পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসে এই দিন

৭ মার্চ : মুখোশ বাহিনীর বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ ও অমর বিকাশ শহীদ দিবস

0

বিশেষ প্রতিবেদন, সিএইচটি নিউজ
মঙ্গলবার, ৭ মার্চ ২০২৩

মুখোশ বাহিনীর বিরুদ্ধে জনতার লাঠি মিছিল। ফাইল ছবি

৭ মার্চ পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসে জনগণের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের একটি বীরত্বপূর্ণ দিন। ১৯৯৬ সালের এই দিনে তৎকালীন সরকার ও সেনাবাহিনীর সৃষ্ট সন্ত্রাসী মুখোশ বাহিনীকে প্রতিরোধ করতে খাগড়াছড়ির জনতা জীবন বাজি রেখে রাস্তায় নেমে পড়েছিল। সেদিন জনতার বীরত্বপূর্ণ প্রতিরোধ সংগ্রামে সামিল হয়ে সেনাবাহিনীর গুলিতে শহীদ হয়েছিলেন অমর বিকাশ চাকমা। আর এ প্রতিরোধের ফলে সরকার মুখোশ বাহিনী ভেঙে দিতে বাধ্য হয়েছিল। এই বীরত্বপূর্ণ দিনটি সম্পর্কে সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরা হলো :

মুখোশ বাহিনী কারা গঠন করেছিল
পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি) ও পাহাড়ি গণপরিষদ (পিজিপি)-কে গণতান্ত্রিক পন্থায় মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়ে তৎকালীন বিএনপি সরকারের যোগাযোগ মন্ত্রী কর্ণেল(অব:) অলি আহম্মদের প্রত্যক্ষ মদদে ও খাগড়াছড়ি ২০৩ সেনা ব্রিগেডের তত্ত্বাবধানে সমাজের বখাটে যুবকদের নিয়ে একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী তৈরি করা হয়, যা স্থানীয়দের কাছে ‘মুখোশবাহিনী’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসের মাধ্যমে এলাকার পরিস্থিতি অস্থির করে পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক সমাধান বাধাগ্রস্ত করাই ছিল এর লক্ষ্য। সেনাবাহিনীর ছত্রছায়ায় থেকে মুখোশ বাহিনীর সন্ত্রাসীরা এলাকায় ব্যাপক তাণ্ডব সৃষ্টি করেছিল।

সেদিন জনতা যেভাবে মুখোশদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল
সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ সহায়তায় মুখোশ বাহিনীর সন্ত্রাসীরা এলাকায় শান্তি শৃংখলা বিনষ্ট ও জনজীবনে নানা বিঘ্ন সৃষ্টি করলে জনগণ অতিষ্ঠ হয়ে উঠে। সেদিন (৭ মার্চ ১৯৯৬) সন্ত্রাসীরা পেরাছড়া গ্রামে গিয়ে গ্রামবাসীদের ঘরবাড়িতে তাণ্ডব চালাতে শুরু করলে গ্রামের লোকজন “মুখোশ মুখোশ’ বলে চিৎকার দেয়। আর এতে মুহুর্তের মধ্যেই পেরাছড়া গ্রামের জনতা লাঠিসোটা নিয়ে ছুটে আসে। তাদের চিৎকার শুনে পেরাছড়ার আশে-পাশের গ্রাম সিঙ্গিনালা, খবংপজ্যা, নারাংহিয়া, মাজনপাড়া সহ বিভিন্ন এলাকার শত শত লোকজন লাঠিসোটা নিয়ে সেনা ঔরসজাত মুখোশ বাহিনী গুন্ডাদের ধরতে রাস্তায় নেমে পড়ে।

ইতিমধ্যে শত শত লোক চতুর্দিক থেকে মুখোশ বাহিনী গুন্ডাদের ধরার জন্য ছুটে আসতে থাকে। পেরাছড়া ও স্বনির্ভর এলাকায় মধ্যবর্তী স্টেডিয়াম সংলগ্ন পানছড়ি সড়কে তাদেরকে ঘিরে ফেলে। ব্যারিকেড দিয়ে প্রতিরোধ ব্যুহ রচনা করে। স্বনির্ভর ও পেরাছড়া এলাকার শস্যক্ষেত্র রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। সেদিন রহস্য জনক কারণে ষ্ট্রীট লাইটগুলো আগে থেকেই অফ করে রাখা হয়। আর্মিরা চালাকি করে তাদের Pick up-এর বাতিও নিভিয়ে ফেলে। এতে হাজার হাজার জনতার ভীড়ে সন্ত্রাসী ও সেনাদের রাতের অন্ধকারে সনাক্ত করা দূরূহ হয়ে পড়ে। এই অবস্থার সুযোগ নিয়ে আর্মিরা ব্রাশ ফায়ার করে ও সন্ত্রাসীরা ককটেল ফাটিয়ে জনতাকে সন্ত্রস্ত করতে চায়। কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রতিবাদী জনতা ক্ষান্ত হয়নি। বন্দুকের আওয়াজ থামলে উত্তেজিত জনতা “ধর ধর” বলে চিৎকার করে এগুতে থাকে। এভাবে রাত ৩টা পর্যন্ত চলতে থাকে। প্রতিরোধকোলে স্বনির্ভর এলাকায় সেনাদের গুলিতে মারা যায় অমর বিকাশ চাকমা।

জনতার প্রবল প্রতিরোধের মুখে পরে সেনাবাহিনী ও মুখোশ সন্ত্রাসীরা দুটি পিক-আপ যোগে ক্যান্টনমেন্টের দিকে এগুতে থাকে। বীর জনতা তাদেরকে খেজুর বাগান মাঠ (বর্তমানে উপজেলা মাঠ) পর্যন্ত ধাওয়া করে নিয়ে যায়। সেনা ও গুন্ডারা জনতার তাড়া খেয়ে চেঙ্গী স্কোয়ার হয়ে ক্যান্টমেন্টে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।

সন্ত্রাসী ও সেনা সদস্যদের পলায়নের ১০-১৫ মিনিট পর শত শত যুদ্ধংদেহী পুলিশ নারাংহিয়া ও স্বনির্ভর এলাকায় এসে অবস্থান নেয়। এ সময় নিজ নিজ বাড়িতে ফিরতে থাকা গ্রামবাসীদের লক্ষ্য করে বিনা উস্কানিতে নির্বিচারে শর্টগানের গুলি ছুঁড়তে থাকে। এতে অর্ধশতাধিক নিরীহ গ্রামবাসী আহত হয়। খাগড়াছড়ি পুলিশ সুপার এক প্রেস ব্রিফিং-এ দেড়শ রাউন্ড গুলি ছোঁড়ার দায় স্বীকার করেন।

যেভাবে অমর বিকাশ শহীদ হয়
সন্ত্রাসী গুণ্ডাদের ধাওয়া করতে হাজার হাজার প্রতিবাদী জনতার সাথে অমর বিকাশ চাকমাও সামিল হয়। সেও সাহসিকতার সাথে প্রতিরোধের প্রথম সারিতে এগিয়ে যায়। তার সাথে ছিল তার ভাই সিন্ধু বিকাশ চাকমাসহ আরো কয়েকজন। তারা ধাওয়া করতে করতে স্বনির্ভর স্কুলের কাছাকাছি এসে পড়ে। সেখানে সেনা ঘাতকদের বুলেট তাকে বিদ্ধ করে। সঙ্গে সঙ্গে সে মাটিয়ে লুটিয়ে পড়ে।

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণে প্রকাশ, সেনা ঘাতকরা এতেও ক্ষান্ত না হয়ে বন্দুকের বাট ও বুট জুতা পায়ে তার বুকে আঘাত করে। তারা অমর বিকাশ চাকমার মরদেহ টেনে হিঁচড়ে পিকআপে তুলে নিয়ে যায়। পরে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে। পুলিশ ষড়যন্ত্রমূলকভাবে মরদেহের পাশে অস্ত্র রেখে ছবি তোলে এবং স্বনির্ভর মাঠে অস্ত্রসহ শান্তিবাহিনীর লাশ পেয়েছে বলে অপপ্রচার চালায়। পত্র-পত্রিকায় পরিকল্পিতভাবে প্রচার করে।

পুলিশ লাশ ফেরত না দিয়ে নানা টালবাহানা শুরু করে দেয়। ৯ মার্চ দুপুর বারটায় ফেরত দিতে পুলিশ রাজী হলেও সেদিন লাশ ফেরত দেয়নি। লাশ নিয়ে মিছিলের ছবি দেশের বাইরে প্রচারিত হলে ডিসি ও এসপি’র চাকুরি ক্ষেত্রে সাংঘাতিক জটিলতা সৃষ্টি হবে বলে পুলিশ জানায়। ঐ দিন বিকালে পাহাড়ি গণ পরিষদ, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ ও হিল উইমেন্স ফেডারেশন মিছিল বের করে। তারা অচিরেই লাশ ফেরত দেয়ার দাবি জানায়। দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি ও ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করা হয়। ঢাকা, রাঙামাটি ও বান্দরবানে ঘটনার প্রতিবাদে মিছিল হয়। ১০ মার্চ সকালেও  লাশ ফেরত দেয়ার দাবিতে তিন সংগঠন আবার মিছিল করে এবং জেলা প্রশাসকের নিকট স্মারকলিপি দেয়। পরে ১০ মার্চ বিকের ৪টায় অমর বিকাশ চাকমার লাশ ফেরত দেওয়া হয়।

শহীদ অমর বিকাশ চাকমার প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন পিসিপি’র নেতা-কর্মিরা। ছবি: স্বাধিকার বুলেটিন নং ২

এরপর ১১ মার্চ দুপুর আড়াইটায় শহীদ অমর বিকাশের মরদেহ নিয়ে হাজার হাজার জনতা মিছিল বের করে। মিছিলটি খবংপুজ্জ্যা, কাশেম সমিল, চেঙ্গী স্কোয়ার, নারাংহিয়া, রেডস্কোয়ার হয়ে স্বনির্ভরে শেষ হয়। মিছিল শেষে অনুষ্ঠিত বিশাল সমাবেশ থেকে শহীদ অমর বিকাশ চাকমাকে আন্দোলনের একজন মহান বীর হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। স্বনির্ভর থেকে কাসেম স’মিল সড়কটি তার নামে উৎসর্গ করার কথা ঘোষণা করা হয়। সমাবেশ শেষে শহীদ অমর বিকাশ চাকমার প্রতি শেষ সম্মান প্রদর্শন করে দাহকার্য সম্পন্ন করা হয়। (সূত্র: স্বাধিকার বুলেটিন নং-২, ২০ এপ্রিল ‘৯৬)।

জনতার এই ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের ফলে সেনারা পরবর্তীতে আর মুখোশ বাহিনীকে মাঠে নামাতে সাহস পায়নি। এরপর থেকে ৭ মার্চ ‌’মুখোশ বাহিনী প্রতিরোধ ও অমর বিকাশ শহীদ দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। স্বনির্ভর বাজার হতে কাশেম স’মিল পর্যন্ত সড়কটি “শহীদ অমর বিকাশ সড়ক” হিসেবে নামকরণ করা হয়েছে।

স্মর্তব্য যে, মুখোশ বাহিনী সৃষ্টির অন্যতম হোতা খাগড়াছড়ি ব্রিগেডের তৎকালীন জি-টু মেজর মেহবুব পরবর্তীতে দুর্নীতির দায়ে সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত হয়। এরপর তিনি ঢাকায় অপরাধী চক্রের সাথে যুক্ত হয়ে অপহরণ করতে গিয়ে মাইক্রোবাস সহ ধরা পড়েন বলে জানা যায়।

বর্তমানেও সরকার-সেনাবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামে সেই পুরনো খেলায় মেতে উঠেছে। ’৯৫-৯৬ সালের আদলে একটি সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠী (নব্যমুখোশ বাহিনী) সৃষ্টি করে তাদেরকে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ও মদদ দিয়ে খুন, গুম, অপহরণ, চাঁদাবাজিসহ নানা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে জনমনে ভীতি সঞ্চার করে কায়েমী স্বার্থ উদ্ধারে মরিয়া হয়ে উঠেছে সেনাবাহিনীর একটি অংশ।

তাই, ’৯৬ সালের ৭ মার্চ জনতা যেভাবে ঐক্যবদ্ধভাবে মুখোশ বাহিনীকে প্রতিরোধ করেছিল, সেভাবেই গণপ্রতিরোধের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে আরো একটি প্রতিরোধ সংগ্রামের ইতিহাস সৃষ্টির সময় এসেছে। অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে জনতাকে গর্জে উঠতেই হবে।


সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।


সিএইচটি নিউজের ইউটিউব চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব করুন

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More