ইউপিডিএফ-এর মানবাধিকার রিপোর্টের তথ্য:

২০১৬ সালে ইউপিডিএফ’র ৭৩ জন গ্রেফতার, যৌন নির্যাতনের শিকার ২১ জন পাহাড়ি নারী

0

ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) এর মানবাধিকার পরিবীক্ষণ সেল ২০১৬ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম মানবাধিকার রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। আজ ৪ জানুয়ারী ২০১৭ রোজ বুধবার মিডিয়ায় প্রকাশিত উক্ত রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০১৬ সালে ইউপিডিএফের ‘কমপক্ষে ৭৩ জন নেতা-কর্মী ও সমর্থককে গ্রেফতার করা হয়েছে, ২১ জন পাহাড়ি নারী ও শিশু ধর্ষণ, ধর্ষণ প্রচেষ্টা অথবা অপহরণের শিকার হয়েছেন এবং ৯টি সেটলার হামলার ঘটনা ঘটেছে।’

updf-flagপ্রকাশিত রিপোর্টে গ্রেফতারের তথ্য উল্লেখ করে বলা হয়, ২০১৬ সালে ইউপিডিএফ’র উপর ব্যাপক রাজনৈতিক দমন-পীড়ন চালানো হয়। ইউপিডিএফ কেন্দ্রীয় নেতা উজ্জ্বল স্মৃতি চাকমা, অন্যতম সংগঠক মিঠুন চাকমা ও ইউপিডিএফ-ভুক্ত পিসিপি’র কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক বিপুল চাকমাসহ ৭৩ জন নেতা-কর্মী, সমর্থককে আটক করা হয়েছে। গ্রেফতারের একটি সাধারণ নিয়ম হলো গ্রেফতারকৃতদের হাতে অস্ত্র গুঁজে দেয়ার পর পুলিশের হাতে সোপর্দ করা। সাধারণত সেনাবাহিনীর সদস্যরাই গ্রেফতারগুলো করে থাকে। তবে দু একটি ক্ষেত্রে পুলিশ কর্তৃকও গ্রেফতারের ঘটনা ঘটেছে।
গ্রেফতারের পর প্রায় প্রত্যেকের উপর চালানো হয় অমানুষিক শারীরিক নির্যাতন। এছাড়া ইউপিডিএফ নেতা উজ্জ্বল স্মৃতি চাকমার সাথে নির্দয় ও অমানবিক আচরণ করার পর অবমাননকারভাবে তার ছবি মিডিয়ায় ছেড়ে দেয়া হয়। তাকে গ্রেফতারের আগে তার বিরুদ্ধে কোন মামলা কিংবা গ্রেফতারী পরোয়ানা ছিল না। অথচ গ্রেফতারের পর তার বিরুদ্ধে অবৈধ অস্ত্র রাখার মিথ্যা অভিযোগসহ বেশ কয়েকটি মামলা দেয়া হয়। আটকের পর প্রত্যেকের বিরুদ্ধে মামলা অবধারিত। সাধারণত চাঁদাবাজি, অবৈধ অস্ত্র রাখা, গাড়ি ভাঙচুর, সরকারী কাজে বাধা প্রদান, খুন ইত্যাদি অভিযোগে একাধিক মামলা দেয়া হয়। এগুলো যেন সাধারণ অভিযোগ। তবে ইউপিডিএফ সংগঠক মিঠুন চাকমার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ দ- বিধির বিভিন্ন ধারার আনীত অভিযোগের পাশাপাশি তথ্য প্রযুক্তি আইনের একটি বিতর্কিত ৫৭ (২) ধারায়ও মামলা করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে সর্বমোট ১৩টি মামলা রয়েছে, তবে বর্তমানে তিনি জামিনে মুক্ত আছেন।
গ্রেফতারগুলো যে দমনমূলক এবং মামলাগুলো যে হয়রানি ও ষড়যন্ত্রমূলক তা সবার কাছে কমবেশী স্পষ্ট। এ কারণে আটককৃত ৭৩ জনের মধ্যে অনেকে গ্রেফতারের কয়েক মাসের মধ্যেই আদালত থেকে জামিনে মুক্তি লাভ করেছেন। তবে উজ্জ্বল স্মৃতি চাকমা, বিপুল চাকমাসহ এখনো ১৫ জন কারাগারে বন্দী রয়েছেন। এদের মধ্যে খাগড়াছড়িতে ১২ জন ও রাঙামাটিতে ৩ জন।

নারীর প্রতি যৌন সহিংসতার তথ্য তুলে ধরে রিপোর্টে বলা হয়, ২০১৬ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে কমপক্ষে ২১ জন পাহাড়ি নারী-শিশু ধর্ষণ, ধর্ষণ চেষ্টা ও অপহরণের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হন ৬ জন, ধর্ষণ চেষ্টার শিকার হন ১৩ জন, শ্লীলতাহানির শিকার হন ১ জন ও অপহরণের শিকার হয়েছেন ১ জন।
এদের মধ্যে রাঙামাটির সাজেকে পুলিশ সদস্য কর্তৃক একজন ধর্ষণ প্রচেষ্টা ও ঘিলাছড়িতে সেনা সদস্য কর্তৃক অপর একজন যৌন হামলার শিকার হন। তবে অধিকাংশ ধর্ষণের ঘটনাগুলোর সাথে জড়িত সেটলার বাঙালিরা। তাদের কারণে পাহাড়ি নারীরা আজ সর্বক্ষেত্রে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।

পাহাড়িদের উপর সেটলার হামলার ঘটনা তুলে ধরে রিপোর্টে বলা হয়, ২০১৬ সালে বড় ধরনের সেটলার হামলার ঘটনা না ঘটলেও সেটলাররা পাহাড়িদের উপর বেশ কয়েকটি হামলা চালিয়েছে। ২১ শে ফেব্রুয়ারির মতো রাষ্ট্রীয় দিবসে খাগড়াছড়ির মাটিরাংগায় পাহাড়িদের উপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। বান্দরবানের আলীকদম উপজেলায় ত্রিপুরা গ্রামে হামলা ও বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগের ঘটনা সংঘটিত হয়। খাগড়াছড়িতে বেশ কয়েকবার বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্তভাবে পাহাড়িদের উপর হামলা চালায় সেটলার বাঙালিরা। এছাড়া বাঙালিদের হাতে দুই পাহাড়ি হত্যার শিকার হন।
এছাড়া রিপোর্টে সেনা নির্যাতন-হয়রানি, ঘরবাড়িতে তল্লাশি ও সেটলার কর্তৃক ভূমি বেদখল প্রচেষ্টার তথ্য সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরা হয়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামকে বিশ্বের প্রবল সামরিকায়িত অঞ্চলগুলোর একটি উল্লেখ করে রিপোর্টে বলা হয়, ‘গত চার দশকের অধিক সময় ধরে এই অঞ্চলে সামরিক বাহিনীর একচেটিয়া দখলদারিত্ব ও কর্তৃত্ব বজায় রয়েছে। যে কোন সামরিকায়িত অঞ্চলে মানবাধিকারং লঙ্ঘন একটি স্বাভাবিক ব্যাপার। পার্বত্য চট্টগ্রামের বেলায়ও এ কথা সর্র্বাংশে সত্য। ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চুক্তির আগ পর্যন্ত তথাকথিত কাউন্টার-ইন্সার্জেন্সি বা বিদ্রোহ দমনের অজুহাতে ব্যাপক সেনা নিপীড়ন চালানো হয়েছিল। বর্তমানে সশস্ত্র সংগ্রাম না থাকার পরও পার্বত্য চট্টগ্রামে পূর্বের মতোই বিশাল সামরিক উপস্থিতি বজায় রাখা হয়েছে। অপারেশন উত্তরণের বলে এখানে তাদের ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব নিরঙ্কুশ এবং তাদের কাছে বেসামরিক প্রশাসনও জিম্মি। অপরদিকে জনগণের গণতান্ত্রিক ও মৌলিক মানবাধিকার নির্বাসিত। বেআইনী আটক, গ্রেফতার, শারীরিক নির্যাতন, গ্রামে গ্রামে হানা ও বাড়িঘরে তল্লাশী, হয়রানি, মিথ্যা মামলা, সভাসমাবেশে বাধা দান, হামলা, নারী ধর্ষণ, ভূমি বেদখল, সাম্প্রদায়িক হামলা ইত্যাদি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা অহরহ ঘটে চলেছে।’

পরিবীক্ষণ সেলের সংকলিত তথ্যগুলো সম্পূর্ণ নয় উল্লেখ করে রিপোর্টে আরো বলা হয়, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে এই মানবাধিকার লঙ্ঘন বিচ্ছিন্ন কোন ব্যাপার নয়। এগুলো প্রকৃত অর্থে পাহাড়ি জাতিগুলোর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের এথনিক ক্লিনজিং নীতিরই ফল। পাহাড়ি জাতিগুলোকে নিজ জন্মভূমিতে ধীরে ধীরে প্রথমে সংখ্যালঘু ও পরে একেবারে নিশ্চিহ্ন করাই হলো অঘোষিত রাষ্ট্রীয় নীতি। তাই দেখা যায় যেখানে ১৯৪৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি বাঙালির অনুপাত ৯৮ : ২, বর্তমানে তা ৫২ : ৪৮ এ দাঁড়িয়েছে। তবে পার্বত্য চুক্তির পর গত ১৯ বছরে পার্বত্য চট্টগ্রামে শহরাঞ্চলে এবং বিশেষত জেলার পৌরসভাগুলোতে জনমিতির ভারসাম্য মৌলিকভাবে বদলে গেছে। উদহারণস্বরূপ, খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি পৌরসভায় চুক্তির পূর্বে পাহাড়িরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। বর্তমানে এই দুই পৌরসভায় দুই তৃতীয়াংশ ভোটার হলেন বাঙালি। বান্দরবান পৌরসভায় এই অনুপাত আরও বেশী, সেখানে প্রায় পাঁচ ভাগের চার ভাগই বাঙালি। এই অনুপাতগুলো যে কোন জাতির জনগণকে নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে শঙ্কিত না করে পারে না। অথচ এরপরও বাঙালি অনুপ্রবেশ থেমে নেই এবং এই ধারা রোধ করা না হলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালিদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিরঙ্কুশ হয়ে যাবে তাতে কোন সন্দেহ থাকতে পারে না।’

সরকারের সমালোচনা করে রিপোর্টে বলা হয়, ‘সরকার মুখে পাহাড়ি জনগণের অধিকারের কথা বললেও বাস্তবে পার্বত্য চট্টগ্রামের মানবাধিকার পরিস্থিতি ব্যাপারে যথেষ্ট উদাসীন। মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কখনও কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে বলে আজ পর্যন্ত শোনা যায়নি। গত ২০ বছরেও কল্পনা চাকমার অপহরণকারী লে. ফেরদৌস ও তার সহযোগীদের বিচার ও শাস্তি হয়নি। মানবাধিকার লঙ্ঘন অব্যাহত থাকার এটাও অন্যতম কারণ। তবে মোট কথা হলো, পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সেনাবাহিনী প্রত্যাহার ও সেটলারদের সরিয়ে সমতলে পুনর্বাসন না করা পর্যন্ত মানবাধিকার লঙ্ঘন পুরোপুরি বন্ধ হরে বলে আশা করা যায় না।’

পুরো রিপোর্টটি পড়তে নীচের লিঙ্কে ক্লিক করুন:

human rights violation reports in cht-2016

——————-

সিএইচটি নিউজ ডটকম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More