন্ন ছিল। তখন তিনি বেশ কয়েকবার হাসিনার প্রতি তার অগাধ আস্থার কথা বলেছিলেন। সে সময়কার পত্রিকার পাতা উল্টোলেই তার সে সব বক্তব্য পাওয়া যাবে। তার এ ধরনের তোষামোদী ও বালসুলভ কথাবার্তার কারণে জনগণের এক উল্লেখযোগ্য অংশ আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনা সম্পর্কে বিভ্রান্তিতে ভুগেছে বা এখনো ভুগছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে জনগণের মুক্তির জন্য যে-ই আন্দোলন করতে ইচ্ছুক, তাকে অবশ্যই আওয়ামী লীগসহ বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর রাজনৈতিক চরিত্র বিশ্লেষণ করতে সক্ষম হতে হবে। আওয়ামী লীগ কী ধরনের দল, সে কার প্রতিনিধিত্ব করে, কীভাবে সে গঠিত হয়েছে, তার নেতৃত্ব কেমন ইত্যাদি সম্পর্কে সম্যক ধারণা না থাকলে বার বার বিভ্রান্তিতে পড়তে হবে ও আন্দোলনে সঠিক নেতৃত্ব দেয়া যাবে না৷ আওয়ামী লীগ সম্পর্কে জেএসএস নেতৃত্বের সঠিক ধারণা থাকলে আজ পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণকে এই দশায় পড়তে হতো না।

আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক চরিত্রের বিশ্লেষণ এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। তবে এ প্রসঙ্গে এটা বলা দরকার আওয়ামী লীগের মতো দলগুলোর চরিত্রে প্রতারণা, ভাওতাবাজী ও মিথ্যাচার হলো অঙ্গের ভূষণ। এক মহান বিপ্লবী বলেছেন, এ ধরনের চরিত্রসম্পন্ন দলগুলো জনগণের সাথে হাজার রকম প্রতারণা করেই শাসন কাজ চালায়৷ তারা এক হাতে জনগণকে অধিকার দিয়ে অন্য হাতে তা কেড়ে নেয়৷ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের মন্ত্রী, আধা-মন্ত্রী-সিকি মন্ত্রী ও অন্যান্য নেতা-পাতি নেতারা যুগের পর যুগ মুখে ও কাগজে কলমে পাহাড়িদেরকে আদিবাসীহিসেবে সম্বোধন করে এসেছে। অথচ আজ যখন তাদের অধিকার দেবার প্রশ্নটি সামনে চলে এসেছে তখন একি কথা শুনি আজ মন্থরার মুখে। হাসিনা এখন বলছেন সম্পূর্ণ উল্টো কথা। প্রতারণা দিয়েই আওয়ামী লীগের মতো দেশের শাসক দলগুলো গড়া৷ এ সত্যতো সবচেয়ে বেশী জানার কথা ছিল জেএসএস ও সন্তু লারমার৷ কারণ তিনি ও তার দলই শেখ হাসিনা ও তার দলের হাতে বার বার প্রতারিত হয়েছেন। ন্যাড়া একবারই বেল তলায় যায়। কিন্তু, আমাদের জেএসএস নেতৃত্ব বার বার বেল তলায় গেছে এবং নিজের মাথার সর্বনাশ করেছে। নির্বোধের মতো জেএসএস-ই বার বার শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের প্রতারণার সর্বনাশা ফাঁদে পা দিয়েছে এবং সেই ভুলের মাশুল কেবল তাকে নয়, সমগ্র পার্বত্যবাসীকে এখনো পর্যন্ত দিতে হচ্ছে।

তবে, শেখ হাসিনা পাহাড়ি জনগণের জাতিগত অস্তিত্বের স্বীকৃতি ও স্বায়ত্তশাসনের অধিকার না দিয়ে যে ভুল করতে যাচ্ছেন তা ১৯৭২ সালে তার পিতা শেখ মুজিবর রহমানের কৃত ভুলের মতোই ঐতিহাসিক। মুবিজর রহমান সে সময় পাহাড়িদেরকে তাদের ন্যায্য অধিকার না দিয়ে বাঙালি হতে বলেছিলেন। চলি্লশ বছর পর আজও সেই একই ভুলের পুনরাবৃত্তি আমরা দেখতে পাচ্ছি৷ শেখ হাসিনা পাহাড়িদেরকে বাঙালি হতে বলছেন না ঠিকই, এবং সেটা বলা বর্তমান রাজনৈতিক প্রোপটে সম্ভব নয়, কিন্তু তিনি তাদের ওপর এমন এক পরিচয় জোর করে চাপিয়ে দিতে চাইছেন যে পরিচয়ে পরিচিত হতে তারা আদৌ রাজী নন। তাছাড়া জাতিগত পরিচয়ের চাইতেও সবচেয়ে বড়ো বিষয় হলো পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের স্বায়ত্তশাসনের অধিকারের বিষয়টি৷ তিনি সেটা মুখেও আনছেন না। মোট কথা, পাহাড়ি জনগণকে তিনি অধিকার ও সম্মান দেবার পরিবর্তে অপমানিতই করছেন৷ যারা তার ওপর আস্থা ও বিশ্বাস রেখেছেন তারা তার বিনিময়ে পাচ্ছেন চরম অপমান ও অস্বীকৃতি৷ কোন ব্যক্তি দীর্ঘ দিন তার চরিত্র লুকিয়ে রাখতে পারে না৷ শেখ হাসিনাও পারলেন না৷ আদিবাসীজনগণের প্রতি তার মেকি দরদ সবার কাছে আজ উন্মোচিত। ঈশপের গল্পে যেমন বাঘটি মেষ শাবকদের খাওয়ার জন্য মেষের চামড়া পরে মেষদের ভিড়ে লুকিয়েছিল, শেখ হাসিনাও এতদিন আদিবাসীদেরশেষ করার জন্য আদিবাসীদরদী সেজেছিলেন।

শেষে একটি কথা বলা দরকার। ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়ার বিষয়টি সম্পূর্ণ ব্যক্তির ইচ্ছাধীন। (অবশ্য এ ক্ষেত্রে একটু ভিন্ন ব্যাপার আছে৷) কিন্তু ইতিহাসে দেখা যায়, যে ব্যক্তি ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না, ইতিহাসও তার বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয়। আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে এই অমোঘ সত্যটি তুলে ধরতে চাই।

——————

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More