সরকার ম্রোদের ন্যুনতম বেঁচে থাকার অধিকারটুকু রক্ষা করতে আগ্রহী নয়- ইমতিয়াজ মাহমুদ

0
লামা রাবাার ইন্ডাস্ট্রিজ’র লেলিয়ে দেয়া সন্ত্রাসীদের লাগিয়ে দেয়া আগুনে সর্বস্ব হারানো এক ম্রো পরিবার। ফাইল ছবি

১)

এই নতুন বছরের প্রথম তারিখে রাতের বেলার ঘটনা। বান্দরবানের লামা উপজেলার রেংয়েন ম্রো পাড়ায় একদল লোক হামলা করে ঘরবাড়ীতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে সেখানকার রাবার কোম্পানির লোকেরা।

হতদরিদ্র গ্রামবাসীদের ঘরগুলিতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। ম্রোদের যাদেরকেই পেয়েছে মারধোর করেছে। ভয়ে পালিয়ে বেঁচেছে ম্রোরা। হামলাকারীরা দরিদ্র গ্রামবাসীর ছাগল, মুরগি বা অন্যান্য যা কিছু পেয়েছে সব নিয়ে গেছে। উদ্দেশ্যটা স্পষ্ট- ম্রোদেরকে এই গ্রাম থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া। কারা করেছে এই দুষ্কর্ম? আক্রান্তদের ভাষ্য অনুযায়ী ওদের জায়গা দখল করার জন্যে ওখানকার রাবার কোম্পানিটির লোকেরা এই হামলা করেছে। আমি ওদের কথা অবিশ্বাস করার কোন কারণ দেখি না। কেননা ম্রোদের ঐসব জীর্ণ কুটিরে ঐ রাবার বাগানের লোকেরা ছাড়া অন্য কারো এইরকম আক্রমণ করার কোন কারণ নাই।

খবরের কাগজে এই খবরটা এসেছে। আমি নিয়মিত চোখ রাখছিলাম, প্রত্যাশা ছিল যে পুলিশ একটা কিছু ব্যবস্থা নিবে, হয়তো রাবার কোম্পানি ও ওদের লোকজনের বিরুদ্ধে মামলা হবে। সপ্তাহ পারিয়ে গেল প্রায়। এখনো পর্যন্ত পুলিশ কোন ব্যবস্থা নেয়নি। গ্রেফতার হয়নি একজন দুর্বৃত্তও। ঘটনাস্থলে পুলিশ গেছে, স্থানীয় প্রশাসনের লোকজন গেছে, এমনকি মানবাধিকার কমিশনের হয়েও কারা যেন সেখানে পরিদর্শন করেছে। মামলা হয়নি, একটি লোকও গ্রেফতার হয়নি। এখন তো মনেই হচ্ছে যে না, স্থানীয় প্রশাসন আসলেই কোন ব্যবস্থা নিবে না। সামান্য আনুষ্ঠানিক যে প্রক্রিয়াটি, যে কারো ঘোর পুড়িয়ে দিলে একটি ঘরপোড়া মামলা হবে, সন্দেহভাজনদেরকে গ্রেফতার করা হবে সেগুলিও হয়নি।

(২)

দেখেন, এই ধরনের ক্ষেত্রে জমির মালিকানাটা অপ্রাসঙ্গিক। আপনি যদি একজনের ঘরে আগুন লাগিয়ে দেন, তাইলেই আপনি ঘরপোড়ার অপরাধ করলেন। ঘরটা কার জায়গায় বা জায়গার মালিক কে সেটা সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক। এইখানে দেখা যাচ্ছে ম্রোদের জমি, ম্রোদের ঘর, যারা আগুন লাগিয়েছে ওদের পরিচয়ও বলছে ভুক্তভুগিরা। তাইলে কেন অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলো না? কেউ আমাকে বলতে পারবেন যে এইখানে রারবার কোম্পানি ও ওদের লোকজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ার কি কারণ আছে? কি কারণ? আমি তো একটাই কারণ দেখি- প্রশাসন রাবার কোম্পানির পক্ষ নিয়ে ম্রোদেরক ওদের নিজ ভূমি থেকে উৎখাত করতে চাইছে। এছাড়া আর কোন কারণ আছে?

এর আগে গতবছরের এপ্রিল মাসে ম্রোদের সাড়ে তিনশ একর জায়গায় জুমের ফসল আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছে রাবার বাগানের লোকেরা। সকলে স্পষ্ট করে বলেছে কারা করেছে এই কাজ। ভুক্তভুগিরা বলেছে, কিন্তু প্রশাসন কোন ব্যবস্থা নেয়নি। সেখানকার ম্রোদের একমাত্র জলের উৎস একটি ঝিরি- সেই ঝিরির পানিতে বিশ মিশিয়ে দিয়েছে রাবার কোম্পানির লোকেরা। পুলিশ কোন ব্যবস্থা নেয়নি। মানবাধিকার কমিশন থেকে কি কি সব নাকি নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, সেগুলি ঘোড়ার ডিম কেউ পাত্তাও দেয়নি। ম্রোদেরকে মাউক কাটুক মেরে ফেলুক কারো যেন কিছু যায় আসে না। দেশে আইন দেশের সরকার দেশের পুলিশ কেউই ম্রোদের ন্যুনতম বেঁচে থাকার অধিকারটুকু রক্ষা করতে আগ্রহী নয়।

‘আদিবাসীদের ভূমির অধিকার’ কথাটা গুরুগম্ভীর শোনায় অনেকের কাছে। সেকথার ব্যাখ্যা বা তর্কে আজ গেলাম না। কিন্তু এর তো একটা মানবিক দিকও আছে। এই হতদরিদ্র ম্রোদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেবে, এই কনকনে শীতের রাতে মানুষগুলি খোলা আকাশের নিচে সর্বস্ব হারিয়ে কি অবস্থায় আছে একটু কল্পনা করুন। সামান্য কিছু কাপড় চোপড়, হাড়ি পাতিল আর পোষা পরশুপাখি সব হারিয়ে এরা কিভাবে জীবন ধরন করবে? ভেবেছেন একবার? এই যে বিশাল রাষ্ট্রযন্ত্র, এতো এর পুলিশ মিলিটারি বেসামরিক প্রশাসন এরা দেখছে, হয়তো ওরা জানেও কারা করেছে এই কাজ, এরা কিসসু করবে না? এটা কি ধরনের অবস্থা? এইটা আমদের রাষ্ট্র? এই আমাদের প্রশাসন? এই আমাদের রাষ্ট্র?

(৩)

ম্রো জনগোষ্ঠী মুরং নামেও পরিচিত। আমি যতটুকু জানি ম্রো আর মুরং এইসব কথার অর্থ হচ্ছে মানুষ- একবচন ও বহুবচন। কিন্তু ম্রোরা যে মানুষ সেকথা জানার জন্যে তো আপনার ম্রো ভাষা জানার দরকার নাই। ওরা তো মানুষ, আপনারা হয়তো ভুলে গেছেন, কিন্তু ওরা আসলেই মানুষ। এই দেশেরই মানুষ। আমাদের আইনে আমাদের সংবিধানে সকল বিধানে ওরা আমার মতোই একজন নাগরিক। ঐ যে সংবিধানের সপ্তম অনুচ্ছেদ দেখিয়ে আমরা বলি যে প্রজাতন্ত্রের মালিক জনগণ ইত্যাদি- ম্রোরাও জনগণই বটে, এই প্রজাতন্ত্রের মালিকদের মধ্যে ওরাও আছে। কেবলমাত্র জাতিগত ভিন্নতার কারণে যদি আমরা ওদের অধিকার হরণ করি, ওদের ন্যুনতম বেঁচে থাকার অধিকারটুকুও রক্ষা না করি এটা কি ধরনের কথা ভাই?

রাষ্ট্রের সরকার রাষ্ট্রের প্রশাসন এরা যখন ভুলকরে বা কোন অন্যায় করে তখন জনগণকে রুখে দাঁড়াতে হয়। এই রুখে দাঁড়ানোটা আইনগতভাবে রাজনৈতিকভাবে ও দার্শনিকভাবে ন্যায়। কেবল ন্যায় নয়, সেটা সকল নাগরিকের দায়িত্বও বটে। আপনি যদি আপনার এই নাগরিক দায়িত্ব পালন না করেন, আপনার একদল সহনাগরিকের অধিকার রক্ষায় এগিয়ে না আসেন তাইলে নাগরিক হিসাবে আপনি আপানর দায়িত্ব পালনে বিরত থাকলেন। আমি সেটাকে অনুবাদ করবো এইভাবে যে, আপনি শোষক ও নির্যাতকের পক্ষে তথা তস্করদের পক্ষে অবস্থান নিলেন। আমি তো এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করি, আপনি করবেন না?

*লেখাটি ইমতিয়াজ মাহমুদের ফেসবুক থেকে নেওয়া। গত দুই দিন আগে এই লেখাটি তিনি তাঁর ফেসবুক ওয়ালে পোস্ট করেছিলেন।

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More