সাজেকে সেনা-সেটলার হামলার ৫ বছর: শাস্তি হয়নি দোষীদের, চলছে নানা ষড়যন্ত্র

0

বিশেষ প্রতিবেদন, সিএইচটিনিউজ.কম
Sajek hamla photoআজ ১৯ ফেব্রুয়ারী সাজেকে সেনা-সেটলার হামলার ৫ বছর। ২০১০ সালের ১৯ – ২০ ফেব্রুয়ারী সেনাবাহিনীর কতিপয় সদস্য ও বাঙালি সেটলাররা যৌথভাবে রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক ইউনিয়নে পাহাড়িদের উপর এই বর্বরোচিত হামলা চালায়। এতে বুদ্ধপুদি চাকমা ও লক্ষ্মী বিজয় চাকমা নিহত হন এবং ২টি বৌদ্ধ বিহার ও ৩টি গীর্জাসহ ১১টি গ্রামের পাহাড়িদের পাঁচ শতাধিক ঘরবাড়ি পুড়ে ছাই করে দেওয়া হয়। এছাড়া শিশুতলি গ্রামের বাসিন্দা রূপন চাকমাকে গুম করা হয়। এটা ছিল সাজেকের ২য় হামলা। এর আগে ২০০৮ সালেও সাজেকে পাহাড়িদের কয়েকটি গ্রামের হামলা চালিয়ে ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।

সাজেকে হামলার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল পাহাড়িদের ভূমি বেদখল করে সেখানে বাঙালি জনবসতি গড়ে তোলা। মূলতঃ বিএনপি-জামাত জোট সরকারের সময় সাজেক থেকে পাহাড়িদের বিতাড়ন করে বাঙালি সেটলারদের কলোনী গড়ে তোলার ষড়যন্ত্র শুরু হয়। পরে ২০০৭ – ২০০৮ সালে সেনানিয়ন্ত্রিত জরুরী অবস্থার সময় উক্ত ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। বাঘাইহাট সেনা জোন এই ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নে উঠেপড়ে লেগে যায়। বিভিন্ন এলাকা থেকে সেটলারদের নিয়ে সাজেকে পুনর্বাসন করা হয়। পরে ২০০৮ সালের ২০ এপ্রিল সেনাবাহিনী ও সেটলাররা পাহাড়িদের গ্রামে হামলা চালায়। তারা ৪টি গ্রামের ৭৭টি বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। সে সময় পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশনের সদস্যরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। কিন্তু তারা ফিরে যেতে না যেতেই সেটলাররা সেনাবাহিনীর সহায়তায় ৯ আগষ্ট আবার গঙ্গারাম দোরের ৪টি বাড়িতে হামলা ও লুটপাট চালায়। এরপর ১৯ আগষ্ট সেটলাররা অপর এক হামলায় রেতকাবা গ্রামের লাদুমনি চাকমাকে কুপিয়ে খুন করে।

সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহত লক্ষ্মী বিজয় চাকমা। ফাইল ছবি।
সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহত লক্ষ্মী বিজয় চাকমা। ফাইল ছবি।

সাজেক এলাকা থেকে পাহাড়ি উচ্ছেদ ও বাঙালি পুনর্বাসনের উদ্দেশ্যে চালানো এই হামলার বিরুদ্ধে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশে বিদেশে ব্যাপক নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। কিন্তু হামলার ৫ বছর অতিক্রান্ত হলেও শাস্তি হয়নি হামলায় জড়িত সেনা-সেটলারদের। উপরন্তু সাজেককে নিয়ে আবারো নানা ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে।

উজো বাজার ধ্বংসের চক্রান্ত:
সাজেকে জোরপূর্বক পাহাড়ি বসতি উচ্ছেদ করে বাঙালি কলোনী গড়ে তোলার চক্রান্ত ও হামলার  প্রতিবাদে সাজেকের ব্যাপক গণ প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ভূমি বেদখল বিরোধী আন্দোলনের প্রক্রিয়ায় গঙ্গারাম দোরে উজো বাজার গড়ে তোলা হয়। এই উজো বাজার সাজেকের জনগণের সংগ্রামের এক মূর্ত প্রতীক। উজো একটি চাকমা শব্দ, যা যুদ্ধে বা সংগ্রামে রণধ্বনি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। পার্বত্য  চট্টগ্রামের আন্দোলনের ইতিহাসে উজো বাজারের এক বিশেষ তাৎপর্য আছে বলেই সরকার ও সেনাবাহিনী এ বাজারকে ধ্বংস করার জন্য শুরু থেকেই উঠেপড়ে লেগে যায়। তারা ভয়ভীতি, হুমকি ইত্যাদির মাধ্যমে বাজারটি বন্ধ করে দিতে ব্যর্থ হলে কিছু চিহ্নিত ব্যক্তিস্বার্থান্বেষী পাহাড়িকে দিয়ে তাদের উদ্দেশ্য হাসিলের অপচেষ্টা চালায়। এরা বাঘাইহাট বাজার বয়কট তুলে নিয়ে উজো বাজার বন্ধ করার জন্য সাজেকের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের উপর চাপ দেয় এবং বিভিন্ন অপপ্রচারে লিপ্ত হয়। কিন্তু সাজেকবাসীর ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের মুখে তাদের সে চেষ্টাও ব্যর্থ হয় এবং উজো বাজার দ্রুত একটি পরিপূর্ণ বাজারে রূপ নেয়। বর্তমানে সাজেকবাসীর ঐক্যের প্রতীক উজো বাজার একটি বর্ধিষ্ণু বাজারে পরিণত হয়েছে। কিন্তু দীর্ঘদিন নীরব থাকার পর ষড়যন্ত্রকারীরা ইদানিং আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। তারা নির্বাচনে বাঙালি ভোটের লোভসহ বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে পাহাড়িদের অতি ক্ষুদ্র স্বার্থবাদী একটি মহলকে উজো বাজার ধ্বংসের জন্য ব্যবহার করতে চাইছে।
এদিকে, গত ১১ ফেব্রুয়ারি উজো বাজার রক্ষার লক্ষ্যে একটি গণ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সম্মেলনে উজো বাজার রক্ষা ও দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত বাঘাইহাট বাজার বয়কট অব্যাহত রাখার গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহণ করা হয়। সাজেক এলাকার প্রত্যেকটি গ্রাম থেকে প্রতিনিধিরা এই সম্মেলনে অংশ নেন। তারা যে কোন মূল্যে উজো বাজার রক্ষার সংকল্প ব্যক্ত করেছেন।

সাজেক জনগণের প্রতিবাদ
সাজেক জনগণের প্রতিবাদ। ফাইল ছবি

বর্তমান অবস্থা:
সাজেকবাসী যাতে মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে সেজন্য সরকার ও সেনাবাহিনী এখনো বিভিন্ন অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। সাজেকবাসীর দ্বিমত সত্ত্বেও মাচলং বাজারে পুলিশের থানা স্থাপন করা হয়েছে। সাজেকবাসীর অভিযোগ, ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনকে দমন করা ও নিরীহ পাহাড়িদের উপর অত্যাচার চালানোর উদ্দেশ্যে এই থানা স্থাপন করা হয়েছে। অন্যদিকে, স্থানীয় প্রশাসন উজো বাজারের পাশে একটি বুদ্ধমূর্তি স্থাপনে বাধা দিয়েছে। সেখানে এখন নিয়মিত পুলিশ পোষ্ট বসানো হয়েছে।

এছাড়া গঙ্গারাম দোরে বিজিবি’র ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তর স্থাপনের নামে জমি অধিগ্রহণ করে পাহাড়ি উচ্ছেদের ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে বলেও সাজেকের জনগণ অভিযোগ করেছেন।

গত মাসে (জানুয়ারি) বাঘাইহাট জোনের সেনা সদস্যরা বাইবা ছড়ায় এলাকাবাসীর স্বেচ্ছাশ্রমে নির্মিত দুইটি কাঠের ব্রিজ ভেঙে দেয়। এর ফলে শত শত গ্রামবাসীকে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। রুইলুই মোনে পর্যটন কেন্দ্র স্থাপনের নামে সেখান থেকে পাহাড়িদের উচ্ছেদের ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে ওই এলাকা থেকে বেশ কয়েকটি ত্রিপুরা পরিবার উচ্ছেদ হয়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়েছে বলে জানা গেছে।

এই পরিস্থিতিতে সাজেকের জনগণকে আর চুপ করে বসে থাকার কোন অবস্থা নেই। সকলে একতাবদ্ধ হয়ে সরকারের এসব ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সাজেকবাসীকেই গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
————————

সিএইচটিনিউজ.কম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More