সাজেকে সকল জাতিসত্তার সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ

সাজেক প্রতিনিধি, সিএইচটি নিউজ
সোমবার, ৩০ জুন ২০২৫
সকল জাতিসত্তার সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবিতে রাঙামাটির সাজেকে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে ইউপিডিএফ ও তার সহযোগী সংগঠনগুলো।
আজ সোমবার (৩০ জুন ২০২৫) সকাল ৯টা হতে ১১টা পর্যন্ত সাজেকের উজোবাজারে এ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশের আগে একটি মিছিল উজো বাজার থেকে শুরু হয়ে সড়ক প্রদক্ষিণ করে কাচলং আর্মি ক্যাম্প এলাকা ঘুরে একই স্থানে এসে সমাবেশে মিলিত হয়।
সমাবেশে বিভিন্ন এলাকা থেকে নানা শ্রেণি-পেশার লোকজন অংশগ্রহণ করেন।
বাঙালি জাতীয়তা চাপিয়ে দিয়ে সংবিধানের বিতর্কিত পঞ্চদশ সংশোধনী আইন পাসের ১৪তম বার্ষিকীতে ইউপিডিএফ, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম, হিল উইমেন্স ফেডারেশন ও পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘের যৌথ ব্যানারে এ বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করা হয়।
সমাবেশে ইউপিডিএফ সংগঠক রিয়েল চাকমার সভাপতিত্বে ও পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের বাঘাইছড়ি উপজেলা শাখার সভাপতি ইমন চাকমার সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের বাঘাইছড়ি উপজেলা সভাপতি শুক্র চাকমা, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের বাঘাইছড়ি উপজেলা সভাপতি সুখী চাকমা. পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘের বাঘাইছড়ি উপজেলা শাখা সভাপতি অমিতা চাকমা। এছাড়া সংহতি জানিয়ে উপস্থিত ছিলেন সাজেক কার্বারি এসোসিয়েশনের সভাপতি নতুন জয় চাকমা ও বাবুধন চাকমা।

ইউপিডিএফ সংগঠক রিয়েল চাকমা বলেন, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আমারও আন্দোলন করেছি, নানাভাবে সাহায্যে সহযোগিতা করেছি। কিন্তু সে সময় পাকিস্তানিরা যেভাবে এদেশের জনগণের ওপর নিপীড়ন-নির্যাতন, হত্যাযজ্ঞ চালয়েছিল, ঠিক একই কায়দায় স্বাধীন বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠি পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়িদের উপর নিপীড়ন-নির্যাতন, ভূমি বেদখল নারী ধর্ষণ, গণহত্যা চালাচ্ছে। একটি স্বাধীন দেশে সকল জাতিসত্তার মানুষের সাংবিধানিক স্বীকৃতি থাকার কথা, সেখানে আমাদেরকে অধিকার ও স্বীকৃতি না দিয়ে দমন-পীড়ন চালানো হচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আওয়ামী লীগ ১৯৭২ সালে রচিত সংবিধানে অন্যান্য জাতিগুলোকেও বাঙালি বানিয়েছিল। একইভাবে ২০১১ সালের ৩০ জুন ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার সরকার সংবিধানের বিতর্কিত পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশের জাতিসত্তাগুলোর ওপর পূনরায় বাঙালি জাতীয়তা চাপিয়ে দিয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামকে সেনাবাহিনী কারাগারে পরিণত করেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা জানি যে, ১৯৯৬ সালে সেনা কর্মকর্তা লে: ফেরদৌস গংরা কীভাবে রাতের আঁধারে নারী নেত্রী কল্পনা চাকমাকে অপহরণ করেছিল, কীভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে ডজনের অধিক বড় আকারের গণহত্যা সংঘটিত করেছিল। এখনো সেনাবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িদের ওপর অন্যায় দমন-পীড়ন, খুন-গুম চালিয়ে যাচ্ছে।

তিনি বলেন, আমরা আশা করেছিলাম চব্বিশের ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের পর পার্বত্য চট্টগ্রামে কিছুটা হলেও শান্তি প্রতিষ্ঠা হবে। কিন্তু উল্টোটাই আমরা দেখতে পাচ্ছি। এখন ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের চেয়েও শাসন-শোষন, দমন-পীড়ন বৃদ্ধি করা হয়েছে।
তিনি বিতর্কিত পঞ্চদশ সংশোধনী সম্পূর্ণ বাতিলপূর্বক পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশের সকল জাতিসত্তার সাংবিধানক স্বীকৃতি এবং পার্বত্য চট্টগ্রামকে বিশেষ স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল ঘোষণার দাবি জানান।
সমাবেশে সংহতি জানিয়ে নতুন জয় চাকমা বলেন, আমরা জানি পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও আমাদের মতো সংখ্যালঘু জাতিসত্তা রয়েছে, তারা স্বাধীনভাবে বসবাস করছে। কিন্তু আমরা কেন স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রে পরাধীনতা শৃঙ্খলে বসবাস করব, আমরাও পার্বত্য চট্টগ্রামে স্বায়ত্তশাসন চাই।
তিনি বলেন, আমরা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে স্বাধীন হওয়ার পর স্বাধীন দেশে শান্তিতে বসবাস করতে পারবো বলে আশা করেছিলাম। কিন্তু তা হয়নি। আমাদের সাথে বার বার প্রতারণা করা হয়েছে, নিপীড়ন-নির্যাতন চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাই আমাদের যতক্ষন পর্যন্ত অধিকার আদায় না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত আন্দোলন সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। রাষ্ট্রযন্ত্রের সকল নীলনক্সা রুখে দিতে রাজপথে অবিচল থাকতে হবে।

বাবুধন চাকমা বলেন, ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নকালে তৎকালীন সংসদ সদস্য আব্দুর রাজ্জাক ভুইঁয়ার সংবিধান বাঙালি জাতীয়তাবাদ অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাবের বিরুদ্ধে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা সংসদ থেকে ওয়াকআউট করে প্রতিবাদ করেছিলেন।
তিনি আরো বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে আমাদের পাহাড়ি জাতিসত্তাগুলোর ওপর দীর্ঘদিন যুগ যুগ ধরে শাসন-শোষণ চলছে। আমাদেরকে নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদ করা লক্ষ্যে ভূমি বেদখল, নারী নির্যাতনের ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে। সাম্প্রতিক সময়ে সাজেকে কলেজ নির্মাণের বাধা দেয়া হচ্ছে। তাই জাতির অস্তিত্ব ও স্বভূমি রক্ষায় এবং রাষ্ট্রের সকল ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সবাইকে আন্দোলনে এগিয়ে আসতে হবে।
সুখী চাকমা বলেন, ২০১১ সালে আজকের এই দিনে হাসিনা সরকার পঞ্চদশ সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশের সকল সংখ্যালঘু জাতিসত্তাগুলোর ওপর বাঙালি জাতীয়তা চাপিয়ে দেয়। কিন্তু আমরা জাতিগতভাবে বাঙালি নয়, আমরা এই বাঙালি জাতীয়তা মানি না, কখনোই মানব না। আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমা, মার্মা, ত্রিপুরা, বম, খেয়াং, মুরং, লুসাই, পাংখোয়াসহ যেসব জাতিসত্তাগুলো রয়েছি স্ব স্ব পরিচয়ে সাংবিধানিক স্বীকৃতি চাই।
তিনি আরও বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িদের উপর প্রতিনিয়ত দমন-পীড়ন চালানো হচ্ছে। পাহাড়ি মা-বোনদের নির্যাতন করা হচ্ছে। আজকের সমাবেশ থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে অন্যায় দমনপীড়ন বন্ধ ও সংঘটিত নারী ধর্ষণ-হত্যার বিচার চাই। সংবিধানে সকল জাতিসত্তার স্বীকৃতির দাবি জানাই।
ইমন চাকমা বলেন, ৭২ সালে সংবিধান পুনঃপ্রবর্তনের কথা বলে ২০১১ সালে পূনরায় সংবিধানে বাঙালি জাতীয়তাবাদ অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশের সকল সংখ্যালঘু জাতিগুলোকে বাঙালি বানানো হয়েছে। যে সংবিধান বাঙালি বানায় সে সংবিধান আমরা মানতে পারি না। সকল জাতিসত্তার স্ব স্ব পরিচয়ে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে হবে।
সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।