কাপ্তাইয়ে কিশোরী ধর্ষণকারী সেনা সদস্যদের গ্রেফতারের দাবিতে পানছড়িতে নারী সংঘের বিক্ষোভ

0

পানছড়ি প্রতিনিধি, সিএইচটি নিউজ
সোমবার, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৩

রাঙামাটির কাপ্তাইয়ে এসএসসি পরীক্ষার্থী মারমা কিশোরীকে ধর্ষণকারী ৬ সেনা সদস্যকে গ্রেফতারের দাবিতে খাগড়াছড়ির পানছড়িতে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘ। সমাবেশ শেষে ধর্ষকদের কুশপুত্তলিকায় ঝাড়ুপেটা করে ঘৃণা প্রকাশ করা হয়।

আজ সোমবার (১১ সেপ্টেম্বর ২০২৩) সকাল ১১ টায় পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘের পানছড়ি উপজেলা কমিটির উদ্যোগে পানছড়ি ডিগ্রী কলেজ মাঠ থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল শুরু করা হয়। মিছিলটি পানছড়ি বাজার ঘুরে এসে কলেজ গেট বুদ্ধ মন্দির মাঠ প্রাঙ্গনে সমাবেশে মিলিত হয়।

সমাবেশে পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘের পানছড়ি উপজেলা সভাপতি মিনতি চাকমার সভাপতিত্বে ও সাংগঠনিক সম্পাদক সাবিনা চাকমার সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক পরিণীতা চাকমা, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের রাঙামাটি জেলা সাংগঠনিক সম্পাদক নিশি চাকমা, পানছড়ি সদর ইউপি নারী মেম্বার মন্দিরা চাকমা, বড়কলক মহিলা কার্বারী মিনু চাকমা, লোগাং ইউপির নারী মেম্বার মিথি চাকমা, হর্গ পাড়ার মহিলা কার্বারী সুমিত্রা ত্রিপুরা, লতিবান ইউনিয়নের সাবেক নারী সদস্য সুজাতা চাকমা। সমাবেশে পানছড়ি বিভিন্ন এলাকা থেকে  দেড় হাজার নারী অংশ গ্রহন করেন।

সমাবেশে নারী সংঘের নেত্রী পরিণীতা চাকমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি নারীরা প্রতিনিয়ত ধর্ষণ, নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন। রাঙামাটির কাপ্তাইয়ের মিতিঙ্গাছড়িতে এসএসসি পরীক্ষার্থী এক মারমা ছাত্রীকে সেনাবাহিনীর ৬ সদস্য ধর্ষণ করেছে। এই ধর্ষণ-নির্যাতনের বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিবাদ করতে হবে। যদি প্রতিবাদ না করি তাহলে এ ধরনের ঘটনা আরো বৃদ্ধি পাবে।

তিনি আরো বলেন, এদেশের শাসকগোষ্ঠি পার্বত্য চট্টগ্রামে নানা ধরনের নিপীড়ন-নির্যাতন জারি রেখেছে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে হামলা, বৌদ্ধ ভিক্ষুদের ওপর হামলা করা হয়। মেয়েরা স্কুলে গেলেও ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। কাপ্তাইসহ বিভিন্ন জায়গায় ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। দীর্ঘ ২৮ বছরেও আমরা কল্পনা চাকমা অপহরণের বিচার পাইনি। যতক্ষণ পর্যন্ত বিচার হবে না ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা আন্দোলন করবো ও বিচার চাইবো। তিনি বলেন, দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একজন নারী হয়েও পার্বত্য চট্টগ্রামে ধর্ষণ-নিপীড়ন, অন্যায়-অবিচারের বিচার করছেন না।

তিনি ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের ধর্ষণ, নিপীড়ন-নির্যাতনের ঘটনা কেউ করতে না পারে সেজন্য ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলনের মাধ্যমে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান।

মহিলা কার্বারি মিনু চাকমা বলেন, ধর্ষণ, নির্যাতন থেকে রক্ষা পাবার জন্য আমাদের প্রতিবাদ করতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন জায়গায় মা-বোনেরা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। তাই আমাদেরকে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরাসহ সবাইকে এ ধরনের ঘটনার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।

মহিলা কার্বারি সুমিত্রা ত্রিপুরা বলেন, ধর্ষণ-নিপীড়নের প্রতিবাদে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা সবাইকে এক হতে হবে। ভয় পাবেন না। আজকে আমাদের মা বোনেরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, তাহলে কেন আমরা ভয় পাবো? প্রয়োজন হলে রক্ত দেবো। কাজেই কোন ভয় পাবেন না।

তিনি সরকারের প্রতি প্রশ্ন রেখে বলেন, আমরা কি বাংলাদেশের নাগরিক নয়? কেন আমাদের উপর নির্যাতন করা হচ্ছে? তিনি সবাইকে সভা-সমাবেশে যোগ দিয়ে অন্যায়-অবিচারের প্রতিবাদ জানানোর আহ্বান জানান।

লোগাং ইউপির নারী মেম্বার মিথি চাকমা বলেন, গত ৩ সেপ্টেম্বর কাপ্তাইয়ে এসএসসি পরীক্ষার্থী মারমার ছাত্রীকে ৬ সেনা সদস্য কর্তৃক ধর্ষণ ও খাগড়াছড়ির রামগড়ে বাঙালি বাগান মালিক কর্তৃক এক পাহাড়ি গৃহবধূকে ধর্ষণ চেষ্টা করা হয়েছে। পাহাড়ের প্রতিনিয়ত এভাবে ধর্ষণ-নির্যাতনসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে বলে তিনি অভিযোগ করেন।

তিনি আরো বলেন, ধর্ষকরা কারোর বাপ-ভাই, আত্মীয় হতে পারে না। ধর্ষণকারী যেই হোক তাকে শাস্তি দিতে হবে। আমরা সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে নই। তবে যারা ধর্ষণ, নারী নির্যাতন ও অন্যায়-অবিচার করবে আমরা তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবো।

তিনি পাহাড়ে এ যাবতকালে যত নারী ধর্ষণ-নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে সেসব ঘটনাসহ কাপ্তাইয়ে ছাত্রীকে ধর্ষণে জড়িত ৬ সেনা সদস্যকে দ্রুত গ্রেফতার ও সাজার দাবি জানান।

পানছড়ি সদর ইউপির নারী মেম্বার মন্দিরা চাকমা বলেন, আজকে যে আমরা নারীরা এখানে সমবেত হতে পেরেছি তাতে আমার খুবই ভালো লাগছে। বিভিন্ন জায়গায় যে ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে আমরা চুপ থাকলে আরো বেশি এ ধরনের ঘটনা ঘটবে। তাই আমরা আর ধর্ষণ-নির্যাতন সহ্য করবো না। এসব নিপীড়ন-নিয়াতনের বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিরোধ করতে হবে। তিনি যে কোন প্রতিবাদে সহযোগীতা প্রদান করবেন বলে জানান।

হিল উইমেন্স ফেডারেশনের নেত্রী নিশি চাকমা বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের মা-বোনেরা কোথাও নিরাপদ নয়। আজকে আমাদের এই সমাবেশের কারণ হচ্ছে, গত ৩ সেপ্টেম্বর রাঙামাটির কাপ্তাইয়ে এসএসসি পরীক্ষার্থী এক মারমা কিশোরীকে ৬ সেনা সদস্য কর্তৃক ধর্ষণ করা হয়েছে। আমরা আর চাই না পার্বত্য চট্টগ্রামে ধর্ষণ, নির্যাতন, অন্যায়-অত্যাচার হোক।

তিনি বলেন, যে সেনাবাহিনী নিরাপত্তার কথা বলে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়োজিত রয়েছে তারা আজ ধর্ষণ করছে, স্কুলছাত্রীকে পর্যন্ত রেহাই দিচ্ছে না। শুধু কাপ্তাই ঘটনা নয়, লংগদুতে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কর্তৃক নিজ ছাত্রী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এসব ঘটনার বিরুদ্ধে আমাদেরকে প্রতিবাদ করতে হবে।

তিনি আরো বলেন, আমরা কখনো কল্পনা চাকমার কথা ভুলে যেতে পারি না। ১৯৯৬ সালে সেনাবাহিনী কর্তৃক কল্পনা চাকমা অপহরণের শিকার হয়েছেন। তার বিচার আমরা এখনো পাইনি।

তিনি বলেন, আজকে এই সমাবেশের মাধ্যমে আমরা দেখিয়ে দিয়েছি যে নারীরাও ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন করতে পারে। আজকের এই বার্তা দিতে চাই যে, আমরা আর ধর্ষণ-নির্যাতন বরদাস্ত করবো না।

নিশি চাকমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে আমরা নারীরা, আমাদের বাপ-ভাইয়ের কেউই নিরাপদ নয়। এখানে ধর্ষণ, নিপীড়নের ঘটনা ঘটছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার প্রশাসন কি করছে? এই সমাবেশে থেকে আমরা কল্পনা অপহরণ থেকে শুরু করে এ যাবত সংঘটিত নারী ধর্ষণ, নির্যাতনের বিচার কেন হচ্ছে না তার জবাব সরকার ও প্রশাসনের কাছ থেকে পেতে চাই।

তিনি জাতির অস্তিত্ব রক্ষার জন্য সবাইকে আন্দোলনে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান এবং কাপ্তাইয়ে স্কুলছাত্রী ধর্ষণকারী ৬ সেনা সদস্যকে দ্রুত গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করেন।

সাবেক নারী ইউপি সদস্য সুজাতা চাকমা বলেন, যারা ধর্ষণ করেছে তারা অনায়াসে ঘোরাফেরা করছে। কিন্তু সরকার তাদের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নিচ্ছে না, গ্রেফতার করছে না। তিনি ধর্ষণকারীদের দ্রুত গ্রেফতার ও সুষ্ঠু বিচার দাবি করেন।

তিনি আরো বলেন, সরকারের পাহাড়ি-বাঙালি বৈষম্যমূলক নীতির কারণে পাহাড়ি নারীদের ধর্ষণ, নিপীড়ন করা হচ্ছে। আমরা ঘরে-বাইরে সবক্ষেত্রে নির্যাতিত। এর থেকে মুক্তির জন্য আমাদের সাহস নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। ঘরে বসে থাকলে হবে না। জোরালোভাবে প্রতিবাদ জানাতে হবে। সভা-সমাবেশ, মিছিল-মিটিঙে অংশ নিতে হবে।

তিনি সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলনে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে বলেন, আমাদের অধিকার আমাদেরকে আদায় করতে হবে। ভয়ের কারণে নেই। একজনকে মেরে ফেললে আমরা ১০ জন রুখে দাঁড়াবো।

সমাবেশের সভাপতি মিনতি চাকমা বলেন, অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে আমাদের সবাইকে এভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়াই করতে হবে।

নারীদের কোথাও নিরাপত্তা নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, আন্দোলনের মাধ্যমেই আমাদের অধিকার আদায় ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। অধিকার এমনিতে পাওয়া যায় না, ছিনিয়ে আনতে হয়।

তিনি আরো বলেন, আমরা নারীরা ঐক্যবদ্ধ হলে সবকিছু করতে পারি। যতই নিপীড়ন-নির্যাতন করা হোক না কেন জাতি ধর্ম নির্বিশেষে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সবাইকে এগিয় এসে আন্দোলনে সামিল হতে হবে।

সমাবেশ শেষে বিক্ষোভে অংশগ্রহণকারী নারীরা কাপ্তাইয়ে এসএসসি পরীক্ষার্থী কিশোরীকে ধর্ষণকারী ৬ সেনা সদস্যের কুশপুত্তলিকায় ঝাড়ু পেটা করে ধর্ষকদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করেন।


সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।


সিএইচটি নিউজের ইউটিউব চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব করুন

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More