কল্পনা চাকমা অপহরণ দিবসে কুদুকছড়িতে সমাবেশ, চিহ্নিত অপহরণকারীদের প্রতীকী ফাঁসি প্রদান

রাঙামাটি প্রতিনিধি, সিএইচটি নিউজ
বুধবার, ১২ জুন ২০২৪
পাহাড়ের নারী নেত্রী কল্পনা চাকমা অপহরণের ২৮ বছর উপলক্ষে বৈরি প্রকৃতি মোকাবেলা করে রাঙামাটির কুদুকছড়িতে প্রতিবাদ সমাবেশ এবং জনতার আদালতের রায়ে চিহ্নিত অপহরণকারী লে. ফেরদৌস, ভিডিপি কমাণ্ডার নুরুল হক ও সালেহ আহম্মেদকে প্রতীকী ফাঁসি প্রদান করা হয়েছে।
আজ বুধবার (১২ জুন ২০২৪) দুপুরে রাঙামাটি সদর উপজেলার দক্ষিণ কুতুকছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে হিল উইমেন্স ফেডারেশন, পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘ ও নারী আত্মরক্ষা কমিটি যৌথভাবে এই কর্মসূচির আয়োজন করে।
প্রবল বৃষ্টির মধ্যেই চলে সমাবেশের মঞ্চ তৈরির কাজ। বৃষ্টি উপেক্ষা করে বিভিন্ন এলাকা থেকে দলে দলে লোকজন সমাবেশ স্থলে এসে উপস্থিত হন। এতে ছাত্র-ছাত্রী, নারী, বৃদ্ধসহ সর্বস্তরের অন্তত দেড় সহস্রাধিক লোক অংশগ্রহণ করেন।


সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সভাপতি নীতি চাকমা ও জনতার আদালতের রায় পড়ে শোনান পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি রিনিসা চাকমা।
হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক রিতা চাকমার সঞ্চালনায় সমাবেশ আরো বক্তব্য রাখে ঢাকা থেকে আগত অতিথি ল্যাম্প পোস্টের সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য ফারহানা হক শ্যামা, বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সহসাধারণ সম্পাদক নিকন চাকমা, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সদস্য এন্টি চাকমা ও দয়াসোনা চাকমা এবং রাঙামাটি জেলা শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক নিকি চাকমা।
এছাড়া সমাবেশে সংহতি জানিয়েছেন বাংলাদেশ নারী মুক্তি কেন্দ্রের সীমা দত্ত, সমাজতান্ত্রিক নারী ফোরামের শম্পা বসু, শ্রমজীবী বিপ্লবী নারী ফোরামের সভাপতি বহ্নিশিখা জামালি।

সমাবেশে ফারহানা হক শ্যামা বলেন, কল্পনা চাকমা অপহরণের ঘটনা পাহাড়ে একটি জঘন্যতম ঘটনা। একটি স্বাধীন দেশে সবার মত প্রকাশ করার অধিকার রয়েছে। অথচ কল্পনা চাকমা পাহাড়ের নিপীড়িত মানুষের মুক্তির কথা বলার কারণে রাষ্ট্রের একটি বাহিনী দ্বারা অপহরণের শিকার হন। যার বিচারের দাবিতে আজও আন্দোলন করতে হচ্ছে।
তিনি বলেন, আজকে যারা আন্দোলন করছে তাদের সাহসের অনুপ্রেরণা হলেন কল্পনা চাকমা। পাহাড়ে মিঠুন, মাইকেল, বিপুলদের ঘটনা একই সুত্রে গাঁথা।

অন্যান্য বক্তারা দীর্ঘ ২৮ বছরেও কল্পনা চাকমার চিহ্নিত অপহরণকারীদের বিচার না করে আদালতের মাধ্যমে অপরাধীদের দায়মুক্তি দেয়ার ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানান। তারা এ দায়মুক্তির ঘটনাকে অপরাধীদের রক্ষায় রাষ্ট্রীয় কৌশল বলে মন্তব্য করেন।
এছাড়া তারা পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রতিনিয়ত অন্যায় দমন-পীড়নের বিষয়েও তুলে ধরেন।
বক্তাদের বক্তব্য প্রদান শেষে প্রতিরোধ সাংস্কৃতিক স্কোয়াডের টিম পাহাড়ের দমন-পীড়নের ওপর একটি নাটিকা প্রদর্শন করে। নাটিকায় পাহাড়ের আন্দোলন দমনে রাষ্ট্রীয় বাহিনী কর্তৃক অন্যায় দমন-পীড়ন ও হত্যাকাণ্ডের চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়। এ সময় সমাবেশস্থল থেকে উপস্থিত ছাত্র-জনতা নানা প্রতিবাদী শ্লোগান দেন।

এরপর সমাবেশের মঞ্চে উঠেন হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি নীতি চাকমা, পার্বত্য নারী সংঘের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি রিনিসা চাকমা, ল্যাম্প পোস্টের সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য ফারহানা হক শ্যামা, কার্বারি প্রতিনিধি শ্যামল কার্বারি ও মহিলা কার্বারি লাকি চাকমা.পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসাধারণ সম্পাদক নিকন চাকমা ও গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি ধর্মশিং চাকমা।
এ সময় সমাবেশের সভাপতি নীতি চাকমা বৈরি প্রকৃতির মধ্যেও সমাবেশে অংশগ্রহণ করায় অংশগ্রহণকারী সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, আজকে প্রবল বৃষ্টির বাধা উপেক্ষা করে এই গণসমাবেশ প্রমাণ করে জনগণ কল্পনা অপহরণকারীদের দায়মুক্তির রায় মানে না। তারা কল্পনা অপহরণকারীদের বিচার ও শাস্তি চায়।

তিনি কল্পনা চাকমা’র অপহরণ ঘটনা তুলে ধরে বলেন, এই রাষ্ট্র, সরকার দীর্ঘ ২৮ বছরেও কল্পনা চাকমার সন্ধান দিতে পারেনি, চিহ্নিত অপহরণকারীদের বিচার করেনি। তাই জনতার আদালতের মাধ্যমে আজকে আমরা লে. ফেরদৌস গংদের ফাঁসি দেবো।
সরকার উন্নয়নের বুলি আওড়িয়ে নির্বিচারে দমন-পীড়ন, নারী নির্যাতন চালাচ্ছে অভিযোগ করে নীতি চাকমা বলেন, সরকারের এমন উন্নয়ন আমাদের প্রয়োজন নেই। আমাদের দরকার অধিকার।
তিনি সকল পরিস্থিতি মোকাবেলা করে জাতীয় মুক্তির আন্দোলনে সামিল হওয়ার জন্য সকলের প্রতি আহ্বান জানান।
নীতি চাকমার বক্তব্যের পর রিনিসা চাকমা জনতার আদালতের রায় পড়ে শোনান। রায়ে লে. ফেরদৌস, সালেহ আহম্মেদ ও নুরুল হকের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করা হলে সমাবেশ স্থলের চতুর্দিক থেকে কল্পনা চাকমার চিহ্নিত অপহরণকারী লে. ফেরদৌসের ফাঁসি চাই, ফাঁসি চাই, সালেহ আহম্মেদের ফাঁসি চাই, ফাঁসি চাই, নুরুল হকের ফাঁসি চাই, ফাঁসি চাই’ শ্লোগানের রব ওঠে।
রায় ঘোষণার পরপরই শিক্ষার্থীরা কল্পনার অপহরণকারী লে. ফেরদৌস, সালেহ আহম্মেদ ও নুরুল হকের কুশপুত্তলিকা টেনেহিঁচড়ে ও পেটাতে পেটাতে নিয়ে আসে এবং রশিতে ঝুলিয়ে প্রতীকী ফাঁসি কার্যকর করা হয়।


অপরাধীদের প্রতীকী ফাঁসি দেয়ার সময় ঢোল বাজানো হয় এবং উপস্থিত ছাত্র-জনতা লে. ফেরদৌসের ফাঁসি চাই, সালেহ আহম্মেদের ফাঁসি চাই, নুরুল হকের ফাঁসি চাই” শ্লোগানে সমাবেশস্থল প্রকম্পিত করেন। বেশ কিছুক্ষণ ধরে এমন শ্লোগানের পর কর্মসূচি সমাপ্ত করা হয়। পরে সংক্ষিপ্ত মিছিল সহকারে অপরাধীদের কুশপুত্তলিকাগুলো টেনে নিয়ে রাঙামাটি-খাগড়াছড়ি সড়কের পাশে গাছে ঝলিয়ে রাখা হয়।


উল্লেখ্য, ১৯৯৬ সালের ১১ ও ১২ জুনের মধ্যবর্তী রাতে রাঙামাটির বাঘাৱইছড়ি উপজেলার নিউ লাল্ল্যাঘোনা গ্রামের নিজ বাড়ি থেকে তৎকালীন কজইছড়ি আর্মি ক্যাম্পের কমাণ্ডার লে. ফেরদৌস ও তার সহযোগী ভিডিপির নুরুল হক ও সালেহ আহমদের নেতৃত্বে কল্পনা চাকমাকে অপহরণ করা হয়। দীর্ঘ ২৮ বছরেও কল্পনা চাকমার কোন হদিস পাওয়া যায়নি। রাষ্ট্র বরাবরই কল্পনা চাকমার অপহরণকারীদের রক্ষা করতে প্রচেষ্টা চালিয়েছে। সর্বশেষ গত ২৩ এপ্রিল ২০২৪ রাঙামাটি চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ফাতেমা বেগম মুক্তার আদালত কল্পনা অপহরণ ঘটনায় দায়েরকৃত মামলাটি খারিজ করে দিয়ে চিহ্নিত অপরাধীদের দায়মুক্তি দিয়েছে। আদালতের এই রায়ের বিরুদ্ধে হিল উইমেন্স ফেডারেশনসহ বিভিন্ন সংগঠন গত ৬ জুন থেকে বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ, সমাবেশসহ জনতার আদালতের মাধ্যমে অপরাধীদের প্রতীকী ফাঁসি প্রদান কর্মসূচি পালন করেছে।
সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।