মন্তব্য প্রতিবেদন
সাজেকবাসীকে অশিক্ষার অন্ধকারে রাখতেই কি স্কুল কলেজ নির্মাণে বাধা?
মন্তব্য প্রতিবেদন
আজ ১৬ ডিসেম্বর, বিজয় দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছিল। স্বাধীনতার সেই অর্জনের ৫৪ বছর পেরিয়ে গেলেও বাস্তবতা হলো, আজও দেশের সকল নাগরিক সেই স্বাধীনতার স্বাদ সমানভাবে ভোগ করতে পারছে না।
দেশের এক প্রান্তে যখন বিজয়ের আনন্দ আর উৎসবের আয়োজন চলছে, ঠিক তখনই রাঙামাটির সাজেক ইউনিয়নের মাজলঙের এগোজ্যাছড়িতে দেখা যাচ্ছে এক ভিন্ন বাস্তবতা। অভিযোগ উঠেছে, সেখানে বনবিভাগ কর্তৃক স্থানীয় জনগণের অর্থায়নে নির্মাণাধীন একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভেঙে দেওয়া হয়েছে। তার প্রতিবাদে জনগণ সেখানে সড়ক অবরোধ করেছেন। আরও বড় অভিযোগ, এই স্কুল ভাঙার কার্যক্রমে বনবিভাগকে সহায়তা করছে সেনাবাহিনী। এটি নিছক একটি স্কুল ভাঙার ঘটনা নয়, এটি সংবিধান প্রদত্ত একটি মৌলিক অধিকার এবং নাগরিক মর্যাদার ওপর সরাসরি আঘাত।

দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, আজ এই বিজয় দিবসেই সেই স্কুল প্রাঙ্গণে জাতীয় পতাকা উত্তোলিত হতে পারতো। শিশুরা লাল-সবুজের পতাকা হাতে নিয়ে স্বাধীনতার গল্প শুনতে পারতো। কিন্তু তার বদলে সেখানে নেমে এসেছে ভাঙচুর, প্রতিবাদ এবং শিশুদের শিক্ষাজীবনের অনিশ্চয়তা।
এক সময় গহীন অরণ্য সাফ করে স্থানীয় ভূমিপুত্র পাহাড়িদের উচ্ছেদ করে সাজেকে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে। কোনো মুসলিম জনগোষ্ঠী বসবাস না করলেও পর্যটকদের সুবিধার্থে সেখানে মডেল মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে। অথচ সাজেকবাসীর জন্য নেই পর্যাপ্ত হাসপাতাল, নেই শিশুদের শিক্ষালাভের উপযোগী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সারাদেশে যেখানে গড় সাক্ষরতার হার ৭৬ শতাংশ, সেখানে সাজেক ইউনিয়নে এই হার মাত্র ২৭ দশমিক ২ শতাংশ।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আরও একটি উদ্যোগের কথা জানিয়েছে, যেখানে পাহাড়ের বিশেষ বিশেষ এলাকায় ১০০টি বিদ্যালয়ে Starlink স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সংযোগ দেওয়া হবে, যাতে এসব প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমে অংশ নিতে পারে এবং অভিজ্ঞ শিক্ষকরা ডিজিটাল ক্লাসে শিক্ষাদান করতে পারেন। এটি এক ধরনের প্রযুক্তিগত যুগোপযোগী উদ্যোগ, যা শিক্ষায় সমতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে নেওয়া হয়েছে।
সরকারের এই উদ্যোগ প্রশংসনীয়। কিন্তু বাস্তবে স্কুলই যদি না থাকে, সেখানে এমন আধুনিক ডিজিটাল ব্যবস্থা কি কার্যকরভাবে শিশুদের শিক্ষা নিশ্চিত করতে পারবে? কিংবা শিশুদের শিক্ষাজীবনের এত অনিশ্চয়তার মধ্যে স্টারলিংক ইন্টারনেট ব্যবহার করে অনলাইন শিক্ষাও কতটা কার্যকর হবে?
এই বৈপরীত্য আমাদের নতুন করে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করায়। স্বাধীনতা কেবল একটি দিনের উৎসব নয়, স্বাধীনতা মানে ন্যায্যতা এবং সম্মানের নিশ্চয়তা। যতদিন দেশের কোনো জনগোষ্ঠী নিজেদের অধিকার রক্ষায় সড়কে দাঁড়াতে বাধ্য হবে, ততদিন স্বাধীনতার পূর্ণতা প্রশ্নবিদ্ধই থেকে যাবে।
বিজয় দিবসের এই দিনে সাজেকের অবরুদ্ধ সড়ক আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, পাহাড়ি জনগণের মুক্তির লড়াই এখনো শেষ হয়নি।

আরও একটি প্রশ্ন। সরকারের দায়িত্ব হলো সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করা। এটি নাগরিকদের একটি মৌলিক অধিকার। এই অধিকার নিশ্চিত করতে হলে সরকারকে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত এলাকায়ও স্কুল কলেজ নির্মাণ করতে হবে। কিন্তু যেখান জনগণ নিজেদের উদ্যোগে, নিজেদের কষ্টার্জিত টাকায় স্কুল কলেজ নির্মাণ করছে, সেখানে রাষ্ট্রের একটি শক্তিশালী বাহিনী তাতে বাধা দেয়ার কারণ কী? অজুহাত দেখানো হচ্ছে যে, বনবিভাগের জমিতে এসব স্কুল ও কলেজ নির্মাণ করা হচ্ছে। কিন্তু এলাকাবাসীর প্রশ্ন হলো, সাজেকের বনবিভাগের জমিতে যদি সেনা ক্যাম্প, পুলিশ ক্যাম্প, মসজিদ, পর্যটন স্থাপনা ইত্যাদি হতে পারে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণে বাধা কেন? কেবল পাহাড়িরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করতে চাইলে বনবিভাগ অতি তৎপর হয়, পুলিশ-সেনা ক্যাম্প ইত্যাদি নির্মাণের সময় বনবিভাগ ও সরকারের বন আইন কোথায় যায়?
জনগণের প্রশ্ন, সাজেকবাসীকে অশিক্ষার অন্ধকারে চিরকাল ডুবিয়ে রাখতে কী রাষ্ট্রীয় বাহিনী পরিকল্পিতভাবে বাধা দিচ্ছে? আশার কথা হলো, জনগণ এ বাধা, এ অন্যায় মেনে নিচ্ছে না। তারা তাদের ন্যায্য অধিকারের জন্য লড়াই করতে প্রস্তুত। সেজন্য তারা রাস্তায় নেমেছেন। আমরা তাদের ন্যায্য দাবি ও ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানাই।
(১৬ ডিসেম্বর ২০২৫)
সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।
