সেনা নির্যাতনে ছাত্রনেতা রমেল চাকমা’র মৃত্যুর ৬ বছর আজ

0

স্টাফ রিপোর্টার, সিএইচটি নিউজ
বুধবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৩

রমেল চাকমা। #ফাইল ছবি

আজ ১৯ এপ্রিল ২০২৩ সেনাবাহিনীর নির্মম নির্যাতনে রাঙামাটির নান্যাচর কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী ও পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি) নেতা রমেল চাকমা’র মৃত্যুর ৬ বছর পূর্ণ হলো। ২০১৭ সালের এই দিনে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। এর আগে ৫ এপ্রিল’১৭ সকালে সেনাবাহিনীর সদস্যরা তাকে বিনা কারণে আটক করে ক্যাম্পে নিয়ে নির্মম নির্যাতন চালানোর পর গুরুতর আহত অবস্থায় উক্ত হাসপাতালে ভর্তি করেছিল।

মৃত্যুর পরদিন ২০ এপ্রিল’১৭ হাসপাতাল থেকে বাড়িতে তাঁর লাশ নিয়ে আসার সময় পথিমধ্যে বুড়িঘাট বাজারের বোটঘাট থেকে সেনাবাহিনীর সদস্যরা লাশটি ছিনতাই করে নিয়ে পরদিন (২১ এপ্রিল) কোন প্রকার সামাজিক রীতিনীতি ছাড়াই পেট্রোল ঢেলে লাশটি পুড়িয়ে ফেলে।

সেনা নির্যাতনে এই কলেজ ছাত্রের মৃত্যু ও তাঁর লাশ পেট্রোল ঢেলে পুড়িয়ে ফেলার ঘটনায় দেশে-বিদেশে নিন্দা-প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। পার্বত্য চট্টগ্রাম সহ দেশে-বিদেশে ব্যাপক বিক্ষোভ সংগঠিত হয়। কিন্তু বিচারের বাণী যেন নিভৃতে কাঁদে। ছয় বছরেও এই ঘটনার কোন বিচার হলো না!

রমেল চাকমা ছিলেন নান্যাচর কলেজের একজন ছাত্র ও পিসিপি’র নান্যাচর থানা শাখার সাধারণ সম্পাদক। আংশিক দৃষ্টি প্রতিবন্ধী (ডান চোখে দেখতে পেতেন না) এই ছাত্র নান্যাচর কলেজ থেকে তখন এইচএসসি পরীক্ষা দিচ্ছিলেন। নান্যাচর সদর থেকে তার গ্রামের দূরত্ব প্রায় ১২ কিলোমিটার। তাই তিনি পরীক্ষার সুবিধার্থে নান্যাচর উপজেলা সদরে একটি বাসা ভাড়া নিয়ে সেখান থেকেই সে নিয়মিত পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছিলেন।

সেদিন (৫ এপ্রিল ২০১৭) তারিখে পরীক্ষা না থাকায় তিনি নান্যাচর বাজারে (সাপ্তাহিক হাটবার ছিল) গিয়েছিলেন তরিতরকারি ও প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে। বাজার থেকে জিনিসপত্র কিনে ফিরছিলেন বাসার উদ্দেশ্যে। তখন আনুমানিক সকাল ১০টা। তাঁকে ঘিরে ধরলো হায়েনারূপী একদল সেনা সদস্য। এরপর তাঁকে মারতে মারতে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গেলো তাদের আস্তানা নান্যাচর সেনা জোনে। সেখানে নিয়ে যাওয়ার পর তাঁর উপর চালানো হলো মধ্যযুগীয় বর্বর নির্যাতন। যে যেভাবে পারে তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে তাকে আঘাত করলো। এতে তিনি গুরুতর অসুস্থ ও অজ্ঞান হয়ে পড়েন।

এরপর সন্ধ্যার দিকে সেনারা বিনা চিকিৎসায় তাঁকে নিয়ে আসে থানায় হস্তান্তর করতে। কিন্তু তাঁর (রমেলের) শারীরিক অবস্থা বেগতিক দেখে থানা কর্তৃপক্ষ তাঁকে গ্রহণ করেনি। সেনারা অসুস্থ রমেলকে নিয়ে যায় উপজেলা হাসপাতালে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও তাঁর অবস্থা দেখে ভর্তি করেনি। কারণ তাঁর অবস্থা ছিল মুমুর্ষ। এরপর সেদিন রাতেই সেনারা নিজেরা রমেলকে নিয়ে যায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে তাদের নজরদারি ও পুলিশের পাহারায় যেনতেনভাবে চিকিৎসা চলতে থাকে। এভাবে দুই সপ্তাহ ধরে চলে চিকিৎসা। তাঁর অবস্থা দিন দিন অবনতি হতে থাকে। 

নির্যাতনের ফলে রমেল চাকমার কিডনি অকেজো হয়ে গিয়েছিলো। ফলে সর্বশেষ তাকে কিডনি চিকিৎসা করানো হয়। কিডনি রোগ বিভাগের ১৮নং ওয়ার্ডেই ১৯ এপ্রিল’১৭ দুপুরে তিনি মারা যান।

রমেল চাকমার পিতা কান্তি চাকমা ছেলেকে আটকের পর অমানুষিক নির্যাতনের বিচার চেয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানের নিকট একটি লিখিত আবেদন জানিয়েছিলেন। এতে তিনি তার ছেলের জীবন সংকটাবস্থার কথা তুলে ধরেছিলেন। কিন্তু মানবাধিকার কমিশন এ বিষয়ে কোন প্রকার পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।

অভিযোগ রয়েছে নান্যাচর সেনা জোনের তৎসময়ের জোন কমাণ্ডার বাহালুল আলম ও রাঙামাটি রিজিয়নের জি-টু মেজর তানভীর-এর নেতৃত্বে ও তাদের নির্দেশে সেনা সদস্যরা সেদিন রমেল চাকমাকে বেপরোয়াভাবে নির্যাতন চালিয়েছে। তাদের বর্বর নির্যাতনের কারণেই রমেল চাকমা’র এই অকাল মৃত্যু হয়েছে।

রমেল চাকমার মৃত্যুর পরও সেনাবাহিনী ক্ষান্ত থাকেনি। তারা শেষ পর্যন্ত রমেল চাকমার লাশটিও ছিনতাই করেছিলো। পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজনকে রমেলের মরা মুখটিও দেখতে দেয়নি। সামাজিক রীতি-রেওয়াজ তোয়াক্কা না করে, পরিবারের সদস্যদের উপস্থিতি ছাড়াই নিজেদের মতো করে পেট্রোল ঢেলে দিয়ে পুড়িয়ে ফেলেছিল লাশটি। এর চেয়ে নির্মম, নিষ্ঠুর আর কী হতে পারে?

রমেল চাকমা’র মৃত্যু কোন স্বাভাবিক মৃত্যু ছিল না। সেনাবাহিনীর নির্মম নির্যাতনেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে। তাঁর শরীরের নানা স্থানে ছিল আঘাতের অসংখ্য ক্ষত চিহ্ন। কাজেই এটা হত্যা ছাড়া আর কিছুই নয়। 

সরকারের উচিত যেসব সেনা কর্মকর্তা ও সদস্যের বিরুদ্ধে রমেল চাকমাকে বর্বর নির্যাতন করে হত্যা ও লাশ ছিনতাই করে পেট্রোল ঢেলে পুড়িয়ে ফেলার অভিযোগ রয়েছে, যথাযথ তদন্ত সাপেক্ষে তাদেরকে বিচারের আওতায় এনে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেওয়া।


সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।


সিএইচটি নিউজের ইউটিউব চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব করুন

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More