সাজেকে হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সমাবেশ ও প্রতিবাদী নৃত্যনাট্য

0

সাজেক প্রতিনিধি, সিএইচটি নিউজ
মঙ্গলবার, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

৮ই মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের ৩৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে রাঙামাটির সাজেকে সমাবেশ ও প্রতিবাদী নৃত্যনাট্য কর্মসূচির আয়োজন করে হিল উইমেন্স ফেডারেশন বাঘাইছড়ি উপজেলা শাখা।

সমাবেশের ব্যানার শ্লোগান ও আহ্বান ছিল “জান দেবো, তবুও মান দেবো না, সারাদেশে অব্যাহত নারী শিশু ধর্ষণ বন্ধ কর; পার্বত্য চট্টগ্রামে জাতীয় অস্তিত্ব, বাস্তুভিটা ও নারীর সম্ভ্রম রক্ষার্থে এইচডব্লিউএফ’র পতাকাতলে সমবেত হোন”

আজ মঙ্গলবার (৪ মার্চ ২০২৫) ভোর থেকে সাজেক ও বঙ্গলতলী ইউপির  বিভিন্ন এলাকা থেকে সহস্রাধিক নারী লাদুমুনি বাজার দ্ব-পদায় এসে মিলিত হন। সকাল ৯:৩০ টায় দ্ব-পদা মাঠে সমাবেশ শুরু হয়ে সকাল ১১টা পর্যন্ত চলে।

সমাবেশ শেষে নানা শ্লোগানের মধ্য দিয়ে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়। মিছিলটি পর্যটন সড়ক ধরে দীর্ঘ ১ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে এসে উজোবাজার প্রদক্ষিণ করে গঙ্গারাম মুখ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে গিয়ে শেষ হয়। সেখানে প্রতিরোধ সাংস্কৃতিক স্কোয়াডের টিম ঘন্টাব্যাপী প্রতিবাদী নৃত্যনাট্য ও জাগরণীমূলক গান পরিবেশন করে।  

সমাবেশে হিল উইমেন্স ফেডারেশন বাঘাইছড়ি উপজেলা শাখার সহ-সভাপতি সুখী চাকমা’র সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক নন্দা চাকমা’র সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন, হিল উইমেন্স ফেডারেশন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য রিপনা চাকমা, গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের সাজেক থানা শাখার সভাপতি নিউটন চাকমা, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের বাঘাইছড়ি উপজেলা শাখার সভাপতি পলেন চাকমা, পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘের কেন্দ্রীয় সদস্য উজ্জ্বলা চাকমা। এছাড়া এতে সংহতি জানিয়ে বক্তব্য রাখেন সাজেক গণঅধিকার রক্ষা কমিটির সদস্য সচিব বাবু ধন চাকমা ও ছাত্র জনতার সংগ্রাম পরিষদের উপদেষ্টা কমিটির সদস্য নতুন জয় চাকমা। এতে সাজেক ও বঙ্গলতলী ইউপির জনপ্রতিনিধিরাও উপস্থিত ছিলেন।

সমাবেশে হিল উউমেন্স ফেডারেশনের নেত্রী রিপনা চাকমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে শুধু মা-বোনেরা অনিরাপদ তা নয়, আমাদের বাপ-ভাইদেরও কোন নিরাপত্তা নেই। আমাদের বাপ-ভাইদের মিথ্যা মামলা দিয়ে জেলে অন্তরীণ করা হচ্ছে, বিচার বহির্ভুত হত্যা করা হচ্ছে।

তিনি আরো বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি জনগণের বিশেষ করে পাহাড়ি নারীদের নিরাপত্তার সবচেয়ে বড় হুমকি হচ্ছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও সেটলাররা। সেজন্য আমাদের দাবি হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সেনা-সেটলারদের প্রত্যাহার করা।

তিনি পাহাড়ি নারীদের উদ্দেশ্যে বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের নারীরা কেবল ফ্যাশন নির্ভর নয়, শুধু সাজগোজ করে থাকা নয়, রাজপথে লড়াই সংগ্রামের মাধ্যমে নারীদের নিরাপত্তা তথা স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার জন্য আমাদের লড়াই সংগ্রাম করতে হবে।

সাজেকের নারীদের আন্দোলনে অবদানের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, আমরা জানি এখানকার উজোবাজারের ইতিহাস, বুদ্ধপূদিদের আত্মবলিদানের ইতিহাস। আমরা জানি সেনাবাহিনী কর্তৃক হিল উইমেন্স ফেডারেশনের নেত্রী কল্পনা চাকমা অপহরণের ঘটনা।

তিনি বলেন, আওয়ামী লীগসহ কোন সরকার যেমন পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোর কোন বিচার করেনি, একইভাবে বর্তমান ইউনুস সরকারেরও এসব ঘটনার বিচারের কোন উদ্যোগ আমরা দেখছি না।

রিপনা চাকমা প্রশ্ন রেখে বলেন, জুলাই-আগস্টের শিক্ষার্থী-জনতার অভ্যুত্থানের পর দেশে নতুন স্বাধীনতার কথা বলা হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোর কেন বিচার হচ্ছে না? তিনি বলেন, ইউনুস সরকার যদি মনে করে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকার থেকে তার সরকার আলাদা তাহলে তাঁকে পার্বত্য চট্টগ্রামে এ যাবত সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোর বিচার অবশ্যই করতে হবে।

তিনি বলেন, জাতিগতভাবে আমাদের এখনো সাংবিধানিক স্বীকৃতি নেই। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে আমাদেরকে বাঙালি বানানো হয়েছে। এখনো সংবিধানে তা বহাল রাখা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে অতীতে বহু গণহত্যা, নারী ধর্ষণ, নিপীড়ন-নির্যাতন, ভূমি বেদখল সংঘটিত হয়েছে, এখনো তা চলমান রয়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ লড়াই করতে শিখেছে উল্লেখ করে রিপনা চাকমা বলেন, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারও যদি অতীতের সরকারগুলোর মতো পার্বত্য চট্টগ্রামে অন্যায়-অবিচার জারি রাখতে চায় তাহলে জনগণ লড়াই সংগ্রামের মাধ্যমে তা মোকাবেলা করবে।

তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামে অভিযানের নামে, নিরাপত্তার নামে সেনাবাহিনীর চলমান দমন-পীড়ন অবিলম্বে বন্ধের দাবি জানান। একই সাথে তিনি পাহাড় ও সমতলে নারী ধর্ষণসহ অন্যায়-অবিচার চলছে তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার জন্য সকলের প্রতি আহ্বান জানান।

নারী নেত্রী উজ্জ্বলা চাকমা আন্তর্জাতিক নারী দিবস ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের গঠন নিয়ে সংক্ষিপ্তাকারে তুলে ধরেন। তিনি বলেন, সংবিধানে নারী অধিকারের কথা বলা হলেও তার কোন কার্যকারিতা নেই। নারীরা প্রতিনিয়ত ধর্ষণ, নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। ১৯৯৬ সালের ১২ জুন সেনাবাহিনীর লে. ফেরদৌস কর্তৃক কল্পনা চাকমাকে অপহরণের ঘটনার বিচার আমরা এখনো পাইনি।

তিনি নারীদের জেগে উঠার আহ্বান জানিয়ে বলেন, আমাদের নারীদের জাগ্রত হতে হবে। শুধু পারিবারিক কাজে নয়, রাজপথের আন্দোলনেও নারীদের এগিয়ে আসতে হবে। রাজনৈতিকভাবে সচেতন হতে হবে।  সাজেকের ভূমি রক্ষার্থে তিনি নারীদের অগ্রণী ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান।

যুব নেতা নিউটন চাকমা বলেন, আজকের এই সমাবেশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যুগে যুগে, দেশে দেশে জনগণ বিপ্লব সংগঠিত করে সফল হয়েছেন। আজকে তারা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। আমরাও যদি সকল মা-বোন, বাপ-ভাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলন গড়ে তুলতে পারি তাহলে নিশ্চয় অধিকার আদায় করতে পারবো।

তিনি আরো বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে দীর্ঘ সময় ধরে নারী ধর্ষণ, খুন-গুমসহ নানা নিপীড়ন-নির্যাতন চাল আসছে। ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতনের পরে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসলেও, দেশে ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ বলা হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামে নিপীড়ন-নির্যাতন এখনো চলমান রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের ওপর দমন-পীড়ন, হয়রানি, গ্রেফতার অব্যাহত রয়েছে। তাই এসব অন্যায়-অবিচারে বিরুদ্ধে আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে সোচ্চার হতে হবে, রুখে দাঁড়াতে হবে।

বাবুধন চাকমা বলেন, অধিকার এমনিতে পাওয়া যায় না। অধিকার কেউ কাউকে খুশি করে দেয় না। অধিকার টাকা দিয়ে কিনেও পাওয়া যায় না। কঠোর সংগ্রামের মাধ্যমে অধিকার অর্জন করতে হয়। তাই অধিকার প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত আমাদের কঠোর-কঠিন সংগ্রাম ও কষ্ট করতে হবে।

তিনি আরো বলেন, রাজনৈতিক অধিকার না থাকলে শুধু নারী অধিকার নয়, কোন অধিকারই থাকে না। তিনি বলেন, ২০০৮ সালে এখানে লাদুমনি চাকমাকে সেটলার বাঙালিরা হত্যা করেছিল।

সাজেকে নারী নির্যাতন, অন্যায় দমনপীড়ন, ভূমি বেদখল চেষ্টা থেমে নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, ২০১০ সালে জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়ে সাজেককে রক্ষা করেছিল বলেই আজকে এখানে আমরা সমাবেশ করতে পারছি, এখনো বসবাস করতে পারছি, ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারছি। সাজেক রক্ষায় জনগণ যেভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সংগ্রাম করেছিল, ঠিক সেভাবে জাতিকে রক্ষা করার জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। তিনি অধিকার প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত লড়াই সংগ্রামে অবিচল থাকতে সকলের প্রতি আহ্বান জানান।

নতুন জয় চাকমা বলেন, একটি জাতির জন্য নারীরা অনেক অবদান রাখতে পারে। জাতিকে টিকে থাকার জন্য নারীদের আন্দোলনে অংশগ্রহণ ও ভূমিকা পালন করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমেই আমাদের টিকে থাকতে হবে। রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদের লড়াই-সংগ্রাম করতে হবে।

তিনি আরো বলেন, গত ৫ ফেব্রুয়ারি সাজেকের লক্ষীছড়িতে এক প্রতিবন্ধী নারীকে সেনা কর্মকর্তা কর্তৃক নিন্দনীয় ধর্ষণের চেষ্টার ঘটনা ঘটেছিল। ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা বন্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলনে সামিল হতে তিনি সকলের প্রতি আহ্বান জানান।

পিসিপি নেতা পলেন চাকমা বলেন, সাজেকের নারীরা রাজপথে লড়াই সংগ্রামে কখনো পিছে নেই। গত ৫ ফেব্রুয়ারি গঙ্গারাম লক্ষীছড়ি সেনা ক্যাম্প কমান্ডার কর্তৃক এক প্রতিবন্ধি নারীকে ধর্ষণ চেষ্টার বিরুদ্ধে সাজেক নারীরা ঘটনার বিচার দাবিতে রাজপথে নেমে আবারো সে দৃষ্টান্ত রেখেছেন। সাজেক নারী সমাজের সাহসি আন্দোলন শুধু সাজেক রক্ষায় নয়, সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সারাদেশে আন্দোলনের এক দৃষ্টান্ত স্হাপন করে চলেছে। তিনি অধিকার প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা অব্যাহত রাখার আহ্বান জানান।

সভাপতির বক্তব্যে সুখী চাকমা ৮ দফা দাবি তুলে ধরেন। দাবিগুলো হলো:

১. সারাদেশে অব্যাহত নারী শিশু ধর্ষণ বন্ধ কর!
২. অন্যায়ভাবে ভূমি বেদখলের পাঁয়তারা বন্ধ কর!
৩. পাহাড় ও সমতলে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত কর!
৪. পার্বত্য চট্টগ্রামের নারী নিরাপত্তার প্রধান হুমকি সেনা-সেটলার সরিয়ে নাও!
৫. কল্পনা চাকমার চিহ্নিত অপহরণকারী লে. ফেরদৌস গংদের বিচার কর!
৬. ১৯-২০ সেপ্টেম্বরে সাম্প্রদায়িক হামলায় শহীদ জুনান-রুবেল-অনিক-ধনঞ্জয়দের হত্যাকারী সেনা-সেটলারদের যথোপযুক্ত শাস্তি দিন।
৭. সেনাবাহিনীর যৌথ অভিযানের নামে নিরীহ পাহাড়িদের হয়রানি, গ্রেফতার বন্ধ কর!
৮. বান্দরবানে বম জনগোষ্ঠীর ওপর বর্বরোচিত গণহত্যা ও ম্রোদের ভূমি বেদখলের পাঁয়তারা বন্ধ করে তাদের ন্যায্য অধিকার দিতে হবে।



This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More