২০২১ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে আলোচিত কয়েকটি ঘটনা

সিএইচটি নিউজ ডেস্ক ।। বিদায়ী ২০২১ সালটি পার্বত্য চট্টগ্রামে নানা ঘটনার মধ্যে দিয়েই অতিবাহিত হয়েছে। সংঘটিত ঘটনাবলীর মধ্যে কিছু ঘটনা বেশ আলোচিত হয়। ২০২১ সালে আলোচিত কয়েকটি ঘটনা দেখা যাক।
১। প্রতিবাদী ম্রোদের দিকে এক সেনা সদস্যের অস্ত্র তাক করা
ঘটনাটি জানুয়ারি ৬ তারিখের। বান্দরবানের চিম্বুক পাহাড়ে বসবাসকারী ম্রো গ্রামবাসীরা তাদের বংশপরম্পরায় ভোগদখলীয় পাহাড়ে ঝাড়ুফুল কাটতে পাঁচতারকা হোটেল নির্মাণকারীদের লোকজন বাধা দেয়। এতে গ্রামবাসীরা প্রতিবাদ জানালে জনৈক সেনাসদস্য সেখানে উপস্থিত হয়ে প্রতিবাদকারী গ্রামবাসীদের দিকে বন্দুক তাক করে গুলি করতে উদ্যত হন। তবে পাশের একজন তাকে নিবৃত্ত করলে তিনি বন্দুক নামিয়ে সেখান থেকে সরে যান। এ ঘটনার ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে বেশ আলোচিত হয়।
প্রসঙ্গত, চিম্বুক পাহাড়ে সেনাকল্যাণ সংস্থা ও সিকদার গ্রুপ যৌথভাবে পাঁচতারকা হোটেলসহ বিলাসবহুল পর্যটন কেন্দ্র নির্মাণ করছে। স্থানীয় ম্রো জনগণের প্রতিবাদ সত্ত্বেও নির্মাণ অব্যাহত রয়েছে।

২। সেনা ক্যাম্প স্থাপনে ৭ একর জমি বছরে ৭,০০০ টাকায় জোরপুর্বক লিজ!
এই ঘটনাটি ঘটেছে রাঙামাটির নান্যাচর উপজেলার বুড়িঘাট ইউনিয়নে নামেঅং (জাল্যাপাড়া) নামক স্থানে ২০ জানুয়ারি ২০২১ তারিখে। নান্যাচর জোনের সেনাবাহিনী ঐ এলাকর বাসিন্দা জ্যোতিলাল চাকমা(৭৫)-কে তার ভোগদখলীয় ৭ একর জমি বাৎসরিক ৭ হাজার টাকায় লিজ দিতে বাধ্য করে। সেনাবাহিনীর সদস্যরা তার কাছ থেকে একটি কাগজে স্বাক্ষর নেয়। আর স্বাক্ষর নেওয়ার পর তাকে ‘৭ একর জমির লিজ বাবদ ৭,০০০ টাকা লেখা’ একটি খামের প্যাকেট ধরিয়ে দেয়। এর আগে তিনি সেনা কমাণ্ডারদের বলেছিলেন, ‘আপনারা এই জমিতে ক্যাম্প করলে আমি কোথায় চাষাবাদ করবো? এই জমি ছাড়া তো আমার আর কোন জমি নেই। চাষাবাদ করতে না পারলে আমরা খাবো কি”? কিন্তু শেষ পর্যন্ত জমিটি দিতেই বাধ্য হন।
বর্তমানে সেনাবাহিনী ওই জায়গায় ক্যাম্প স্থাপন করে অবস্থান করছে। যদিও পার্বত্য চুক্তি অনুযায়ী অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহারের শর্ত রয়েছে।
এ ঘটনাটি সামাজিক যোগাযোগ্ মাধ্যমে ভাইরাল হলে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা ও নিন্দার ঝড় উঠে।

৩। বান্দরবানে সেনা সদস্য দ্বারা এক নারীকে ধর্ষণ চেষ্টার প্রতিবাদে এলাকাবাসীর ক্যাম্প ঘেরাও
বান্দরবান সদর উপজেলার রাজবিলা ইউনিয়নের তাইনখালি বাজার পাড়ায় সেনাবাহিনীর এক সদস্য কর্তৃক স্থানীয় এক মারমা নারীকে (২৩) ধর্ষণ চেষ্টার প্রতিবাদে এলাকাবাসী ফুঁসে উঠে। ১৮ জানুয়ারি ২০২১ সংঘটিত এ ঘটনার প্রতিবাদ পরদিন (১৯ জানুয়ারি) সকালে এলাকার নারী-পুরুষ সেনাবাহিনীর অস্থায়ী ক্যাম্প তাইনখালি বাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় ঘেরাও করে। পরে সেনা সদস্যরা গ্রামে গিয়ে ধরপাকড় ও ভয়ভীতি দেখিয়ে ঘটনাটি ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করে। এ ঘটনাটিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি হয়। তবে অভিযুক্ত সেনা সদস্যের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক কোন পদক্ষেপ নেওয়ার তথ্য পাওয়া যায়নি।

৪। পাঁচ তারকা হোটেল প্রকল্প বাতিলে চিম্বুক পাহাড়বাসীর লংমার্চ
চিম্বুকের নাইতং পাহাড়ে পাঁচতারকা হোটেলসহ পর্যটন স্থাপন প্রকল্প বাতিলের দাবিতে চিম্বুক হতে বান্দরবান শহরে লংমার্চ করে চিম্বুক পাহাড়বাসী। ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১ অনুষ্ঠিত এ লংমার্চে হাজারো জনতা পায়ে হেঁটে বিভিন্ন ব্যানার, প্ল্যাকার্ড সহকারে অংশ নেন।
এ সময় তারা ‘আমার ভূমি আমার মা’, ’আমাদের ভূমি আমাদের অধিকার তোমাদেন নয়’, ’আমাদের জীবিকার উৎস অন্যায় হস্তক্ষেপ বন্ধ কর’, ’এই পাহাড় আমাদের জীবন’, ’মুনাফার জন্য পাহাড় বিকৃতি চলবে না, চলবে না’… ইত্যাদি শ্লোগান সম্বলিত প্ল্যাকার্ড বহন করেন।
দীর্ঘ ২২ কিলোমিটার লংমার্চ করে এসে তারা বান্দরবান জেলা শহরের রাজার মাঠে অবস্থান নেন এবং সেখানে এক প্রতিবাদ সমাবেশ করেন।
ম্রো জাতিসত্তার চিম্বুক পাহাড় রক্ষার এই প্রতিবাদী লংমার্চটিও ব্যাপক আলোচিত হয় এবং জনগণকে উদ্বুদ্ধ করে।

৫। খাগড়াছড়ি টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজে শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রীকে ধর্ষণ চেষ্টার ঘটনা
খাগড়াছড়ি টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষক সোহেল রানা কর্তৃক এক পাহাড়ি ছাত্রীকে ধর্ষণ চেষ্টার ঘটনাটি প্রকাশ হলে সেটি বেশ আলোচিত হয়। ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১ সংঘটিত এ ঘটনাটি প্রকাশ পাওয়ার পর প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ-মানববন্ধন করেন। তারা এই ঘটনায় অভিযুক্ত শিক্ষকের শাস্তির দাবিতে অধ্যক্ষের কাছে অভিযোগ দিতে গেলে সেখানে আকাশি চাকমা নামে একজন ঘটনাটি নিয়ে শিক্ষার্থীদের সাথে বাগবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন। পরে ওই ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হলে ঘটনাটি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। এমতাবস্থায় প্রশাসন অভিযুক্ত শিক্ষককে গ্রেফতার করতে বাধ্য হয়।

৬। মাটিরাঙ্গার তবলছড়িতে সেটলারদের সাম্প্রদায়িক উস্কানি
খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা উপজেলার তবলছড়িতে সেটলার বাঙালিদের সাম্প্রদায়িক উস্কানির ঘটনাটিও বেশ আলোচিত হয়। ৫ এপ্রিল ২০২১ রাতের আঁধারে সেটলারা পাহাড়িদের বিরুদ্ধে মিছিল শুরু করলে শত শত পাহাড়ি পরিবার ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যান। পরে সেনা, বিজিবি ও প্রশাসনের হস্তক্ষেপে বড় ধরনের কোন ঘটনা ঘটতে পারেনি।

৭। সিন্দুকছড়িতে গ্রামবাসীর ঘর ভেঙে দিয়ে সেনাবাহিনীর কমিউনিটি ক্লিনিক!
খাগড়াছড়ির গুইমারা উপজেলাধীন সিন্দুকছড়ির পুংখি মুড়ো (পক্ষীমুড়ো) এলাকায় সিন্দুকছড়ি-মহালছড়ি রাস্তার পাশে সেনাবাহিনী সনে রঞ্জন ত্রিপুরা নামে এক জুম্ম গ্রামবাসীর ঘর ভেঙে দিয়ে সেখানে রাতারাতি একটি কমিউনিটি ক্লিনিক তৈরি করে। মূলত সনে রঞ্জন ত্রিপুরার জায়গাটি বেদখল করতেই তারা এটি করেছে। আর কমিউনিটি ক্লিনিক নাম দেওয়া হলে্ও সেটি এখন সেনাবাহিনীর পোষ্ট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ১২ জুন ২০২১ রাতে সংঘটিত এই ঘটনাটি প্রকাশ হলে তুমুল আলোচিত হয়। এ ঘটনার প্রতিবাদে খাগড়াছড়ি সদরসহ বিভিন্ন স্থানে লাগাতারভাবে জনগণ বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। কিন্তু সনে রঞ্জন ত্রিপুরা এখনো জায়গাটি ফিরে পাননি।

৮। কুদুকছড়িতে ছাত্রীদের ভাড়া মেসে সেনাবাহিনীর তল্লাশি, কাপড়-চোপড়-বদনা চুরি
রাঙামাটির কুদুকছড়িতে ১২ অক্টোবর ২০২১ রাতে রাঙামাটি সেনা জোনের একদল সেনা সদস্য কয়েকজন ছাত্রীর একটি ভাড়া মেসে তল্লাশি চালায়। তল্লাশি শেষে সেনারা ছাত্রীদের ব্যবহৃত কাপড়-চোপড় (অন্তর্বাসহ), মোবাইল ফোন এমনকি টয়লেটে ব্যবহৃত বদনাও চুরি করে নিয়ে যায়। ঘটনাটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আলোচিত হয়। অনেকে তাদেরকে অন্তর্বাস, বদনা চোর হিসেবেও আখ্যায়িত করেন।

৯। রাঙামাটিতে কলেজ শিক্ষার্থী পুর্ণিমা চাকমার রহস্যজনক মৃত্যু
রাঙামাটি শহরের রাজবাড়ী এলাকায় পাহাড়ি বাড়িওয়ালার বাড়িতে ভাড়া বাসায় পূর্ণিমা চাকমা(১৯) নামে এক কলেজ ছাত্রীর রহস্যজনক মৃত্যুর ঘটনাটি ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। ২৯ অক্টোবর ২০২১ দুপুরে পূর্ণিমা চাকমাকে অচেতন অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত ডাক্তাররা তাকে মৃত্যু ঘোষণা করেন। এই মৃত্যুর ঘটনাটিকে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড দাবি করে পূর্ণিমার সহপাঠীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরব হন এবং মানববন্ধন ও সংবাদ সম্মেলেন করে এ ঘটনার সুষ্ঠূ তদন্ত ও বিচার দাবি করেন। কিন্তু রহস্যজনক কারণে লাশের ময়না তদন্ত রিপোর্ট দেওয়া হয়নি এবং থানা পুলিশও মামলা গ্রহণ করেনি।
পরবর্তীতে আদালতে মামলা দায়ের করা হলেও এর কোন সুরাহা হয়নি।

১০। আলোচিত ছবি: গাছের উপর উঠে বিজিবি সদস্যের ইউপিডিএফের ফেস্টুন নামানো
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)এর এক সদস্য গাছের উপর উঠে ইউপিডএফ’র একটি ফেস্টুন নামাচ্ছে এমন একটি ছবি সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হলে এটি নিয়ে বেশ আলোচনা হয়। ২৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ইউপিডিএফের নেতা-কর্মীরা ফেস্টুনটি টাঙিয়েছিলো। ফেস্টুনটিতে চাকমা ভাষায় লেখা ছিল “ পূর্ণস্বায়ত্তশন ন’ অলে ন’ খিমিবং- ইউপিডিএফ অর্থাৎ ‘পূর্ণস্বায়ত্তশাসন মেনে না নেয়া পর্যন্ত ক্ষান্ত হবো না’।
বেচারা! বিজিবি সদস্যকে উপরের নির্দেশ পালন করতে গিয়ে গাছের উপর উঠেই ফেস্টুন নামাতে বেশ কষ্ট করতে হয়।
ফেস্টুন নামানোর এই ঘটনাটি ঘটে খাগড়াছড়ির পানছড়ি উপজেলার লোগাঙের বাবুড়ো পাড়া এলাকায়। ফেস্টুনটি নামানোর সময় এলাকার লোকজনের সাথে বিজিবি সদস্যদের বাগবিতণ্ডার ঘটনাও ঘটে। ফেস্টুন, ব্যানার, পোস্টার টাঙানো নাগরিকদের একটি মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকার এমন যুক্তি দিয়ে এলাকাবাসী বিজিবি সদস্যদের প্রশ্ন করলে তখন এক বিজিবি সদস্য বলেন ‘বাংলাদেশে গণতন্ত্র নেই জান না?’

সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।
সিএইচটি নিউজের ইউটিউব চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব করুন