ইতিহাস
১০ ফেব্রুয়ারি : এই দিনে পার্বত্য চট্টগ্রামে যা ঘটেছিল
১০ ফেব্রুয়ারি দিনটি পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসে একটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ দিন। এ দিনটিতে রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রথম ১৪৪ ধারা অমান্য করে প্রতিবাদ, জনসংহতি সমিতির অস্ত্রসমর্পণ ও পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের ব্যানার প্রদর্শনের মতো ঘটনা।

পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রথম ১৪৪ ধারা অমান্য করে প্রতিবাদ
১৯৯৪ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন বিএনপি সরকারের অন্যায় ১৪৪ ধারা অমান্য করে বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি) প্রতিবাদের এক মাইল ফলক স্থাপন করেছিল। এটি ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রথম ১৪৪ ধারা লঙ্ঘন করে প্রতিবাদ। সেদিন পুলিশ লাঠিপেটা-টিয়ারশেল নিক্ষেপ করেও আন্দোলন স্তব্ধ করে দিতে পারেনি। পিসিপি’র প্রতিবাদী অবস্থানের কারণে সে সময় বিএনপি সরকার পিছু হটতে বাধ্য হয়। আন্দোলনের ফলে জনগণের ওপর অন্যায় দমন-পীড়ন অনেকাংশে শিথিল হয়েছিল।
পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রথম ১৪৪ ধারা অমান্য করে প্রতিবাদের এ ঘটনাটি গণতান্ত্রিক লড়াই সংগ্রামে নিয়োজিত কর্মীদের নিকট কঠিন সময়ে সাহস সঞ্চার, অনুপ্রেরণা লাভ ও উজ্জীবিত হবার উৎস হয়ে রয়েছে।
জনসংহতি সমিতির অস্ত্রসমর্পণ
১৯৯৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে এক জাকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানে জনসংহতি সমিতির প্রধান সন্তু লারমার নেতৃত্বে শান্তিবাহিনীর ৭৩৯ জন্য সদস্যের প্রথম দলটি অস্ত্রসমর্পণ করেন। ব্যাপক নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে এই অস্ত্রসমর্পণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো বিটিভিতে অনুষ্ঠানটি লাইভ সম্প্রচার করা হয়। জনসংহতি সমিতির প্রধান সন্তু লারমা নিজের একে ৪৭ রাইফেলটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে তুলে দিয়ে অস্ত্র সমর্পণ অনুষ্ঠান সূচনা করেন। শেখ হাসিনা তাকে একটি সাদা গোলাপ উপহার দেন। এরপর একে একে শান্তিবাহিনীর আরও ৭৩৮ জন সদস্য নিজেদের অস্ত্র-গোলাবারুদ সমর্পণ করেন।
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সরকার ও জনসংহতি সমিতির মধ্যেকার স্বাক্ষরিত চুক্তির আওতায় এই অস্ত্রসমর্পণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

সেদিন দীর্ঘক্ষণ ধরে শান্তিবাহিনী সদস্যদের প্রখর রৌদ্রে অশোভনভাবে স্টেডিয়ামের মাঝখানে বসিয়ে রেখে এক প্রকার অপদস্থ করা হয়।
জেএসএস-এর এই অস্ত্রসমর্পণের মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্ম জনগণের ঘামমিশ্রিত আন্দোলনের একটি অধ্যায়ের যবনিকাপাত ঘটে। আর সন্তু লারমার সমর্পিত সেই একে ৪৭ রাইফেলটি প্রদর্শনীর বস্তু হিসেবে স্থান পায় জাতীয় জাদুঘরে।

অস্ত্রসমর্পণ অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা তার বক্তব্যে সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা দিয়ে বলেছিলেন, ‘পার্বত্য জেলা তিনটিতে ডিসি, এসপি থাকবেন, থাকবেন পূর্বের ন্যায় সকল কর্মকর্তা-কর্মচারী, বাঙালিরা যেমন আছেন তেমনি থাকবেন, গুচ্ছগ্রামবাসীরাও স্বভূমিতে থাকবেন’।
সেদিন তিনি আরও বলেছিলেন, ‘আমি আবারো দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলতে চাই- পার্বত্য এলাকায় পাহাড়ি, বাঙালি সবাই থাকবেন। কোন বাঙালিকে বলপূর্বক প্রত্যাহার করা হবে না’।
তবে অনুষ্ঠানে সন্তু লারমাকে বক্তব্য প্রদানের কোন সুযোগ দেওয়া হয়নি।
পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের ব্যানার প্রদর্শন
১৯৯৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে রাষ্ট্রীয় নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা বেস্টনির মধ্যে চলছিলো সন্তু লারমার নেতৃত্বে শান্তিবাহিনী সদস্যদের অস্ত্রসমর্পণের জাকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান। নিরাপত্তা নিশ্চিতে সেনাবাহিনীসহ রাষ্ট্রীয় সকল বাহিনী্ ও গোয়েন্দা সংস্থার উপস্থিতি ও নজরদারি ছিল ব্যাপক। সাংবাদিক, দেশী বিদেশী পর্যবেক্ষক, কূটনৈতিক মিশনের প্রতিনিধিসহ হাজার হাজার জনতায় পরিপূর্ণ ছিল স্টেডিয়াম। এই নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা বেস্টনি ভেদ করে সেদিন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, পাহাড়ি গণপরিষদ ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের প্রতিবাদী অংশটি পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের ব্যানার প্রদর্শন করে এক সাহসিকতার নজির স্থাপন করে। তাদের প্রদর্শিত ব্যানারে লেখা ছিল “আপোষ চুক্তি মানি না, পূর্ণস্বায়ত্তশাসন চাই, No Full Autonomy No Rest”. এ সময় তারা পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের দাবি জানিয়ে শ্লোগানও দেন।

এত কঠোর নিরাপত্তা বেস্টনির মধ্যেও পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের ব্যানার প্রদর্শনের ঘটনাটি অনুষ্ঠানে উপস্থিত হাজার হাজার দর্শকের নজর কেড়ে নেয়। হ য ব র ল হয়ে যায় অনুষ্ঠান। ফলে বেশ কিছু সময় পর্যন্ত টিভির লাইভ অনুষ্ঠান সম্প্রচার বন্ধ করে রাখা হয়।
সেদিন সেনাবাহিনী ও পুলিশ সদস্যরা লাঠিচার্জ করেও পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের ব্যানারটি কেড়ে নিতে পারেনি।
সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।