মতামত

২০১৮ সালের ইউপিডিএফ-জেএসএস (সন্তু) সমঝোতা সম্পর্কে

0


মিল্টন চাকমা, সংগঠক, ইউপিডিএফ



চুক্তি-উত্তর পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনীতির একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো ইউপিডিএফ ও জেএসএসের মধ্যে সংঘাত ও সমঝোতা। জেএসএস  প্রধান সন্তু লারমা প্রথমদিকে ইউপিডিএফের সাথে আলোচনার প্রস্তাব নাখোশ করলেও পরে প্রতিরোধ ও চাপের মুখে কোনঠাসা হলে তিনি নিজেই ইউপিডিএফের কাছে আলোচনার প্রস্তাব দেন। গত ৬ ডিসেম্বর ২০২৫ “জরুরী অবস্থার সময় ভূমি বেদখলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রামে ইউপিডিএফ” শিরোনামে ২০০৬ ও ২০০৭ সালে ইউপিডিএফ ও জেএসএসের মধ্যেকার সমঝোতা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছিল। আজ এই নিবন্ধে ২০১৮ সালের সমঝোতা বিষয়ে আলোকপাত করা হলো।

শুরুতে এখানে বলে রাখা দরকার, ২০০০ সালেও একবার উভয় দল আলোচনায় বসে সংঘাত বন্ধে একমত হয়েছিল। সে সময় জেএসএসের সুপ্রীম নেতা সন্তু লারমা ভারতে অবস্থান করছিলেন। খাগড়াছড়িতে জেএসএসের অন্য নেতারা তার অনুপস্থিতিতে উদ্যোগ নিয়ে ইউপিডিএফের সাথে আলোচনায় বসে উক্ত সমঝোতা করেছিলেন। তবে সন্তু লারমা সেই সমঝোতা মেনে নেননি। ভারত থেকে ফেরার পর পরেই তিনি তা বাতিল করে দেন এবং ইউপিডিএফের ওপর হামলা অব্যাহত রাখেন।

ইউপিডিএফ একদিকে জেএসএসের আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে এবং অন্যদিকে সংলাপ-ঐক্যের ব্যাপারে জোর দিয়ে প্রচারণা চালায়, যা জনগণের কাছে ব্যাপক সমর্থন লাভ করে। এমনকি জেএসএসের একটি বড় অংশও সংঘাতের বদলে ঐক্যের ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করে। ইউপিডিএফের এই সঠিক নীতির কারণে ২০০৫ সালের শেষের দিকে দলীয় সম্মেলনকে কেন্দ্র করে জেএসএস ভাঙনের মুখে পড়ে। এই প্রেক্ষাপটে সন্তু লারমা নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে ইউপিডিএফের কাছে আলোচনার প্রস্তাব দেন। অতঃপর বহু আকাঙ্ক্ষিত সংলাপ অনুষ্ঠিত হয় এবং ২০০৬ সালের প্রথমার্ধে সংঘাত বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে উভয় দল সমঝোতায় উপনীত হয়। কিন্তু তৃতীয় সমঝোতা বৈঠক শেষ হওয়ার কয়েক দিন পরই জেএসএস উক্ত সমঝাতার শর্ত লঙ্ঘন করে ইউপিডিএফের ওপর হামলা শুরু করে দেয়।

সম্মেলনে সন্তু লারমা নিজের পছন্দসই কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করতে সক্ষম হলেও তার দলের ভাঙন ঠেকাতে পারেননি। ইউপিডিএফের ওপর হামলার সময়ই জেএসএসের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করে। তার দলের শীর্ষ স্থানীয় নেতা রূপায়ন দেওয়ান, সুধাসিন্ধু খীসা ও রক্তোৎপল ত্রিপুরাসহ দলটির একটি বড় অংশ সন্তু লারমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। ফলে সন্তু লারমার অনুগতরা পুরো খাগড়াছড়ি জেলা ও রাঙামাটি জেলার ব্যাপক এলাকা ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়। ঠিক এই প্রেক্ষাপটে সন্তু লারমা আবার নতজানু হয়ে ইউপিডিএফের কাছে আলোচনার প্রস্তাব নিয়ে হাজির হন। উভয় দলের মধ্যে ২০০৭ সালে আবার সমঝোতা স্থাপিত হয়, যা সাজেক সমঝোতা নামে উল্লেখ করা হয়েছে।

সাজেক সমঝোতার পর সন্তু লারমার অনুগতরা ভারতের মিজোরাম সীমান্তে চলে যায় এবং অনাক্রমণ শর্তের সুযোগ নিয়ে অস্ত্র, গোলাবারুদ ও কর্মী সংগ্রহ করে নিজেদের শক্তি সঞ্চয়ের দিকে মনোযোগ দেয়। অন্যদিকে ইউপিডিএফ দেশে জরুরী অবস্থার সময় পার্বত্য চট্টগ্রামে শুরু হওয়া ভূমি বেদখলের বিরুদ্ধে জনগণকে সংগঠিত করে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এভাবে সংগ্রামের প্রক্রিয়ায় ইউপিডিএফ খাগড়াছড়ি ছাড়াও রাঙ্গামাটির লংগদু, জুরাছড়ি, বাঘাইছড়ি, বিলাইছড়ি ও রাজস্থলীতে তার সাংগঠনিক কার্যক্রম বিস্তার করতে সক্ষম হয়।

সাজেক সমঝোতা আনুমানিক ২০১০ সাল পর্যন্ত স্থায়ী হয়। নতুন করে শক্তি সঞ্চয় করার পর সন্তু গ্রুপ ২০০৭ সালের উক্ত সমঝোতার শর্ত লঙ্ঘন করে প্রথমে জুরাছড়ির দিকে আবার ইউপিডিএফের ওপর হামলা শুরু করে দেয়। ২০১১ সালের ২১ মে তাদের একটি সশস্ত্র দল সুবলং উপজেলার মিদিঙ্যাছড়িতে ইউপিডিএফ নেতা অনিমেষ চাকমা ও অপর তিন সদস্যকে গুলি করে হত্যা করে। অনিমেষ চাকমা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর (মাস্টার্স) ডিগ্রি লাভ করে ইউপিডিএফে যোগ দিয়েছিলেন এবং ২০০৭-৮ সালে দীঘিনালায় এবং বিশেষত সাধনাটিলা বনবিহারের জমি বেদখলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রামে সাফল্যের সাথে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।

নতুন করে সংঘাত শুরু হলে ইউপিডিএফ সন্তু গ্রুপের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে বাধ্য হয় এবং এক পর্যায়ে জেএসএস সন্তু গ্রুপ আবার দুর্বল হয়ে পড়লে ২০১৫ সালের মধ্য ভাগে পুনরায় ইউপিডিএফের কাছে আলোচনার প্রস্তাব দেয়। ইউপিডিএফ প্রস্তাবে রাজী হয় এবং তিন দফা আলোচনার পর ২০১৮ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি দুই দল ৩ দফা সমঝোতায় উপনীত হয়। সমঝোতার শর্তগুলো হলো: ১) উভয় পক্ষ স্ব স্ব নিয়ন্ত্রিত এলাকায় সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করবে, অপর পক্ষের সাংগঠনিক এলাকায় প্রবেশ করবে না। ২) উভয় পক্ষ একে অপরের ওপর হামলা বন্ধ রাখবে। ৩) দুই পক্ষের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি হলে তা আলোচনার মাধ্যমে নিরসন করা হবে।

এই সমঝোতাও বেশিদিন টেকেনি। ২০২০ সালের ৫ মে সন্তু গ্রুপ সমঝোতার শর্ত লঙ্ঘন করে পানছড়ি ও দীঘিনালায় ইউপিডিএফের সাংগঠনিক এলাকায় অনুপ্রবেশ করে এবং বিভিন্ন উস্কানিমূলক কার্যকলাপ চালাতে থাকে। ইউপিডিএফ লিখিত ও মৌখিকভাবে এর প্রতিবাদ জানায়। ২০২০ সালের ১০ সেপ্টেম্বর জেএসএস নেতা শক্তিপদ ত্রিপুরা ইউপিডিএফের লিখিত প্রতিবাদ লিপির প্রাপ্তি স্বীকার করেন এবং জানান যে, আর্থিক সমস্যার কারণে তারা পানছড়ি ও দীঘিনালায় ইউপিডিএফের সাংগঠনিক এলাকায় অনুপ্রবেশ করতে বাধ্য হয়েছেন। তারা কিছুদিনের মধ্যে চলে যাবেন বলেও তিনি ইউপিডিএফ নেতা উজ্জ্বল স্মৃতি চাকমাকে আশ্বাস দেন। কিন্তু উক্ত প্রতিশ্রুতি পালন করা দূরে থাক, শক্তিপদ বাবু ২১ সেপ্টেম্বর পুনরায় ফোন করে উল্টো ইউপিডিএফের বিরুদ্ধে সমঝোতার শর্ত লঙ্ঘনের মিথ্যা ও আজগুবি অভিযোগ উত্থাপন করেন।

সমঝোতার শর্ত লঙ্ঘন করে জেএসএস সন্তু গ্রুপের ইউপিডিএফের সাংগঠনিক এলাকায় অবস্থান ও বিভিন্ন উস্কানিমূলক জনঅহিতকর কর্মকাণ্ড চালানোর পরও ইউপিডিএফ নেতৃত্ব অত্যন্ত ধৈর্য্য, সহনশীলতা ও সংযম প্রদর্শন করে। তারা আলোচনার মাধ্যমে দুই পক্ষের মধ্যেকার বিরাজমান সমস্যা নিরসনের আপ্রাণ চেষ্টা চালায়। সে কারণে ২০২২ সালের ৮ জুন পর্যন্ত উভয় পক্ষের মধ্যে তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে কথা আদান-প্রদান চলে।

ঐদিন মধ্যস্থতাকারীরা জেএসএস নেতা সুগম বাবু ও প্রভাত বাবুর মৌখিক বার্তা ইউপিডিএফকে জানিয়ে দেন। তাদের বার্তা ছিল: ১) জেএসএস (সন্তু) ইউপিডিএফের ওপর আক্রমণ চালাবে না। ২) তাদের নেতা সন্তু লারমা তাদেরকে ইউপিডিএফের সাথে সংলাপ প্রক্রিয়া জোরদার করার নির্দেশ দিয়েছেন। ৩) তারা বার্তাটি লিখিত দিতে চাননি কারণ তা ফাঁস হয়ে যেতে পারে।

জেএসএস নেতাদের উক্ত বার্তার জবাবে ইউপিডিএফের পক্ষ থেকে মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে তাদেরকে জানিয়ে দেয়া হয় যে, ইউপিডিএফ জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে জেএসএসের উক্ত প্রস্তাবের পূর্ণ জবাব দেবে। কিন্তু তার আগেই, ১১ জুন জেএসএস নিজের দেয়া অনাক্রমণের প্রতিশ্রুতি নিজেরাই ভঙ্গ করে পানছড়ি ও দীঘিনালায় একযোগে ইউপিডিএফের ওপর হামলা চালায়। সেই পর থেকে আজ পর্যন্ত দুই পক্ষের মধ্যে চলমান সংঘাত এখনও বন্ধ হয়নি।

শেষে একটি কথা বলা যায়, জেএসএস সন্তু গ্রুপ বা বিশেষভাবে বললে সন্তু লারমা বিশ্বাসঘাতকতার যে নির্লজ্জ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, তা হয়তো অনেকের কাছে অজানা। যখন তার দল দুর্বল হয়ে পড়ে, তখন তিনি আলোচনার প্রস্তাব দেন এবং সমঝোতার ভাণ করেন। কিন্তু যখনই তিনি নতুন করে শক্তি জোগার করতে সক্ষম হন, তখন আবার ইউপিডিএফের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। এই বিশ্বাসঘাতকতার ফল তাকে একদিন পেতেই হবে। ইউপিডিএফ সন্তু লারমার ফন্দি বুঝতে পারলেও জাতি ও জনগণের বৃহত্তর স্বার্থের কথা বিবেচনা করে তার আলোচনার প্রস্তাবে বার বার রাজী হয়েছে এবং সমঝোতা করেছে। ইউপিডিএফও নিশ্চয়ই তার এই মহৎ নীতির ফল পাবে এবং একদিন পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল নিপীড়িত জাতি ও জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হবে।

(২০ ডিসেম্বর ২০২৫)

*লেখা সংগ্রহ: ইউপিডিএফের অফিসিয়াল ফেসবুক পেইজ



This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More