রাঙ্গামাটির কুদুকছড়িতে সংবাদ সম্মেলন

সাজেকে নাঈম হত্যা মামলা থেকে ইউপিডিএফ নেতা-কর্মীদের নাম বাদ দেয়াসহ ৬ দফা দাবি তিন সংগঠনের

0
রাঙ্গামাটির কুদুকছড়িতে তিন সংগঠনের সংবাদ সম্মেলন।

রাঙ্গামাটি প্রতিনিধি, সিএইচটি নিউজ
শনিবার, ২৯ জুন ২০২৪

রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেকে ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী কর্তৃক নাঈম হত্যা, খুনীদের রক্ষার চেষ্টা এবং উক্ত হত্যা মামলায় ষড়যন্ত্রমূলকভাবে ইউপিডিএফ ও সহযোগি সংগঠনের নেতাদের জড়িত করা বিষয়ে রাঙ্গামাটি সদর উপজেলার কুদুকছড়িতে সংবাদ সম্মেলন করেছে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম ও হিল উইমেন্স ফেডারেশন।

আজ শনিবার (২৯ জুন ২০২৪) দুপুর ১:০০ টায় অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলন থেকে ৬ দফা দাবি জানানো হয়েছে। দাবিগুলো হলো :

১) সাদা কাগজে নেয়া বাবুল ইসলামের সই ব্যবহার করে জালিয়াতি ও ষড়যন্ত্রমূলকভাবে সাজানো নাঈম হত্যা মামলা থেকে ইউপিডিএফের কেন্দ্রীয় নেতা সচিব চাকমাসহ পার্টি ও গণ ফ্রন্টভুক্ত নেতা কর্মীদের নাম বাদ দিতে হবে।

২) সন্ত্রাসী ধরার নামে সাজেকে চলমান তথাকথিত যৌথ অভিযানের নাটক বন্ধ করে নাঈম হত্যার সাথে জড়িত প্রকৃত খুনীদের গ্রেফতার ও বিচার করে শাস্তি দিতে হবে।

৩) প্রশাসন কর্তৃক ঠ্যাঙাড়ে সন্ত্রাসীদের মদত ও পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান বন্ধ করতে হবে এবং ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী ভেঙে দিতে হবে।

৪) সাজেকে জনপ্রতিনিধি, পাহাড়ি-বাঙালি ব্যবসায়ী ও সাধারণ জনগণকে ঠ্যাঙাড়েরা এখনও হুমকি দিয়ে যাচ্ছে; তা বন্ধ করতে হবে।

৫) বাঘাইহাট বাজারে পণ্য ক্রয়-বিক্রয় ও পরিবহণের ওপর সেনা কর্তৃপক্ষের অন্যায় হস্তক্ষেপ ও খবরদারি বন্ধ করতে হবে।

৬) বাঘাইহাটে সেটলার ও ব্যবসায়ীদের দিয়ে সাম্প্রদায়িক উস্কানি দেয়া বন্ধ করে এলাকাবাসীর শান্তিপূর্ণ সমাবেশ ও মত প্রকাশের অধিকার দিতে হবে।

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের রাঙ্গামাটি জেলা সভাপতি তনুময় চাকমা।

লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, গত ১৮ জুন রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলাধীন সাজেক ইউনিয়নের বাঘাইহাটে ঠ্যাঙাড়ে সন্ত্রাসীরা বিক্ষোভরত জনতার ওপর গুলি চালালে মোঃ নাঈম নামে শান্তি পরিবহনের এক কর্মচারী নিহত হন। যে এলাকায় ঘটনাটি ঘটে তা বাঘাইহাট জোনের একেবারে পাশে, মাত্র ১০০ থেকে ১২০ হাত দূরে। কিন্তু তারপরও ঘটনার আগে কিংবা পরে খুনী ঠ্যাঙাড়েদের গ্রেফতার করার কোন উদ্যোগ প্রশাসনের পক্ষ থেকে নেয়া হয়নি। বরং তাদেরকে খুনের ঘটনার পর নিরাপদে সরে যেতে দেয়া হয়েছে বা সরিয়ে নেয়া হয়েছে।

অপরদিকে খুনীদের গ্রেফতার ও বিচারের আওতায় নিয়ে আসার জন্য পদক্ষেপ নেয়া না হলেও, প্রশাসন নিহত মোঃ নাঈমের এক আত্মীয় মোঃ বাবুল ইসলামকে বাদী সাজিয়ে ইউপিডিএফ নেতা সচিব চাকমাসহ পার্টি ও তার সহযোগি গণ সংগঠনের ১৫ জন নেতার নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা অজ্ঞাত সংখ্যক ব্যক্তির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে মামলা দায়ের করে। বর্তমানে তাদেরকে গ্রেফতার করতে সাজেকে সেনাবাহিনী ও পুলিশ অভিযানে নেমেছে বলে জানা গেছে।

এখানে উল্লেখ করা দরকার যে, মোঃ বাবুল ইসলাম উক্ত মামলা বিষয়ে আদৌ জানতেন না, তিনি নাঈমের লাশ গ্রহণের জন্য দীঘিনালায় গেলে পুলিশ তাকে একটি সাদা কাগজে সই দিতে বাধ্য করে। তার ভাষ্য মতে, প্রথমে সই দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে পুলিশ তাকে জানায় যে, সই না দিলে নাঈমের লাশ হস্তান্তর করা হবে না, তখন তিনি অগত্যা উক্ত সাদা কাগজে সই করে দেন। এক ভিডিও বার্তায় তিনি জানান যে, কারা নাঈমকে হত্যা করেছে তা তিনি জানেন না। কাজেই তার বক্তব্য থেকে এটা স্পষ্ট যে, তিনি নিজে সচিব চাকমাসহ ইউপিডিএফের নেতাদের নামে মামলা করেননি।

নাঈম হত্যার প্রেক্ষাপট উল্লেখ করে সংবাদ সম্মেলনের লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, নাঈম হত্যার অবশ্যই একটি প্রেক্ষিত রয়েছে, যা আমাদের জানা দরকার। আপনাদের হয়তো স্মরণ আছে যে, গত ৯ জুন  বাঘাইছড়ি উপজেলা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। উক্ত নির্বাচনে অবৈধ প্রভাব খাটানোর জন্য নির্বাচনে জনৈক চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী ৭ জুন ৫০ জনের মতো ঠ্যাঙাড়ে সন্ত্রাসী বাঘাইহাটে নিয়ে আসেন। এ সময় ঠ্যাঙাড়েরা তার প্রতিপক্ষ প্রার্থীদের পোলিং এজেন্ট ও সাধারণ ভোটারদের হুমকি দিলে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা নষ্ট হয়ে যায়। এই অবস্থায় মাজলং নির্বাচন পরিচালনা কমিটি সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে ৮ জুন সাজেকে সড়ক ও নৌপথ অবরোধ করে। ইউপিডিএফ তাদের এই ন্যায্য দাবিতে ডাকা অবরোধে সমর্থন দেয়। কিন্তু প্রশাসন সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য ঠ্যাঙাড়েদের বিরুদ্ধে কোন প্রকার পদক্ষেপ না নিয়ে নির্বাচন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করে।

এরপরও ঠ্যাঙাড়ে সন্ত্রাসীরা অত্যাধুনিক স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রসহ বাঘাইহাট বাজারে অবস্থান করে সাধারণ নিরীহ লোকজনকে হয়রানি ও জুলুম করতে থাকে। তাদের অত্যাচারে সাজেকবাসীর স্বাভাবিক ব্যবসা-বাণিজ্য ও জীবন যাপন বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। জনগণ তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে প্রশাসনের কাছে বার বার দাবি জানালেও তাতে কোন কাজ হয়নি; প্রশাসন ছিল একেবারে নির্বিকার। ফলে সাধারণ পাহাড়ি ও বাঙালি জনসাধারণ চরমভাবে অতিষ্ঠ ও ক্ষুদ্ধ হয়ে ওঠে।

এই পুঞ্জিভূত ক্ষোভের বিষ্ফোরণ ঘটে ১৮ জুন। ঐদিন সকালে উজো বাজার ও মাজলং বাজারের ব্যবসায়ীরা বাঘাইহাট বাজার থেকে তাদের দোকানের জন্য মালামাল কিনে নিয়ে যাওয়ার সময় ঠ্যাঙাড়েরা বাধা দেয় এবং তাদের সকল মালামাল আটকিয়ে রাখে। শুধু তাই নয়, তারা ব্যবসায়ীদের সাথে চরম দুর্ব্যবহার করে ও কয়েকজন নারীকে মারধর করে। এই খবর এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে হাজার হাজার ক্ষুদ্ধ নারী পুরুষ রাস্তায় নেমে ও বাঘাইহাট বাজারে গিয়ে বিক্ষোভ করতে থাকে। এ সময় এক পর্যায়ে ঠ্যাঙাড়েরা বাঘাইহাট সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবনের দ্বিতীয় তলা থেকে গুলি চালালে মোঃ নাঈমের গায়ে লাগে।

লিখিত বক্তব্যে আরো বলা হয়, কোন সন্ত্রাসীর দিক থেকে সাধারণ জনগণের জানমালের নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন হলে তার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণের দায়িত্ব হলো সরকারের। কিন্তু বাঘাইছড়ির প্রশাসন সাজেকবাসীর জানমালের নিরাপত্তা দিতে কেবল ব্যর্থ হয়েছে তাই নয়, সত্যি বলতে প্রশাসনের কতিপয় প্রতিনিধিই এই নিরাপত্তা হুমকি সৃষ্টি হওয়ার জন্য দায়ি। স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে ঠ্যাঙাড়েদের বিরুদ্ধে যথাসময়ে পদক্ষেপ নেয়া হলে নাঈমের মতো কোন নিরীহ ব্যক্তির প্রাণহানি ঘটতো না।

কিন্তু দুঃখের কথা হলো, এত বড় ঘটনার পরও স্থানীয় প্রশাসন সাজেকের সাধারণ জনগণ, ইউপিডিএফ ও গণ সংগঠনগুলোর ওপর একের পর এক অন্যায় আচরণ করে যাচ্ছে। প্রকৃত খুনীদের বিরুদ্ধে মামলা না দিয়ে বরং তাদেরকে রক্ষা করে, উল্টো ইউপিডিএফ ও তার সহযোগি সংগঠনের নেতাদের নামে নাঈম হত্যার দায়ে মামলা দেয়ার বিষয়টি এমন এক জঘন্য অন্যায় যা কোনভাবে মেনে নেয়া যায় না। প্রশাসনের এই আচরণ বিএনপি সরকারের আমলের বহুল আলোচিত “জজ মিয়া নাটকের“ কথাই আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকায় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর গ্রেনেড হামলার ঘটনায় প্রকৃত অপরাধীদের রক্ষার জন্য সরকার সে সময় জজ মিয়া নামে এক ব্যক্তিকে ধরে মিথ্যা স্বীকারোক্তি আদায় করেছিল। বাঘাইছড়ির প্রশাসনও খুনী ঠ্যাঙাড়েদের আড়াল ও রক্ষা করতে ইউপিডিএফ নেতাদের বিরুদ্ধে বাবুল ইসলামের সই ব্যবহার করে প্রহসনমূলক মামলা দায়ের করেছে। এই মামলার কারণে সাজেকে সাধারণ জনগণের মধ্যে এখন গ্রেফতার আতঙ্ক বিরাজ করছে এবং লোকজন হাট বাজারে ও অফিস আদালতে যেতে ভয় পাচ্ছেন।

সংবাদ সম্মেলনে আরো উপস্থিত ছিলেন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের রাঙ্গামাটি জেলা শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক দিপায়ন চাকমা, গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের রাঙ্গামাটি জেলা সাধারণ সম্পাদক থুইনুমং মারমা ও সাংগঠনিক সম্পাদক প্রিয়তন চাকমা, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের রাঙ্গামাটি জেলা সভাপতি রিপনা চাকমা ও সাংগঠনিক সম্পাদক নিশি চাকমা।



This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More