স্বায়ত্তশাসন চাইলে বিচ্ছিন্নতাবাদী হয়ে যায় না : মাইকেল চাকমা

0

রাবি প্রতিনিধি, সিএইচটি নিউজ
শুক্রবার, ১ আগস্ট ২০২৫

কোনো অঞ্চলের স্বায়ত্তশাসন চাইলে তারা বিচ্ছিন্নতাবাদী হয়ে যায় না বলে মন্তব্য করেছেন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) সংগঠক মাইকেল চাকমা।

তিনি বলেছেন, ‘আমরা সামরিক বাহিনীর নির্যাতন নিরসনে স্বায়ত্তশাসন চেয়েছিলাম। তখন থেকে আমাদের বিচ্ছিন্নতাবাদী ট্যাগ দেওয়া হচ্ছে।’

শুক্রবার (১ আগস্ট ২০২৫) রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থানের এক বছর: পাহাড়-সমতলের জাতিসত্তাসমূহের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি’ শীর্ষক আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিন্স কমপ্লেক্সের সম্মেলন কক্ষে আলোচনা সভাটি আয়োজন করে বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি) রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা।

সভায় বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি)-রাবি শাখার সাধারণ সম্পাদক শামিন ত্রিপুরার সভাপতিত্বে ও তথ্য প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক মিশুক চাকমার সঞ্চালনায় সভায় আরও বক্তব্য রাখেন পিসিপি কেন্দ্রীয় সভাপতি অমল ত্রিপুরা, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী রাবি শাখার সাবেক সভাপতি প্রদীপ মার্ডি, ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক গোলাম সরোয়ার সুজন, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের রাবি সংসদের সভাপতি রাকিব হোসেন, ছাত্র গণমঞ্চের রাবি শাখার আহ্বায়ক নাসিম সরকার, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের রাবি শাখার আহ্বায়ক আজাদ ইসলাম, রাষ্ট্র চিন্তার সদস্য কৌশিক দাস।


অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সমালোচনা করে মাইকেল চাকমা বলেন, ‘সমতলে ফ্যাসিবাদের নানান চিহ্ন মুছে দেওয়ার অন্তত চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু পাহাড়ের সামরিক শাসনের অবসান ঘটেনি। এমনকি হাসিনা আমলের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ১১ দফা গোপন নির্দেশনা এখনও বহাল রাখা হয়েছে।’

পাহাড়িদের ২৪’র কোনো প্রত্যাশা বাস্তবায়ন হয়নি দাবি করে তিনি বলেন, আমাদের প্রত্যাশা ছিলো, ‘২৪’র অভ্যূথানের পরে আমাদের অনেক আশা বাস্তবায়ন হবে। কারণ এই সরকারের উপদেষ্টারা মানবাধিকার নিয়ে কাজ করেছেন। প্রধান উপদেষ্টা নিজেই নোবেল বিজয়ী। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে আমাদের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি শূন্য। এখনো পাহাড়ে সেনা বাহিনীর গুলিতে মানুষ মারা যায়। এক বছর আগে জুনান চাকমা, রুবেল ত্রিপুরাকে সেনাবাহিনী গুলি করে মারে। এ ঘটনায় একজন উপদেষ্টা সেখানে সফরেও যান এবং বিচারের বিষয়ে আশ্বস্ত করেন। তবে এক বছর হলেও সে তদন্ত কমিটির ফলাফল প্রকাশ করা হয়নি। মানবাধিকার লঙ্ঘন এখনও অব্যাহত রয়েছে।’

পাহাড়ে সেনা শাসনের বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ‘পাহাড়ে অস্ত্র উদ্ধার মানেই নাটকের মঞ্চায়ন। এখানে সামরিক শক্তি ধারাবাহিকভাবে এই নাটক মঞ্চায়ন করে। মানুষের মনস্তাত্ত্বিক চিন্তাধারায় পাহাড়িদের সম্পর্কে নেতিবাচকতা ছড়িয়ে দিতে তারা আগেই পরিকল্পনা করে এই কাজ করে।’

তিনি বলেন, পাহাড়ের সেনাশাসন বহাল রেখে কিংবা বাংলাদেশে প্রকৃত গণতন্ত্র ছাড়া একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।

মাইকেল চাকমা আরো বলেন, ১৮৬০ সালে ১ আগস্ট পার্বত্য চট্টগ্রামকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য অন্তর্ভুক্ত করে ঔপনিবেশিক শাসন প্রবর্তন করেছিল। পাকিস্তান আমল পরবর্তী বাংলাদেশ স্বাধীনতা পর শেখ মুজিব বাঙালি হয়ে যাওয়ার কথা বলেছিলেন, জিয়াউর রহমান পার্বত্য চট্টগ্রামে সামরিকায়ন এবং জনতাত্ত্বিক পরিবর্তনের লক্ষে পরিকল্পিতভাবে সমতল থেকে ছিন্নমূল বাঙালিদের সরকারিভাবে অবৈধ অনুপ্রবেশ করিয়েছিলেন। এই রাষ্ট্র আমাদের প্রত্যাশার বিপরীতে আধিপত্যবাদ বিস্তার করেছে এবং ঔপনিবেশিক মনস্তত্ত্ব নিয়ে শাসন করছে।

তিনি বলেন, সন্তু লারমা ও সরকার পার্বত্য চুক্তিকে ঝুলিয়ে রাখতে চায় নিজেদের স্বার্থে। ফলে ২৭ বছরেও পার্বত্য চুক্তি পূর্ণ বাস্তবায়ন হয়নি।

সভায় বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী রাবি শাখার সাবেক সভাপতি প্রদীপ মার্ডি বলেন, ‘পাহাড়িদের প্রাপ্তির প্রশ্নটা ৫০ বছরে প্রশ্ন হয়েই থেকছে। রাষ্ট্রের ক্ষমতার পরিবর্তন হলেও তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি। কোনো রাজনৈতিক দল, প্রতিষ্ঠান কেউ-ই বহু জাতিত্ব স্বীকার করেনি। বাংলাদেশ বহুজাতির হলে রাষ্ট্রব্যবস্থায়ও তার উপস্থিতি থাকতে হবে। রাষ্ট্রকাঠামোতেও আমরা চাই আদিবাসিদের সম্মানজনক অন্তর্ভুক্তি। তারা নিজেদেও ‘আদিবাসি’ বা অন্য কিছু বলে ডাকবে সে স্বাধীনতা তাদেরকেই দিতে হবে।’

বক্তব্য রাখছেন সহযোগী অধ্যাপক গোলাম সরোয়ার সুজন। 

ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক গোলাম সরোয়ার সুজন বলেন, ‘এ দেশে বারবার পাহাড়িদের অধিকার সংকুচিত করা হয়েছে। আদিবাসীরা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে প্রথম বিরোধীতা শুরু করেছে। এর ধারাবাহিকতায় ৬৯, ৭১, ২৪’র গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রামে তারা উল্লেখযোগ্য ভুমিকা পালন করেছে। কিন্তু তাদেও প্রাপ্তির জায়গা হচ্ছে, শূন্য। উত্তরবঙ্গে দেখা যায় আদিবাসীরা ভুমি হারাচ্ছে, দখলদারিত্বের শিকার হয়ে উচ্ছেদ হয়ে যাচ্ছে। ক্ষমতাবানরা ড্রয়িংরুমের সোফা, আসবাবপত্র বানাতে পাহাড়ের গাছ কেটে আনছে, কোটিপতিরা রাবার বাগান দখল দিচ্ছে। এতে আদিবাসীরা তাদের সম্পদ ও অধিকার হারাচ্ছে। ২৪-এ যে সুযোগ তৈরী হয়েছিল পূর্বের মতোই এবারেও তা বেহাত হয়ে যাচ্ছে।’

বক্তব্য রাখছেন ছাত্রনেতা অমল ত্রিপুরা।

ছাত্রনেতা অমল ত্রিপুরা বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশে নাগরিকদের, বিশেষ করে তরুণ ছাত্র সমাজের মধ্যে একটি দ্রোহের, বিদ্রোহের এবং প্রতিবাদ, প্রতিরোধের ছিল। রাজপথে হাজারের অধিক মানুষের রক্তঝরা জুলাইকে নিয়ে তরুণদের মাঝে এখনো আবেগ, অনুভুতি জড়িয়ে আছে। অতীতে ৫২ ভাষা আন্দোলন, ৬২ শিক্ষার আন্দোলন, ৭৯ গণঅভ্যুত্থান,  ৭১ মুক্তিযুদ্ধ, ৯০ স্বৈরাচার এরশাদ পতনের আন্দোলন যেভাবে পূর্ব বাংলা ও পরবর্তী বাংলাদেশে জনগণেকে সাহস শক্তি অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল, ঠিক সেভাবে ২০২৪ সালে জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানও আমাদের তরুণ প্রজন্ম ও ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে এক সাহসের প্রতীক হিসেবে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের এক আলোর পথ দেখাবে।

তিনি আরো বলেন, এদেশের মানুষ একটি স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা নিয়ে জুলাই-আগস্টে রক্ত দিয়েছিল, আত্মত্যাগ করেছিল। প্রত্যেকটি মানুষের দাবি ছিল দীর্ঘ পনের বছরে আওয়ামী লীগের দুঃশাসন অবসান ঘটিয়ে নাগরিকের বৈষম্য দূর করে একটি সুষ্ঠু, সুন্দর সমাজ বিনির্মাণ এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পরবর্তী বাংলাদেশের মানুষের, নারী-শিশু, সকল জাতি, ধর্ম, বর্ণ, সম্প্রদায় সর্বোপরি জনসধারণের সে স্বপ্ন, আশা আকাঙ্ক্ষা সরকার বাস্তবায়ন করতে পারেনি।  

পাহাড়ে পরিস্থিতি তুলে ধরে অমল ত্রিপুরা বলেন, ’২৪ গণঅভ্যুত্থান পরে পার্বত্য চট্টগ্রাম এক ভয়ানক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল, এখনো তা চলমান রয়েছে। সেনাশাসনে ফলে পাহাড়িদের আজ এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি মধ্যে দিয়ে চলতে হচ্ছে, সেখানে ন্যূনতম গণতান্ত্রিক পরিবেশ নেই।

তিনি বলেন, আমাদের লড়াই শেষ হয়নি, লড়াই চলছে। পাহাড়-সমতলে সকল জাতিসত্তা, নারী, কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি জনতার আবরো ঐক্যবদ্ধ হয়ে সামনে দিনে লড়াই আরো সুদৃঢ় করতে হবে।

আলোচনা সভায় বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী রাবি শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক আলিফ শাহরিয়ার, বিপ্লবী ছাত্র-যুব আন্দোলনের রাবি শাখার আহ্বায়ক তারেক আশরাফ, আদিবাসী স্টুডেন্ট এসোসিয়েশন অব রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাহী সাধারণ সম্পাদক প্রিন্স হেমন্ত টুডু ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পাহাড়ি শিক্ষার্থীরা উপস্থিত ছিলেন।



This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More