সেনাবাহিনীর বিবৃতি মিথ্যাচার ও নিজেদের কৃত অপরাধ আড়ালের ব্যর্থ চেষ্টা: ইউপিডিএফ

0


খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি, সিএইচটি নিউজ
সোমবার, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫

খাগড়াছড়ি ও গুইমারায় ২৭ ও ২৮ সেপ্টেম্বর তারিখে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা সম্পর্কে” সেনাবাহিনীর দেয়া বিবৃতিকে ‘মিথ্যার বেসাতি ও নিজেদের অপরাধ আড়াল করার ব্যর্থ চেষ্টা’ বলে প্রত্যাখ্যান করেছেন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)-এর মুখপাত্র অংগ্য মারমা।

আজ সোমবার (২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫) সংবাদ মাধ্যমে দেয়া এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, “বাংলাদেশ সেনাবাহিনী খাগড়াছড়ি ও গুইমারায় হামলা সম্পর্কে দেশবাসীকে যেভাবে মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা চালিয়েছে, তাতে পাহাড়ের চলমান পরিস্থিতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে এবং হামলাকারীদের উৎসাহিত করবে।”

খাগড়াছড়ি ও গুইমারায় পাহাড়িদের ওপর সাম্প্রদায়িক হামলা, খুন, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের জন্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর খাগড়াছড়ি ও গুইমারা রিজিয়নের দুই ব্রিগেড কমান্ডার, তাদের পোষ্যপুত্র ঠ্যাঙাড়ে ‘মোত্তালেব বাহিনী’ ও উগ্র ধর্মান্ধ সেটলারদের দায়ী করে তিনি বলেন, “সিঙ্গিনালায় মারমা কিশোরী ধর্ষণের বিচারের দাবিতে চলমান গণআন্দোলনকে বাধাগ্রস্ত এবং ধর্ষকদের রক্ষা করতে পরিকল্পিতভাবে সেটলারদের লেলিয়ে দিয়ে পাহাড়িদের ওপর সাম্প্রদায়িক হামলা চালানো হয়েছে।”

ঘটনা পরম্পরা তুলে ধরে অংগ্য মারমা বলেন, “গত ২৩ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ি শহরের উপকণ্ঠ সিঙ্গিনালায় অস্টম শ্রেণী পড়ুয়া এক মারমা কিশোরী গণধর্ষণের শিকার হন। তার প্রতিবাদে ‘জুম্ম ছাত্র জনতার’ ব্যানারে সাধারণ জনগণ ২৪ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ি শহরে সমাবেশের আয়োজন করে এবং এই সমাবেশ থেকে ৩ দফা কর্মসূচি ঘোষণা দেয়। কর্মসূচিগুলো হলো পরদিন (অর্থাৎ ২৫ সেপ্টেম্বর) অর্ধদিবস খাগড়াছড়িতে সড়ক অবরোধ, ২৬ সেপ্টেম্বর মহাসমাবেশ এবং ২৫-২৭ সেপ্টেম্বর স্কুল-কলেজে ক্লাশ বর্জন, যা সফলভাবে পালিত হয়।

“২৫ সেপ্টেম্বর আধাবেলা সড়ক অবরোধ কর্মসূচি সফল হলে রাত সাড়ে আটটায় সেনাবাহিনীর সদস্যরা ‘জুম্ম ছাত্র জনতার’ নেতা উক্যনু মারমাকে অপদস্থ করে টেনে হেঁচড়ে গাড়িতে তুলে খাগড়াছড়ি সেনা জোন সদর দপ্তরে নিয়ে যায়। তার প্রতিবাদে শহরবাসী তাৎক্ষণিকভাবে রাস্তায় নামলে সেনাবাহিনী দু’ঘন্টা পর রাত সাড়ে দশটার দিকে তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।

“২৬ সেপ্টেম্বর শহরের চেঙ্গী স্কোয়ারে অনুষ্ঠিত মহাসমাবেশ থেকে পরদিন ২৭ সেপ্টেম্বরের জন্য জেলাব্যাপী পূর্ণ দিবস সড়ক অবরোধের ডাক দেয়া হয়।

“২৭ সেপ্টেম্বরের অবরোধ বানচালের হীনউদ্দেশ্যে কতিপয় উগ্র সাম্প্রদায়িক সেটলারদের মাঠে নামিয়ে দেয়া হলে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বদলে যায়। তারা প্রথমে খেজুরবাগান এলাকায় গায়ে পড়ে অবরোধকারীদের সাথে ঝগড়া বাঁধানোর চেষ্টা করে। তবে তাতে সফল না হলে সেটলাররা বিপুল সংখ্যক সেনাবাহিনীর উপস্থিতিতে মহাজন পাড়া ও য়ংড বৌদ্ধ বিহার এলাকায় সাম্প্রদায়িক হামলা চালায়। য়ংড বৌদ্ধ বিহার এলাকায় তারা নৃশংসভাবে কুপিয়ে ৩ পাহাড়িকে মারাত্মকভাবে জখম করে। সেটলাররা খোদ য়ংড বৌদ্ধ বিহারে হামলা করতে চাইলে জনৈক সেনা সদস্য অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে সেটলারদের নিবৃত্ত করেন, যা আমাদেরও দৃষ্টি আকৃষ্ট করেছে। তার শৃঙ্খলা ও পেশাদারি দায়িত্ববোধকে আমরা সম্মান জানাই। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, এটি অত্যন্ত বিরল ও ব্যতিক্রমী ঘটনা। উক্ত সেনা সদস্যের মতো যদি বাকিরাও প্রকৃত পেশাদারি সৈনিকের মতো নিরপেক্ষতা বজায় রাখতেন, তাহলে পাহাড়িরা সেটলারদের সাম্প্রদায়িক হামলা থেকে রক্ষা পেত।”

পার্বত্য চট্টগ্রামে মোতায়েনকৃত সেনাবাহিনীর অব্যাহতভাবে পাহাড়ি বিদ্বেষী, সাম্প্রদায়িক মনোভাব, পক্ষপাতমূলক আচরণ ও সেটলারদের প্ররোচিত করে পাহাড়িদের ওপর উগ্র সাম্প্রদায়িক হামলার প্রেক্ষিতে ‘জুম্ম ছাত্র জনতা’ ২৮ সেপ্টেম্বর থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য পুনরায় সড়ক অবরোধ ঘোষণা করতে বাধ্য হয় বলে অংগ্য মারমা মন্তব্য করেন।

তিনি বলেন, “গতকাল ২৮ সেপ্টেম্বর সকালে অবরোধ চলাকালে সেনাবাহিনীর সদস্যরা পেরাছড়া ও ভাইবোনছড়ার বিভিন্ন গ্রামে অভিযান চালিয়ে স্কুল ছাত্রসহ তিন জনকে আটক ও একজন পল্লী চিকিৎসক, একজন সরকারি কলেজের প্রভাষকসহ বেশ কয়েকজনকে মারধর করে।

“এরপর দুপুর ১২টার দিকে গুইমারা উপজেলায় মারমা অধ্যুষিত রামেসু বাজারে সেনাবাহিনী, তাদের পোষ্যপুত্র ঠ্যাঙাড়ে ‘মোত্তালেব বাহিনী’এবং উগ্রবাদী সেটলাররা মিলিতভাবে পাহাড়িদের ওপর বিনা উস্কানিতে হামলা চালায়। সেনা জওয়ান ও ঠ্যাঙাড়ে দুর্বৃত্তরা নির্বিচারে তাদের ওপর গুলি চালায়, অপরদিকে সেটলাররা দোকানপাট ও বসতবাড়িতে ব্যাপক লুটপাট চালানোর পর আগুন ধরিয়ে দেয়। হামলায় গুলিবিদ্ধ হয়ে অন্তত ৩ জন পাহাড়ি নিহত হয়েছে বলে খাগড়াছড়ি প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিশ্চিত করা হয়েছে। নিহতরা হলেন ১) থোয়াইচিং মারমা (২৫) পিতার নাম হ্লাচাই মারমা, গ্রাম বটতলা পাড়া, হাফছড়ি, গুইমারা, তিনি পেশায় একজন ড্রাইভার; ২) আখ্র মারমা (২৪) পিতার আপ্রু মারমা, গ্রাম সাইংগুলি পাড়া, বড়পিলাক, গুইমারা; এবং ৩) আথুইপ্রু মারমা (২৬) পিতার নাম থোয়াইহ্লাঅং মারমা, গ্রাম লিচু বাগান, হাফছড়ি, গুইমারা। এছাড়া কয়েকজন গুরুতর আহতসহ অন্তত ৩০ জন পাহাড়ি আহত হয়েছেন। হামলাকারী সেটলাররা পাহাড়িদের অন্তত ১৬টি বসতবাড়ি, ৫০টি দোকান, মাহেন্দ্র গাড়ি ১টি ও ১৬টি মোটর সাইকেল আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে।

“সেনাবাহিনী তাদের বিবৃতিতে দাবি করে ইউপিডিএফ রামেসু বাজারের পশ্চিম দিকে অবস্থিত উঁচু পাহাড় থেকে ‘সংঘর্ষে লিপ্ত পাহাড়ি, বাঙালি এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যস্ত সেনা সদস্যদের লক্ষ্য করে’ গুলি চালায়, যা সর্বৈব মিথ্যা – কান্ডজ্ঞানসম্পন্ন কেউ এই ধরনের আজগুবি বক্তব্যে বিশ্বাস স্থাপন করবে না।

“সেনাবাহিনীর বিবৃতিতে আরও বলা হয়: সমসাময়িক সময়ে রামসু বাজার এবং ঘরবাড়িতে ইউপিডিএফএর বহিরাগত দুষ্কৃতিকারীরা অগ্নিসংযোগ করে এবং বাঙালিদের সাথে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ায় লিপ্ত হয়।”

সেনাবাহিনীর এই বক্তব্যকে দুর্বল চিন্তাশক্তির অধিকারী ব্যক্তির ‘আষাঢ়ে গল্প’ ফাঁদার অপপ্রয়াস অভিহিত করে অংগ্য মারমা প্রশ্ন করে বলেন, “যখন ‘ইউপিডিএফের বহিরাগত দুষ্কৃতিকারীরা’ অগ্নিসংযোগ করছিল তখন আমাদের ’দেশপ্রেমিক’ সেনাবাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও কি নাকে তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছিলেন?’ তাদের নাকের ডগায় কিভাবে ’ইউপিডিএফ সদস্যরা’ বাড়িতে আগুন দেয়ার সময় ও সাহস পায়? আর ইউপিডিএফ সদস্যরা গুলি করার পূর্বেই যদি পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষ শুরু হয়ে থাকে, তাহলে তখন সেনা সদস্যরা কী করছিল?”

অংগ্য মারমা বলেন, “যারা অগ্নিসংযোগ করেছিল তারা আসলে ‘ইউপিডিএফের কেউ নয়, তারা হলো দাঙ্গা বাঁধানোর উদ্দেশ্যে সেনাদের নিয়োজিত কতিপয় সেটলার দুর্বৃত্ত, এবং প্রত্যক্ষ সেনা প্ররোচনা ও সহায়তায় তারা মারমাদের দোকান ও বাড়িঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করেছিল।”

তিনি খাগড়াছড়িতে চলমান অশান্ত ও বিক্ষুব্ধ পরিস্থিতি এবং পাহাড়িদের ওপর সাম্প্রদায়িক হামলার জন্য উগ্রবাদী সেটলারদের প্রতি সেনাবাহিনীর খাগড়াছড়ি ও গুইমারা ব্রিগডের ন্যাক্কারজনক উলঙ্গ পক্ষপাতিত্ব ও পাহাড়ি বিদ্বেষকে দায়ি করেন এবং অবিলম্বে এই দুই ব্রিগেড কমান্ডারকে প্রত্যাহারের পরামর্শ দেন।

ইউপিডিএফ নেতা পরিস্থিতি উত্তরণের জন্য সরকারের কাছে নিম্নোক্ত পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানান:

১) খাগড়াছড়ি ও গুইমারায় পাহাড়িদের ওপর সংঘটিত সাম্প্রদায়িক হামলা তদন্তের জন্য জাতিসংঘের অংশগ্রহণে একটি উচ্চ পর্যায়ের বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা।

২) সিঙ্গিনালায় কিশোরীকে গণধর্ষণের সাথে জড়িতদের গ্রেফতার এবং দ্রুত বিচার আদালতে বিচারের মাধ্যমে সাজা প্রদান করা।

৩) গুইমারায় রামেসু বাজারে হামলায় জড়িত সেনা সদস্য, ঠ্যাঙাড়ে ‘মোত্তালেব বাহিনীর’ সদস্য এবং সেটলারদের গ্রেফতার ও শাস্তি প্রদান করা।

৪) উক্ত হামলায় নিহত ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারবর্গকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ এবং আহতদের দ্রুত সুচিকিৎসার বন্দোবস্ত করা।

৫) খাগড়াছড়ির মহাজনপাড়া ও য়ংড বৌদ্ধ বিহার এলাকায় হামলাকারী সেটলারদের গ্রেফতার এবং শাস্তি প্রদান করা। উক্ত হামলায় ক্ষতিগ্রস্তদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা।

৬) গ্রেফতারকৃতদের অবিলম্বে ও নিঃশর্তে মুক্তি দেয়া।

৭) জুম্ম ছাত্র জনতার নেতা-কর্মী সহ সাধারণ লোকজনের বাড়িতে নির্বিচারে তল্লাশি, হয়রানি ও গ্রেফতার না করার নিশ্চয়তা প্রদান করা।

৮) প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পাহাড়ি বিদ্বেষী অপপ্রচার বন্ধ করা।

অংগ্য মারমা গতকাল ২৮ সেপ্টেম্বর বিকালে বিজিবির কাপ্তাই ব্যাটালিয়নের চেকপোস্টে ইউপিডিএফের বিপুল পরিমাণ দেশীয় অস্ত্র (রাম দা) উদ্ধারের যে দাবি সেনাবাহিনীর উক্ত বিবৃতিতে করা হয়েছে তা ভিত্তিহীন ও ষড়যন্ত্রমূলক অপপ্রচার বলে মন্তব্য করেছেন।

এছাড়া গত বছর ১৯ ও ২০ সেপ্টেম্বর দীঘিনালা, খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি শহরে পাহাড়িদের দোকানপাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বসতবাড়িতে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনাকে সেনাবাহিনীর উপরোক্ত বিবৃতিতে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে বলে মন্তব্য করে তিনি আরও বলেন, “এসব ঘটনায় ইউপিডিএফকে দায়ি করা হলো দিনকে রাত বা সাদাকে কালো বলে প্রচার করার সামিল।”

অংগ্য মারমা বলেন, ২০২৪ সালের হামলার তদন্ত হলেও তার রিপোর্ট চাপা দেয়ায় এবং অপরাধীদের বিচার ও শাস্তি না হওয়ায় সেনাবাহিনীর সদস্য ও উগ্রপন্থী সেটলাররা খাগড়াছড়ি শহরে ও গুইমারার রামেসু বাজারে পুনরায় হামলা করার সাহস পেয়েছে।

“মোট কথা, মুষ্টিমেয় কিছু ব্যতিক্রম বাদে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়োজিত নিরাপত্তা বাহিনীর কমান্ডার ও সদস্যরা সেটলারদের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট, পাহাড়ি বিদ্বেষী ও সাম্প্রদায়িক। এ কারণে তাদের দ্বারা এ অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়” বলে অংগ্য মারমা মন্তব্য করেন।

তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে উক্ত বিবৃতি প্রত্যাহার এবং খাগড়াছড়ি ও গুইমারায় হামলার সাথে জড়িত সেনা সদস্যদের শাস্তি প্রদানের দাবি জানান।



This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More