দীঘিনালায় বিতর্কিত ‘পঞ্চদশ সংশোধনী’ বাতিল ও জাতিসত্তার স্বীকৃতির দাবিতে গণসমাবেশ ও মিছিল

0

দীঘিনালা প্রতিনিধি, সিএইচটি নিউজ
রবিবার, ৩০ জুন ২০২৪

সংবিধানের বিতর্কিত ‘পঞ্চদশ সংশোধনী’ বাতিল ও সকল জাতিসত্তার সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবিতে খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় গণসমাবেশ ও মিছিল অনুষ্ঠিত হয়েছে।

আজ রবিবার (৩০ জুন ২০২৪) সকাল ১০টায় ‘দীঘিনালা এলাকাবাসী’র ব্যানারে উপজেলার বাবুছড়া রাস্তার মুড়োপাড়া চৌমুহনী হতে মিছিল বের করা হয়। মিছিলটি রাস্তা প্রদক্ষিণ করে বাবুছড়া নুয়োবাজারে এসে সমাবেশে মিলিত হয়। 

মিছিল ও সমাবেশে বিভিন্ন শ্লোগান লেখা প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন করা হয়। এতে কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা, বীর বাহাদুর ও দীপংকর তালুকদারের ছবি ও পঞ্চদশ সংশোধনী লেখার ওপর ক্রস চিহ্ন দিয়ে প্রদর্শন করতে দেখা যায়।

“বাঙালি জাতীয়তা’ মানি না, লড়াই চলছে, চলবে” শ্লোগানে আয়োজিত গণসমাবেশে ৪৭ নং ধনপাদা মৌজার হেডম্যান যুব লক্ষন চাকমার সভাপতিত্বে ও বাবুছড়া ইউপি সদস্য টন্তুমনি চাকমার সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন মহিলা কার্বারি কনিকা চাকমা, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক দিপুলাক্ষ চাকমা, বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগি আনন্দ মোহন চাকমা, বাবুছড়া ইউপি সদস্য শান্তি প্রিয় চাকমা এবং সংহতি জানিয়ে বক্তব্য রাখেন ইউপিডিএফের দীঘিনালা ইউনিটের  প্রধান সংগঠক মিল্টন চাকমা।

সমাবেশে অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক দীপুলাক্ষ বলেন, পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠীর জীবন যাত্রা থেকে বুঝা যায় পাহাড়িরা আজ কোন অবস্থায় রয়েছে। একদিকে উগ্রবাঙালি জাতীয়তাবাদ চাপিয়ে দেয়া অন্যদিকে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পরে পাহাড়ে পরিস্থিতি এক ভয়াবহ রূপ নেয়। এসব বাস্তবতা দুচোখে প্রত্যক্ষ করছি। পাহাড়িরা যাবে কোথায়? যে রাষ্ট্রে পাহাড়িদের অধিকার পাওয়ার কথা, সেই রাষ্ট্র পাহাড়িরা নানা বৈষম্য ও অন্যায়ের শিকার হচ্ছে। পাহাড়িদের জাতিগত পরিচয় বিলুপ্ত করে দিতে ২০১১ সালে সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনী এনে তা সংসদে পাস করা হয়েছে। এই পঞ্চদশ সংশোধনীতে পাহাড়িদের ওপর বাঙালি জাতীয়তা চাপিয়ে দেয়া হয়। তিনি সংবিধান সংশোধন করে পাহাড়িদের জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।


আনন্দ মোহন চাকমা বলেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতার পরে দেশে সংবিধান রচিত হয়। শেখ মুজিব সেই সময়েও পাহাড়িদেরকে বাঙালি হয়ে যেতে বলেছিলেন। এম এন লারমা তার প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছেন, ‘একজন বাঙালি কোনদিন পাহাড়ি হতে পারে না, তেমনি একজন পাহাড়িও কোনদিন বাঙালি হতে পারবে না’। বর্তমানে তাঁর মেয়ে শেখ হাসিনা পিতার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে চাইছেন। আইনের মাধ্যমে আমাদেরকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন। তাই এর বিরুদ্ধে সকল শ্রেণী-পেশার মানুষকে প্রতিবাদ করতে হবে।

তিনি আরো বলেন, বর্তমান সরকার প্রধান শেখ হাসিনা পার্বত্য চুক্তি করে ইউনেস্কো শান্তি পুরস্কার পেয়েছেন। কিন্তু সরকার এখন পার্বত্য চট্টগ্রামে পূর্ণমন্ত্রীর বদলে প্রতিমন্ত্রী দিয়ে চুক্তির বরখেলাপ করেছেন। তিনি বলেন, সরকার আমাদের পাহাড়িদের ধ্বংস করার জন্য নানা পাঁয়তারা চালিয়ে যাচ্ছে। আমাদের প্রথাগত হেডম্যান, কার্বারী, রাজা পদবী বিলুপ্ত করে দেয়ার ষড়যন্ত্র করছে। তাই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমাদের টিকে থাকতে হবে। আমরা কোনদিন বাঙালি হতে পারবো না। বাঙালি জাতীয়তাবাদ আমরা মানতে পারি না। আমরা নিজ নিজ জাতিগত পরিচয়ে বেঁচে থাকতে চাই।

তিনি ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন ছাড়া স্বাধিকার আদায় করা সম্ভব নয় মন্তব্য করে পার্বত্য চট্টগ্রামে নেতৃত্বদানকারী সকল আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানান।


ইউপিডিএফ দীঘিনালা ইউনিটে সমন্বয়ক প্রধান মিল্টন চাকমা বলেন, আওয়ামী লীগ হলো জম্মগতভাবে উগ্র বাঙাালি জাতীয়তাবাদের ধারক বাহক। সেই কারণেই দেশের মানুষ এখন শান্তিতে বসবাস করতে পারছে না। পাহাড়ে রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলো পাহাড়িদের উপর অন্যায় দমন-পীড়ন চালাচ্ছে। তারা পাহাড়িদের চায় না, তারা চায় এখানকার মাটি। কিন্তু আমরা চাই আন্দোলনের মাধ্যমে আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামকে রক্ষা করেই বেঁচে থাকতে।

তিনি বলেন, সরকার আমাদের ওপর বাঙালি জাতীয়তা চাপিয়ে দিলেও আমরা কোনদিন বাঙালি হতে পারবো না। আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, বম, খিয়াংসহ যেসব জাতিসত্তা রয়েছি আমরা নিজেদের জাতীয়তা, নিজেদের সংস্কৃতি নিয়েই বেঁচে থাকতে চাই।

তিনি কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা, দীপংকর তালুকদার, বীর বাহাদুরকে বাঙালি জাতীয়তার সমর্থনকারী উল্লেখ করে বলেন, তারা নাক চ্যাপ্টা, নামে পাহাড়ি হলেও তারা চরিত্রগতভাবে একেকজন বাঙালি। তারা জাতীয় স্বার্থ বিসর্জন দিয়েই নিজেদের স্বার্থ আদায় করছে।


মিল্টন চাকমা আরো বলেন, শেখ মুজিবুর রহমান ৭২ সালে বাঙালি বানিয়েছেন, তার মেয়ে শেখ হাসিনা ২০১১ সালে বাঙালি বানিয়েছেন। এখন আবার শেখ হাসিনা ১৯০০ সালের রেগুলেশন আইন বাতিল করে দেয়ার চক্রান্ত করছেন।

এ সময় তিনি উপস্থিত লোকজনকে উদ্দেশ্য করে বলেন, শেখ হাসিনা যে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সবাইকে বাঙালি  বানিয়েছেন তাহলে আপনারা কি বাঙলি না চাকমা? এর উত্তরে সকলে সমস্বরে ‘চাকমা চাকমা’ বলে ওঠেন। একইভাবে আপনারা কি বাঙলি না ত্রিপুরা? জানতে চাইলে সকলে সমস্বরে ‘ত্রিপুরা ত্রিপুরা’ বলেন ওঠেন।

তিনি বলেন, বৃষ্টির মধ্যেও এই সমাবেশে আপনাদের উপস্থিতি প্রমান করে যতই কালাকানুনের মাধ্যমে আমাদেরকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করা হোক না কেন পূর্ণস্বায়ত্তশাসন আদায় না হওয়া পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণকে দমিয়ে রাখা যাবে না। তিনি যে কোন ষড়যন্ত্র ও পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য ইউপিডিএফের পতাকাতলে সমবতে হতে সকলের প্রতি আহ্বান জানান।

সমাবেশের সভাপতি যুব লক্ষন চাকমা বলেন, জাতির পরিচয় টিকিয়ে রাখার জন্য আন্দোলন করতে হবে। সরকার ১৯০০ সালের রেগুলেশন বাতিলের মাধ্যমে কার্বারি, হেডম্যানের ক্ষমতা বিলুপ্ত করে দেয়ার ষড়যন্ত্র করছে। তাই সবাইকে তিনি ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন করার আহ্বান জানান।



This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More